সৈয়দ মহসীন আলীর মরদেহ আসছে মঙ্গলবার
বীর মুক্তিযোদ্ধা, সমাজ কল্যাণমন্ত্রী সৈয়দ মহসীন আলীর মরদেহ সিঙ্গাপুরের জেনারেল হাসপাতাল থেকে মঙ্গলবার রাত ১০টায় দেশে আনা হচ্ছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে মন্ত্রীর ছোট ভাই সৈয়দ নওশের আলী খোকন জানান, মরদেহ আনার পর বুধবার বেলা ১১টার দিকে জাতীয় সংসদ ভবনে প্রথম জানাজা হবে। পরে মন্ত্রীর মরদেহ মৌলভীবাজার শহরের দর্জিরমহল এলাকার বাড়িতে আনা হবে। মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে জানাজা শেষে স্থানীয় শাহ মোস্তফা মাজার প্রাঙ্গণে তাঁর মরদেহ দাফন করা হবে।
সিঙ্গাপুরের জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সোমবার (১৪ সেপ্টেম্বর) সকাল ৯টা ৫৯ মিনিটে সৈয়দ মহসীন আলীর মৃত্যু হয়। তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৭ বছর।
নিউমোনিয়া, ডায়াবেটিস ও হৃদরোগের সমস্যা নিয়ে ৩ সেপ্টেম্বর ভোরে বারডেম হাসপাতালে ভর্তি হন মন্ত্রী। সেখানে তাঁকে লাইফ সাপোর্টে নিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হয়। এরপর উন্নত চিকিৎসার জন্য ৫ সেপ্টেম্বর তাঁকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে সিঙ্গাপুরের জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সোমবার সকাল ৯টা ৫৯ মিনিটের দিকে মারা যান তিনি।
সৈয়দ মহসীন আলী তিন মেয়ে, স্ত্রী ও আত্মীয়স্বজনসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। সৈয়দ মহসীন আলীর বাবা সৈয়দ আশরাফ আলী ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। তাঁর মায়ের নাম আছকিরুননেছা খানম। মৌলভীবাজার থেকে ব্যবসায়িক প্রয়োজনে কলকাতা যান আশরাফ আলী। কলকাতার আলীপুরে ছিল তাঁর বিশাল বাড়ি। সেই বাড়িতে ১৯৪৮ সালের ১২ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন সৈয়দ মহসীন আলী। পাঁচ ভাই ও এক বোনের মধ্যে মহসীন আলী সবার বড়।
মৌলভীবাজারে দর্জিরমহল এলাকায় থাকা তাঁর বাড়ির লোকজন জানান, জাতীয় সংসদ ভবনে মন্ত্রীর প্রথম জানাজা হবে। তারপর নিজ এলাকার শাহ মোস্তফার মাজারে তাঁর দাফন সম্পন্ন হবে।
এদিকে, সৈয়দ মহসীন আলীর মৃত্যুর খবর পেয়ে জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে অসংখ্য মানুষ তাঁর মৌলভীবাজার শহরের দর্জিরমহল এলাকার বাড়িতে ছুটে আসেন। পুরো এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে।
মন্ত্রীর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্পিকার ড. শিরিন শারমিন, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মোহিত, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, জাতীয় সংসদের হুইপ শাহাবুদ্দিন আহমদ, মৌলভীবাজার জেলা পরিষদের প্রশাসক আজিজুর রহমান, সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র বদর উদ্দিন আহমেদ কামরান, মৌলভীবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সংসদ সদস্য উপাধ্যক্ষ আবদুস শহিদ, জেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এম এ ফিরোজ, আলাউর রহমান চৌধুরী, যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এম এ রহিম, জেলা আওয়ামী লীগের সম্পাদক নেছার আহমদ, সাংগঠনিক সম্পাদক মিছবাউর রহমান, সাইফুর রহমান বাবুল, জেলা বিএনপির সভাপতি এম নাসের রহমান, সম্পাদক খালেদা রব্বানী, সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান মিজান, মৌলভীবাজার পৌরসভার মেয়র ফয়জুল করিম ময়ূন, মৌলভীবাজার চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি কামাল হোসেন, জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি সৈয়দ শাহাবউদ্দিন, জাসদ সভাপতি এম এ হক, জাসদ সম্পাদক নাজিম উদ্দিন নজরুল, মৌলভীবাজার প্রেসক্লাবের সভাপতি এম এ সালাম, সম্পাদক এস এম উমেদ আলী, সাংবাদিক সমিতির জেলা সভাপতি সৈয়দ হুমায়েদ আলী শাহীন, সম্পাদক আনহার আহমদ সমশাদ, পাতাকুঁড়ির দেশ সম্পাদক নুরুল ইসলাম শেফুল, পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির সভাপতি ছাদিক আহমদ, ব্যাংক অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবু তাহের, সম্পাদক মামুন আহমদ, মৌলভীবাজার জেলা রেডক্রিসেন্টের ভাইস চেয়ারম্যান ইয়াহিয়া মোজাহিদ, সম্পাদক এ এইচ এম শাহাবুদ্দিন আহমদ, মৌলভীবাজার জেলা যুব জোট সভাপতি হাসান আহমদ রাজা, সম্পাদক সোহেল সামাদ খান পলাশ, ম্যানচেস্টার আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক রুহুল আমীন রুহেল, যুবদলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মতিন বখস প্রমুখ।
সৈয়দ মহসীন আলী ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। যুদ্ধ চলাকালে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। তিনি সিলেট বিভাগে সিএনসি স্পেশাল ব্যাচের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ গঠনেও সৈয়দ মহসীন আলীর ভূমিকা ছিল অপরিসীম। তিনি সামাজিক ও রাজনৈতিক বিভিন্ন কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। ১৯৬৪ সালে তিনি ছিলেন সিলেট বেতার কেন্দ্রের একজন শিল্পী ও বাংলাদেশ টাইমসের মৌলভীবাজার প্রতিনিধি। তিনি প্রথমে মৌলভীবাজার জেলা যুবলীগ ও পরে আওয়ামী লীগ সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। মহসিন আলী ১৯৭৫-৯০ পর্যন্ত রেডক্রসের সেক্রেটারি ছিলেন।
২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মৌলভীবাজার-৩ (মৌলভীবাজার-রাজনগর) আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ওই নির্বাচনে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী বিএনপির শক্তিশালী নেতা প্রয়াত সাইফুর রহমানকে ৩৬ হাজার ভোটে পরাজিত করেন। সে সময় তিনি বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মৌলভীবাজার-৩ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) হন তিনি। এরপর ১২ জানুয়ারি তিনি মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। মুক্তিযুদ্ধ ও সমাজসেবায় অসামান্য অবদানের জন্য ভারতের আচার্য দীনেশ চন্দ্র সেন রিসার্চ সোসাইটি তাঁকে আচার্য দীনেশ চন্দ্র সেন স্মৃতি স্বর্ণপদক-২০১৪ প্রদান করে এবং হ্যালো কলকাতা নামে কলকাতা ভিত্তিক একটি সমাজকল্যাণ প্রতিষ্ঠান তাঁকে নেহেরু সাম্য সম্মাননা-২০১৪ পুরস্কারে ভূষিত করে।
সৈয়দ মহসীন আলীর শিক্ষাজীবন শুরু হয় কলকাতায়। কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল থেকে জুনিয়র কেম্রিজ ও সিনিয়র কেম্রিজ পাস করেন। পরে বাংলাদেশে এসে বাংলা মাধ্যমে কিছুদিন অধ্যয়নের পর আবারও কলকাতায় ফিরে যান এবং ম্যানেজমেন্টে ডিপ্লোমা ডিগ্রি নেন। স্বাধীনতা-উত্তরকালে তিনিই একমাত্র জননেতা যিনি পৌরসভায় পর পর তিন বার বিপুল ভোটে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৯২ সালে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় তাঁকে শ্রেষ্ঠ পৌরসভা চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত করে।