‘মার, ইনজেকশন-টিনজেকশন মার’
ঘন ঘন হেচকি দিচ্ছিল ৪০ দিন বয়সী এক শিশু। এতেই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন দরিদ্র মা। নিয়ে যান নবজাতক ও শিশু-কিশোর রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে। চিকিৎসক দেখে বুঝতে পারেন, শিশুটির অবস্থা ভালো। কিন্তু মায়ের কাছে মিথ্যা কথা বলে দাবি করেন, শিশুটির অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাঁকে দ্রুত পরিচিত অন্য চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন।
রাতে মা তাঁর আদরের শিশুটিকে নিয়ে যান পাশের জেলার হাসপাতালে। কথা বলিয়ে দেন, পরিচিত চিকিৎসকের। দুই চিকিৎসক হাসতে হাসতে মুঠোফোনে কথা বলেন। দুজনই জানান, শিশুটির অবস্থা ভালো। কিন্তু শিশুটিকে অহেতুক হাসপাতালে ভর্তি রেখে ইনজেকশন-টিনজেকশন মারার পরামর্শ দেন প্রথম চিকিৎসক।
এই দুই চিকিৎসকের মুঠোফোনের কথোপকথন ফাঁস হয়েছে। তাঁদের প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পেরে পরের দিন সকালেই হাসপাতাল ছেড়ে বাড়ি চলে যান শিশুটির মা।
ভুক্তভোগী শিশুটির নাম ইসমত নাহার জিবা। সে হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার গজনাইপুর ইউনিয়নের ফুলতলী বাজার এলাকার বাসিন্দা প্রাণ কোম্পানির শ্রমিক রুবেল মিয়া ও শিরিন আক্তারের মেয়ে। গত মাসের শেষের দিকে ৪০ দিন বয়সী ইসমত ঘনঘন হেচকি দিচ্ছিল। কোনো সমস্যা হলো কি না জানতে গত ৩১ আগস্ট সকালে ইসমতকে নিয়ে অরবিট হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. এ এইচ এম খায়রুল বাশারের কাছে যান মা শিরিন আক্তার। সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কনসালট্যান্ট নবজাতক ও শিশু-কিশোর রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. এ এইচ এম খায়রুল বাশার এক যুগ ধরে নবীগঞ্জ উপজেলার আউশকান্দি বাজারের অরবিট হাসপাতালে রোগী দেখেন।
শিশু ইসমত নাহার জিবার জন্য ডা. এ এইচ এম খায়রুল বাশারের দেওয়া ব্যবস্থাপত্র। ছবি : এনটিভি
শিরিন আক্তার জানান, ডা. বাশার ৫০০ টাকা ভিজিট রেখে কিছু ওষুধ লিখে দেন। সেই সঙ্গে পরের দিন শিশুর অবস্থা জানাতে যোগাযোগ করতে বলেন। পরের দিন ১ সেপ্টেম্বর শিশুটির অবস্থা পরিবর্তন না হওয়ায় ডা. বাশারকে ফোন করে জানানো হয়। এ সময় শিশুটির অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানান চিকিৎসক। টাকার দিকে না তাকিয়ে দ্রুত শিশুকে মৌলভীবাজারের মামুন প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি করে সেখানকার চিকিৎসক ডা. বিশ্বজিৎ দেবের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন। সেখানে গিয়ে তাঁর সঙ্গে ডা. বিশ্বজিৎকে কথা বলিয়ে দিতে বলেন।
ডা. বিশ্বজিৎ মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালের চিকিৎসক। সরকারি চিকিৎসক হওয়া সত্ত্বেও তিনিও মামুন প্রাইভেট হাসপাতালে রোগী দেখেন।
শিরিন আক্তার ১ সেপ্টেম্বর রাত ১১টার দিকে মেয়েকে নিয়ে যান মামুন হাসপাতালে। খুঁজতে থাকেন ডা. বিশ্বজিৎকে। তিনি আসার আগেই মেয়েকে হাসপাতালের ভিআইপি রুমে ভর্তি করান। রাত পৌনে ১২টার দিকে ডা. বিশ্বজিৎ হাসপাতালে গিয়ে শিশুটির পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন।
মায়ের কোলে শিশু ইসমত নাহার জিবা। ছবি : এনটিভি
রাত ১২টার দিকে ডা. বাশারের মুঠোফোনে কল দেন শিরিন আক্তার। তিনি তাঁর ফোন দিয়ে ডা. বাশারের সঙ্গে বিশ্বজিতের কথা বলিয়ে দেন। ডা. বিশ্বজিৎ ফোন নিয়ে একটু আড়ালে গিয়ে ডা. বাশারের সঙ্গে কথা বলেন। প্রায় এক মিনিট কথা বলেন দুই চিকিৎসক।
দুই চিকিৎসকের কথোপকথন এবং কথা বলা শেষে ডা. বিশ্বজিৎকে উৎফুল্ল দেখে খটকা লাগে শিরিন আক্তারের। শিরিনের মোবাইল ফোনে অটো কলরেকর্ড অ্যাপস ইনস্টল করা ছিল। তা জানতেন না ওই দুই চিকিৎসক। শিরিন কল রেকর্ড চালু করে দুই চিকিৎসকের কথা শুনে হতভম্ব হয়ে যান এবং ঘৃণায় ফেটে পড়েন। পরের দিন ২ সেপ্টেম্বর সকালে তিনি হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র নিয়ে বাসায় চলে যান। এরপর বিচারের জন্য অরবিট হাসপাতালসহ বিভিন্ন জায়গায় দৌড়ঝাপ করেন। এরপর বিষয়টি জানতে পারে নবীগঞ্জের সাংবাদিকরা।
শিরিন আক্তারের মুঠোফোনের ওই রেকর্ড এনটিভি অনলাইনের কাছে আছে। ওই রেকর্ড ইউটিউবে এনটিভি অনলাইনের অন্যতম চ্যানেল ‘এনটিভি নিউজ’-এ আপলোড করা হয়েছে। এই সংবাদের সঙ্গেও সেটি যুক্ত করা আছে। তবু পাঠকদের সুবিধার্থে পুরো কথোপকথন নিচে লিখে দেওয়া হলো :
ডা. বাশার : হ্যালো স্লামালাইকুম।
শিরিনা আক্তার : স্লামালাইকুম। স্যার, আমারে যে কইছিলা বিশ্বজিৎ স্যারের লগে কথা কওয়াইতাম, মেয়েরে পরিচয় করাইতাম।
ডা. বাশার : হুম।
শিরিনা আক্তার : মৌলভীবাজার আইছি যেন। স্যারে লগে কথা কইন।
ডা. বাশার : বিশ্বজিৎরে বলেন কল দিতে। ফোন দেন। বলেন ডা. বিশ্বজিৎরে দেখাবেন।
এইপর্যায়ে শিরিনা আক্তার তাঁর ফোন ডা. বিশ্বজিৎকে দেন। তিনি ফোন নিয়ে একটু আড়ালে গিয়ে ডা. বাশারের সঙ্গে কথা বলেন।
ডা. বিশ্বজিৎ দেব হাসতে হাসতে বলেন : দোলাভাই, শুন। তোমার রোগী খুবই ভালা আছে, কোনো সমস্যা নাই। মার (শিরিন আক্তার) সমস্যা। মা কানতে কানতে শেষ।
(ডা. বাশারের স্ত্রী ও বিশ্বজিৎ একই ব্যাচের মেডিকেল শিক্ষার্থী। বান্ধবীর জামাই হওয়ায় বাশারকে দুলাভাই বলে সম্বোধন করেন বিশ্বজিৎ)
ডা. বাশার : হুন হুন, আমি বলি। মাতিস না, মাতিস না। এইডা বেশি হাইপার সেনসিটিভ। বুঝছস? ভালা-ভুলা কওয়ার দরকার নাই। রোগী খারাপ আছে, চিকিৎসা কর। বুঝছস? ভালা জীবনেও কইছ না। ভালা জীবনেও কইছ না।
ডা. বিশ্বজিৎ : না। আচ্ছা যাই হোক অসুবিধা নাই।
ডা. বাশার : ভালা জীবনেও কইছ না। হ্যা, ভালা কইছ না। আমি তো জানি ভালা।
ডা. বিশ্বজিৎ : কই আপনি বাসাতনি?
ডা. বাশার : হ। আমি তো জানি রোগী ভালা, বুঝছত। মা হইলো হাইপার সেনসেটিভ। এই জন্য কইছি ভর্তি করান।
ডা. বিশ্বজিৎ : আইচ্ছা, না, ঠিক আছে থাকব। এখানে থাকব। অবজারভেশনে থাকব।
ডা. বাশার : দে, চিকিৎসা দে। আরে মার, ইনজেকশন-টিনজেকশন মার। নাইলে শান্তি হইতো না। ঠিক আছে। ওকে মামা।
এই বলে অট্ট হাসিতে ফেটে পড়েন ডা. বাশার। ফোনের রেকর্ডে তাঁর হাসির শব্দ শোনা যায়।
ডা. বিশ্বজিৎ : আচ্ছা। ঠিক আছে। আদাব।
ডা. বাশারও আদাব বলে আবার হাসিতে ফেটে পড়েন।
শিরিন আক্তার কান্নাজড়িত কণ্ঠে সাংবাদিকদের বলেন, ‘ডাক্তারের কাছে মানুষ যায় শান্তির জন্য। কিন্তু তিনি আমার সাথে এমন প্রতারণা করছেন যা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না। আমি গরিব মানুষ। এত টাকা ঋণ করে মেয়ে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করাই। পরে সিট কেটে বাড়ি ফিরেছি। ঘটনার পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে ঘটনাটি জানিয়েছি। হাঁটতে হাঁটতে স্যান্ডেল ছিঁড়েছি। কিন্তু বিচার পাইনি।’
এ ব্যাপারে গত শুক্রবার সকালে অরবিট হাসপাতালে গেলে সাংবাদিকদের উপস্থিতি টের পেয়ে চেম্বার রেখে সরে পড়েন ডা. এ এইচ এম খায়রুল বাশার। তিনি প্রথমে ক্যামেরার সামনে কথা বলতে রাজি হননি। পরে মোবাইল ফোনে হাসপাতালের পরিচালক ও স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মহিবুর রহমান হারুনকে আনেন। একপর্যায়ে তিনি দাবি করেন, ওই শিশুকে হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দিয়েছেন মাত্র।
অরবিট হাসপাতালের পরিচালক মহিবুর রহমান হারুন বলেন, ‘নবজাতক ও শিশু-কিশোর রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. এ এইচ এম খায়রুল বাশার প্রায় ১২ বছর ধরে অরবিটে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। গত ৩১ আগস্ট ইসমত নাহার জিবা নামের ওই শিশুকে তার মা এখানে নিয়ে এলে তাকে সিলেট পাঠানো হয়। কিন্তু তাদের আর্থিক অবস্থা ভালো না হওয়ায় তাঁরা মৌলভীবাজার নিয়ে যান।’
শিশু ইসমত নাহার জিবার জন্য মামুন প্রাইভেট হাসপাতালের ছাড়পত্র ও ডা. বিশ্বজিৎ দেবের দেওয়া ব্যবস্থাপত্র। ছবি : এনটিভি
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে ডা. বিশ্বজিৎ দেব এনটিভি অনলাইনকে বলেন, মেয়েটির মা ১ সেপ্টেম্বর রাত ১১টায় মামুন হাসপাতালে গিয়ে তাঁর সঙ্গে পরামর্শ না করেই মেয়েকে ভর্তি করে ফেলেন। তিনি খবর পেয়ে রাত পৌনে ১২টায় সেখানে যান। গিয়ে দেখেন, শিশুটির অবস্থা ভালো। তেমন কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু তার মা কাঁদতে কাঁদতে শেষ হয়ে যায় যায় অবস্থা। তিনি শিশুটির মাকে ১৫ মিনিট কাউন্সেলিং করেন যে শিশুটি ঠিক আছে। ভালো হয়ে যাবে। তাঁকে বলেছি, ভালো হলে সকালে মেয়েকে নিয়ে চলে যাবেন। এরপর ঠিকই তারা পরের দিন সকালে হাসপাতাল ছেড়ে চলে যান। ক্লিনিকের বিল দেন মাত্র দেড় হাজার টাকা।
ডা. বাশারের সঙ্গে ফাঁস হওয়া কথোপকথনটি তাঁর বলে স্বীকার করেন ডা. বিশ্বজিৎ। তিনি বলেন, ‘আমি বুঝতে পারছি না, আমার দোষ কোথায়? আমি শিশুটিকে ড্রপ দিয়েছি। কোনো অ্যান্টিবায়োটিক ও ইনজেকশন দেইনি।’
দুই চিকিৎসকের মুঠোফোনে কথোপকথনের বিষয়ে সিলেট নর্থ ইস্ট মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. কামাল আহমদ বলেন, ‘কল রেকর্ডটি শুনে খুবই খারাপ লেগেছে। একজন চিকিৎসক এ রকম মন্তব্য করতে পারেন না।’