মুছে গেল ছিটমহল
বাংলাদেশের ভেতরে ‘ভারত’, ভারতের ভেতর ‘বাংলাদেশ’। গত প্রায় সাত দশক ধরে চিত্রটা এমনই ছিল। রাত ১২টা পর্যন্তও হিসাবটা ছিল এরকম । তবে ১২টা এক মিনিট হতে না হতেই বদলে গেল সেই হিসাব।
মূল ভুখন্ড থেকে এপাড়ে ছিটকে পড়া ‘১১১টি ভারত’ মানচিত্রে ঢুকে গিয়ে পরিণত হলো একটি বাংলাদেশে। একইভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের ভুখন্ড থেকে কাঁটাতারের ওপারে ছিটকে ৬৮ বছর ধরে অবরুদ্ধ থাকা ‘৫১টি বাংলাদেশ’ মিশে গিয়ে পরিনত হলো একটি ভারত। এর ফলে মুক্তি মিলল অর্ধ লাখেরও বেশি মানুষের। অবসান হল যুগ যুগ ধরে চলে আসা অবরুদ্ধ জীবনের। আর ছিটমহল শব্দটি পরিণত হল ইতিহাসে। যে অবরুদ্ধ জীবনের শুরুটা হয়েছিল সেই ১৯৪৭ সালে। এই অন্ধকার আর অবরুদ্ধ জীবন থেকে মুক্তির আনন্দ গতকাল শুক্রবার ফুটে উঠেছিল ছিটমহলগুলোতে, নানা বয়সী মানুষের চোখেমুখে।
তবে কারো কারো মনে একদিকে যেমন ছিল আনন্দ, অন্য দিকে ছিল বেদনা। তা ছিল প্রতিবেশী থেকে স্বজন হয়ে যাওয়া মানুষদের হারানোর বেদনা। লালমনিরহাটের হাতীবান্ধার ১৩৫ নম্বর উত্তর গোতামারী ছিটমহলের ছকবর আলী। ছকবর আলীর বয়স সত্তরের চেয়ে বেশি। বাড়ির পাশেই থাকা ৬০ বছর বয়সী ভৈরব চন্দ্রের বাড়ি দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘সেই ছোট্ট বেলা থেকে ওই বাড়িতে যাতায়াত। একসাথে খেলাধুলা করে বড় হয়েছি। একজনের বিপদে আরেকজন এগিয়ে গিয়েছি। অথচ ছিটমহল বিনিময়ে আমি বেছে নিয়েছি বাংলাদেশ আর ভৈরব নিয়েছে ভারত। এত দিনের সম্পর্ক ছিন্ন করে সে কী কারণে চলে যাচ্ছে জানিনা...’। আর কিছু বলতে পারেন না ছকবর। অনেকের সামনেই তাঁর দু’চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে পানি, ডুঁকরে কেঁদে ওঠেন তিনি। পরে খুঁজে পাওয়া যায় ভৈরবকে। এতদিন এই দেশে সবার সাথে মিলেমিশে থেকে এখন কেন চলে যাচ্ছেন-এমন প্রশ্নের জবাবে বেশকিছুক্ষন নীরব থেকে শুধুই বলেন, ‘জানিনা’। এরকম অনেক ছকবর আর ভৈরবকে খুজে পাওয়া যায় গতকাল, ঐতিহাসিক মুহূর্তের ঠিক আগে। বিভিন্ন ছিটমহলে।
আবার এর বিপরীত চিত্রও দেখা গেছে। ছিটমহলের বাসিন্দা প্যানকাটু বর্মণ (৬৯) বলেন, ‘হামরা যুগ যুগ ধরি অপেক্ষা কোরছি নিজের দ্যাশোত যাবার বাদে(জন্য)। সেই আশা আইজ(আজ) পূরণ হইলো’। অন্য বাসিন্দা আছির উদ্দিন বলেন, ‘ভারতীয় হিসেবে পরিচিত হলেও আমরা এতদিন বাংলাদেশের চাল ও ডাল খেয়ে বেঁচে ছিলাম। তাই এই দেশের নাগরিক হওয়ার জন্য এতটা দিন অপেক্ষা করেছি। সেই আশা আজ পূরণ হলো। আমাদের মতো সুখী মানুষ এখন আর কেউ নেই’।