একুশের প্রথম প্রহরে ভাষাশহীদদের শ্রদ্ধা
যথাযথ মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছে জাতি। একুশের প্রথম প্রহরে সারা দেশেই ভাষাসৈনিকদের অবদান ও তাঁদের সংগ্রামমুখর দিনগুলোকে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হচ্ছে। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তি থেকে সর্বস্তরের সাধারণ মানুষের পদভারে মুখরিত হয়ে উঠেছে ঢাকা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার।
রাত ১২টা এক মিনিটেই ভাষাশহীদদের প্রতি প্রথম শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। এর পরপরই শহীদ মিনারের বেদিতে পুষ্পার্ঘ অর্পণ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দুই নেতাই সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করেন।
এরপর প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিপরিষদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের নেতাদের সাথে নিয়েও শহীদ মিনারে পুষ্পমাল্য অর্পণ করেন। প্রধানমন্ত্রী পুষ্পমাল্য অর্পণের পরপরই বিভিন্ন দেশের কূটনীতিবিদ, বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, শিক্ষক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, ছাত্র-শিক্ষকসহ সাধারণ মানুষ সারিবদ্ধভাবে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।
মধ্যরাতে শহীদ মিনার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ঘিরে সাধারণ মানুষের ঢল নেমেছে। গোটা এলাকায় সুদৃশ্য আলপনা আঁকা হয়েছে।
মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ২০১৫ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলীয় নেত্রী পৃথক পৃথক বাণী দিয়েছেন। এছাড়াও বিভিন্ন সংগঠন দিনটি ঘিরে নানা কর্মসূচি নিয়েছে।
রাষ্ট্রপতির বাণী
রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেছেন, নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতিতে ঋদ্ধ হয়ে অন্যের ভাষা ও সংস্কৃতিকে শ্রদ্ধা জানানোর মধ্যে নিহিত আছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মূল চেতনা। এ চেতনাকে ধারণ করে পৃথিবীর সব ভাষাভাষী মানুষের সাথে যোগসূত্র স্থাপিত হোক, এ কামনা করেন রাষ্ট্রপতি।
মো. আবদুল হামিদ মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ২০১৫ উপলক্ষে শুক্রবার দেয়া এক বাণীতে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে মহান ভাষা আন্দোলনে শহীদদের অম্লান স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন।
রাষ্ট্রপতি অমর একুশে বাঙালি জাতির চিরন্তন প্রেরণার উৎস উল্লেখ করে ভাষা আন্দোলনে আত্মোৎসর্গকারী ভাষা শহীদ সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউরসহ নাম না জানা অসংখ্য শহীদদের গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন।সেই সাথে তিনি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তৎকালীন গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্তসহ সকল ভাষা সৈনিককে। তাঁদের অসীম সাহসিকতা, দক্ষ সাংগঠনিক ক্ষমতা ও ত্বরিত কার্যক্রম গ্রহণের ফলে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলন চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে। বাঙালি পায় মাতৃভাষার অধিকার।
প্রধানমন্ত্রীর বাণী
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অমর একুশে আমাদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতীক উল্লেখ করে দেশবাসীকে সব ভেদাভেদ ভুলে একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার আহবান জানিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী মহান শহীদ দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে দেয়া এক বাণীতে শুক্রবার এ আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘আসুন সকল ভেদাভেদ ভুলে একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হই। পবিত্র সংবিধান ও গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখি। সন্ত্রাস ও হানাহানির পথ পরিহার করে দেশ ও জনগণের ভাগ্যোন্নয়নে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার শপথ নিই।’
শেখ হাসিনা মহান শহীদ দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে বাংলা ভাষাভাষীসহ বিশ্বের সকল ভাষা ও সংস্কৃতির জনগণকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানান।
প্রধানমন্ত্রী মহান একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির জীবনে শোক, শক্তি ও গৌরবের প্রতীক উল্লেখ করে বলেন, ১৯৫২ সালের এদিনে ভাষার মর্যাদা রক্ষা করতে প্রাণ দিয়েছিলেন রফিক, শফিক, সালাম, বরকত, জব্বারসহ আরো অনেকে। তিনি ভাষা শহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, ‘শ্রদ্ধা জানাই বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নেতৃত্বদানকারী সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং সকল ভাষা সৈনিকের প্রতি।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘১৯৪৮ সালে ছাত্রলীগ, তমদ্দুন মজলিশ ও অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত হয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। ১১ মার্চ ১৯৪৮ সালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে সংগ্রাম পরিষদ ধর্মঘট ডাকে। এদিন সচিবালয়ের সামনে থেকে বঙ্গবন্ধুসহ অনেক ছাত্রনেতা গ্রেফতার হন। ১৫ মার্চ তাঁরা মুক্তি পান। ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় অনুষ্ঠিত জনসভায় সভাপতিত্ব করেন শেখ মুজিবুর রহমান। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে।’
তিনি বলেন, ‘ওই বছরের ১১ সেপ্টেম্বর ফরিদপুরে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৪৯ সালের ২১ জানুয়ারি তিনি মুক্তি পান। ১৯ এপ্রিল আবারও তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। জুলাই মাসের শেষে তিনি মুক্তি পান। ১৪ অক্টোবর ঢাকায় বঙ্গবন্ধুকে আবার গ্রেফতার করা হয়। কারাগার থেকেই তাঁর দিকনির্দেশনায় আন্দোলন বেগবান হয়। সেই দুর্বার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি শাসকগোষ্ঠীর জারি করা ১৪৪ ধারা ভাঙতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছিলেন ভাষা শহীদরা।’
বিরোধীদলীয় নেতার বাণী
জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ এমপি বলেছেন, বাঙালির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের পাতায় একুশে ফেব্রুয়ারি সারাবিশ্বের বাংলাভাষীদের জন্য অনন্য মহিমায় সমুজ্জ্বল একটি দিন। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ও শহীদ দিবস উপলক্ষে আজ এক বাণীতে তিনি আরো বলেন, আত্মত্যাগ আর গৌরবে ভাস্বর মহান শহীদ দিবস। এদিনটি আজ বিশ্ববাসীর জন্য মাতৃভাষাকে সম্মান জানানোর উপলক্ষও বটে।
বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ বলেন, বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের রক্তক্ষয়ী এই দিনটি এখন আর শুধু শোক ও বেদনার দিন নয়। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সব মানুষের, সব ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার সর্বজনীন উৎসবের দিন।
রওশন এরশাদ সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করেন মাতৃভাষা বাংলাকে রক্ষার সংগ্রামের দাবিতে আত্মদানকারী সকল শহীদদের পবিত্র স্মৃতির প্রতি। তিনি একই সাথে ভাষা আন্দোলনে সকল শহীদদের রুহের মাগফিরাত ও শান্তি কামনা করেন।