বাঁধ অপসারণ বন্ধ, আবার নাব্যতা হারানোর আশঙ্কা
মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেলের সঙ্গে যুক্ত ৩২টি মূল খাল ও অর্ধ শতাধিক শাখা খালের বাঁধ অপসারণ কাজ বর্তমানে অর্থের অভাবে বন্ধ আছে। দীর্ঘ প্রায় দুই যুগ ধরে মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেল সংযুক্ত এসব খালে বাঁধ দিয়ে স্থানীয় প্রভাবশালীরা চিংড়ি চাষ করছে। স্থানীয় বাসিন্দা ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেল সংলগ্ন এসব খাল সঠিকভাবে খনন না হলে চ্যানেলে পানির স্রোত আশানুরূপ হবে না। আর স্রোত যথাযথ না হলে এ চ্যানেলে আবার খুব দ্রুত পলি পড়ে নাব্যতা হারাবে।
মংলা ও রামপাল উপজেলা ভূমি কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, গত বছর ডিসেম্বর মাসে মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেল সংলগ্ন ৩২টি মূল খাল এবং আরো ৩০৩টি শাখা খাল চিহ্নিত করে প্রশাসন। নাব্যতা সংকট ও খালগুলো দখল করে চিংড়ি চাষ করার কারণে এসব খাল প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। রামপাল উপজেলার ২৪৬টি খালের ওপর এক হাজার ১১৮টি অবৈধ বাঁধের তালিকা করে প্রশাসন। আর মংলা উপজেলায় ৭২টি খালের ওপর ২৫২টি অবৈধ বাঁধের তালিকাও করে প্রশাসন। গত ডিসেম্বর থেকে জুন মাস পর্যন্ত মংলা উপজেলার ১৮টি সংযোগ খালের আংশিক পলি অপসারণ এবং ১৬৭টি অবৈধ বাঁধ এবং রামপাল উপজেলার ১৩টি খালের ওপর ১৫৮টি অবৈধ বাঁধ অপসারণ করে উপজেলা প্রশাসন। আর এ ১৩টি খালেরই সীমিত আকারে পলি অপসারণ করা হয়। এরপর বরাদ্দের অভাবে খালের অবৈধ বাঁধ ও পলি অপসারণ বন্ধ হয়ে যায়। গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশের পর সর্বশেষ এ দুই উপজেলার খালের তালিকা সংশোধন করে জেলা প্রশাসন ৮২টি মূল খাল চিহ্নিত করে আবার বাঁধ অপসারণ শুরু করে। কিন্তু বরাদ্দের অভাবে এ খালগুলোর পলি অপসারণ ও খননকাজ এখন বন্ধ আছে।
মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেল রক্ষা সংগ্রাম কমিটির সভাপতি মহিউদ্দিন শেখ বলেন, ‘দীর্ঘ দুই যুগ ধরে মংলা-রামপালের তিন শতাধিক খাল প্রভাবশালীরা বাঁধ দিয়ে আটকে চিংড়ি চাষ করে আসছে। খননের অভাবে এসব খাল মৃতপ্রায়। আবার অনেক খালের ওপর সরকারি ও বেসরকারি স্থাপনা, ঘরবাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। এসব স্থাপনা ও সব সরকারি খালের ওপর নির্মিত শত শত অবৈধ বাঁধ অপসারণ করতে হবে। তাহলে এসব খালের স্রোতধারা ঘষিয়াখালি চ্যানেলের সাথে মিশে পানির প্রবাহ বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে। আর এতে চ্যানেলটি আবার আগের মতো সচল হবে।’
মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেল খননের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর এনভাইরনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (সিইজিআইএস) রিভার ডেল্টা অ্যান্ড কোস্টাল মরফোলজি ডিভিশনের বিশেষজ্ঞ এ টি এম কামাল হোসেন বলেন, 'জোয়ার-ভাটা প্রবণ এ চ্যানেলে প্রতিদিন হাজার হাজার কিউবিক ঘনমিটার পলি এখনো আসছে। এটা যদি প্রাকৃতিকভাবে শাখা নদী ও শাখা খালে ছড়িয়ে দেওয়া না যায় তাহলে মূল চ্যানেলে আবারও পলি জমে ভরাট হয়ে যাবে। এ পর্যন্ত নদী ও খালগুলোর খনন সঠিক নকশায় হয়নি। মূল চ্যানেল অনেক গভীর করে খনন করা হয়েছে। কিন্তু খালগুলো সে তুলনায় অনেক কম গভীরতায় খনন করা হয়েছে। ফলে চ্যানেলের পানি খালে ঠিকমতো পৌঁছাতে পারছে না। এ জন্যে খালগুলো খননের সময় বিষয়টি বিবেচনায় রাখা উচিত।’
নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) সহকারী প্রকৌশলী (ড্রেজার বিভাগ) দিদার এ আলম বলেন, ‘এই চ্যানেলের বগুড়ার খাল নামক স্থানে ড্রেজিং করার পরও প্রতিদিন প্রচুর পলি জমত। কিন্তু বগুড়া খালের বাঁধ অপসারণ করায় পানির প্রবাহ ও স্রোত বৃদ্ধি পাওয়া এই পয়েন্টে এখন আগের চেয়ে অনেক কম পলি পড়ছে। তাই মূল চ্যানেলের সঙ্গে যত খাল রয়েছে সেগুলোর বাঁধ অপসারণ ও খনন করা হলে এই চ্যানেলের নাব্যতা ধরে রাখা সম্ভব হবে। ইতিমধ্যে এই চ্যানেল থেকে প্রায় ৭৫ লাখ ঘন মিটার পলি অপসারণ করা হয়েছে।’
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছিুক বিআইডব্লিউটিএর খননকাজে নিয়োজিত এক কর্মকর্তা বলেন, ‘নদীর চর দখল করে এখনো স্থানীয় বাসিন্দারা চিংড়ি ঘের করছে। এর ফলে নদীর চরে উত্তোলিত পলি ফেলতে সমস্যা হচ্ছে। এ ছাড়া নদীর চাড়াখালী ও সীতারঘাট এলাকার চরে যে অবৈধ চিংড়ি ঘের রয়েছে সেখানে পলি ফেলতে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষেদের চেয়ারম্যান বাধা দিচ্ছেন। এতে খনন ও পলি অপসারণে প্রতিবন্ধকতার পাশাপাশি কাজে ধীর গতির সৃষ্টি হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর আলম জানান, ‘খালের পলি অপসারণ ও বাঁধ অপসারণে যে বরাদ্দ প্রয়োজন তা আমরা পাইনি। সীমিত আকারে দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দকৃত টিআর এবং কর্মসূচির কাজের প্রকল্প দিয়ে এত দিন আমরা কাজ চালিয়ে এসেছি। তাতে মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেলের সাথে সামঞ্জস্য রেখে খাল খনন সম্ভব নয়।’
খুলনার বিভাগীয় কমিশনার মো. আব্দুস সামাদ বলেন, ‘আমরা এ চ্যানেল সংযুক্ত ৮২টি খালের খনন ও বাঁধ অপসারণের জন্য সরকারের কাছে বরাদ্দের আবেদন করেছি। আমরা আরো সুপারিশ করেছি খাল খননে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও বিআইডব্লিউটিএকে দায়িত্ব দেওয়ার জন্য। ওই দুই সংস্থা চ্যানেলের সাথে সামঞ্জস্য রেখে সঠিক নকশায় খাল খনন করতে পারবে।