সমাজকল্যাণমন্ত্রীর ইন্তেকাল
সমাজকল্যাণমন্ত্রী ও মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মহসিন আলী মারা গেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। আজ সোমবার স্থানীয় সময় সকাল ৯টা ৫৯ মিনিটে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়েছে বলে স্বজনরা নিশ্চিত করেছেন।
urgentPhoto
মন্ত্রীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী।
সৈয়দ মহসিন আলীর মৃত্যুর সংবাদ শুনে নিজ জেলা মৌলভীবাজারে শোকের ছায়া নেমে আসে। শহরের শ্রীমঙ্গল সড়কের বাড়িতে সর্বস্তরের মানুষ ভিড় করেন।
মন্ত্রীর মেজ মেয়ে সৈয়দা সানজিদা শারমিন জানান, আগামীকাল মঙ্গলবার বিকেলে তাঁর বাবার মরদেহ ঢাকায় পৌঁছাবে এবং পরদিন নিজ জেলা মৌলভীবাজারে জানাজা শেষে সৈয়দ শাহ মোস্তফা (রহ.) মাজার শরিফ প্রাঙ্গণে দাফন করা হবে।
গত ৫ সেপ্টেম্বর শনিবার মন্ত্রীকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সের মাধ্যমে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ২ সেপ্টেম্বর হবিগঞ্জ জেলায় সফর শেষে ফিরে ৩ সেপ্টেম্বর ভোর ৪টায় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে নিজেই চালককে ডেকে রাজধানীর শাহবাগে বারডেম হাসপাতালে ভর্তি হন। কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাঁকে নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখেন। এ অবস্থায় ৪ সেপ্টেম্বর সকালে হৃদরোগে আক্রান্ত হলে তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। এ পর্যায়ে তাঁকে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের সাহায্যে লাইফসাপোর্টে রাখা হয়। ৫ সেপ্টেম্বর দুপুর পৌনে ১টায় মন্ত্রীকে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন তাঁর স্ত্রী সৈয়দা সায়রা মহসিন ও ছোট মেয়ে সৈয়দা সাবরিনা শারমীন।
সৈয়দ মহসিন আলী ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা আন্দোলনের লড়াইয়ে অংশ নেন। তিনি ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মৌলভীবাজার-৩ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১২ জানুয়ারি-২০১৪ মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন এবং একই দিন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বভারও নেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে ছাত্রলীগের সদস্য হিসেবে ছাত্রজীবনেই তিনি রাজনৈতিক অঙ্গনে পদচারণা শুরু করেন। ১৯৭১ সালে ২৩ বছর বয়সে তিনি বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় সিলেট বিভাগ সিএনসি স্পেশাল ব্যাচের কমান্ডার হিসেবে সম্মুখযুদ্ধে নিষ্ঠার সঙ্গে নেতৃত্ব দেন। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সম্মুখসমরে আহত হয়েও তিনি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার দৃঢ়প্রত্যয় নিয়ে বাংলদেশকে শত্রুমুক্ত করতে সাহসী বীরের ভূমিকা রাখেন।
জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সৈয়দ মহসিন আলী আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং আওয়ামী লীগের জাতীয় পরিষদের সম্মানিত সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের একজন সক্রিয় সদস্য। তিনি সিলেট জেলা ও বিভাগীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৮ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত মৌলভীবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মহসিন আলী।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এই মুক্তিযোদ্ধা। বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সৈয়দ মহসিন আলী মৌলভীবাজার পৌরসভা চেয়ারম্যান হিসেবে তিনবার নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৯২ সালের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় থেকে শ্রেষ্ঠ পৌরসভা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিনি বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তিনি ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত মহকুমা-জেলা রেড ক্রিসেন্টের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি মৌলভীবাজার চেম্বারের সভাপতি এবং মৌলভীবাজার জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধ ও সমাজসেবায় অসামান্য অবদানের জন্য ভারতের আচার্য দীনেশ চন্দ্র সেন রিসার্চ সোসাইটি তাঁকে ‘আচার্য দীনেশ চন্দ্র সেন স্মৃতি স্বর্ণপদক-২০১৪’ প্রদান করে এবং ‘হ্যালো কলকাতা’ নামে কলকাতাভিত্তিক একটি সমাজকল্যাণ প্রতিষ্ঠান তাঁকে ‘নেহরু সাম্য সম্মাননা-২০১৪’ পুরস্কারে ভূষিত করে।
সৈয়দ মহসিন আলী মৌলভীবাজার পৌরসভার চেয়ারম্যান থাকার সময় স্থানীয় সরকারের আওতায় বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নেন। তিনি থাইল্যান্ড ও ফিলিপাইনে পরিবার পরিকল্পনা এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। তিনি বাংলা, ইংরেজি, উর্দু ও হিন্দি ভাষায় বলা ও লেখায় সুদক্ষ। সৈয়দ মহসিন আলী সরকারি ও ব্যক্তিগত সফরে ভারত, নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানি ভ্রমণ করেছেন।
সৈয়দ মহসিন আলী একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, সমাজসেবক ও জনদরদি ব্যক্তিত্ব হিসেবে সুপরিচিত। সামাজিক উন্নয়নমূলক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাঁর সংশ্লিষ্টতা ছিল। তিনি বিভিন্নভাবে তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। তাঁর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় আজ বহু অসহায় মানুষ দেশে ও বিদেশে প্রতিষ্ঠিত। তাঁর সংগীতপ্রীতি সর্বজনবিদিত। খেলাধুলা, সংগীত, বইপড়া ও শরীরচর্চা ছিল তাঁর প্রিয় শখ।
মহসিন আলী ১৯৪৮ সালের ১২ ডিসেম্বর মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল সড়কের ‘দর্জি মহল’-এ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা সৈয়দ আশরাফ আলী এবং মা আছকিরুন্নেছা খানম। মৃত্যুর আগে তিনি স্ত্রী ও তিন মেয়ে রেখে গেছেন।