শেষ কয়েকটি বছর বুলবুল ছিলেন ‘গৃহবন্দি’
মৃত্যুর আগে ছয় বছর ধরে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াতে পারেননি দেশের প্রখ্যাত সংগীত পরিচালক, গীতিকার, সুরকার ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। ২০১২ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে সাক্ষী দেওয়ার পর থেকেই তিনি পুলিশ পাহারায় কাটিয়েছেন। একই কারণে তাঁর ছোট ভাইকে হত্যা করা হয় বলে দাবি করেন তিনি। গত বছর জুনে তাঁর চিকিৎসাও হয় অনেকটা গোপনে।
গত ১৫ মে ২০১৮-তে নিজের গৃহবন্দি দশার কথা ফেসবুকে জানান তিনি। আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল লিখেন, ‘বন্ধুরা, সরকারের নির্দেশেই ২০১২-তে আমাকে যুদ্ধাপরাধীর ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় সাক্ষী হিসেবে দাঁড়াতে হয়েছিল। সাহসিকতার সঙ্গে সাক্ষ্যপ্রমাণ দিতে হয়েছিল ১৯৭১-এ ঘটে যাওয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলখানার গণহত্যার সম্পূর্ণ ইতিহাস। আর ওই গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া পাঁচজনের মধ্যে আমিও একজন। হত্যা করা হয়েছিল একসঙ্গে ৪৯ জন মুক্তিযোদ্ধাকে। কিন্তু এই সাক্ষীর কারণে আমার নিরপরাধ ছোট ভাই মিরাজ হত্যা হয়ে যাবে, এ আমি কখনোই বিশ্বাস করতে পারিনি। সরকারের কাছে বিচার চেয়েছি, বিচার পাইনি। আমি এখন ২৪ ঘণ্টা পুলিশ পাহারায় গৃহবন্দি থাকি একমাত্র সন্তানকে নিয়ে। এ এক অভূতপূর্ব করুণ অধ্যায়। একটি ঘরে ছয় বছর গৃহবন্দি থাকতে থাকতে আমি আজ উল্লেখযোগ্যভাবে অসুস্থ। আমার হার্টে আটটি ব্লক ধরা পড়েছে এবং বাইপাস সার্জারি ছাড়া চিকিৎসা সম্ভব নয়।’
‘এরই মধ্যে কাউকে না জানিয়ে আমি ইব্রাহিম কার্ডিয়াকে সিসিইউতে চার দিন ভর্তি ছিলাম। প্রিয় বন্ধুরা, আগামী ১০ দিনের মধ্যে আমি আমার হার্টের বাইপাস সার্জারি করাতে প্রস্তুত রয়েছি। কোনো সরকারি সাহায্য বা শিল্পী, বন্ধু-বান্ধব সাহায্য আমার দরকার নাই, আমি একাই যথেষ্ট (শুধু অপারেশনের পূর্বে ১০ সেকেন্ডের জন্য বুকের মাঝে বাংলাদেশের পতাকা এবং কোরআন শরিফ রাখতে চাই)। আর, তোমরা আমার জন্য শুধু দোয়া করবে। কোনো ভয় নাই। তোমাদের,
আ, ই, বুলবুল।’
এরপর ঢাকার একটি হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। গত বছর জুন মাসের প্রথম দিকে হৃদযন্ত্রে রিং পরানো হয়। তাঁর হৃদযন্ত্রে আটটি ব্লক ধরা পড়ে। আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের ছেলে সামির আহমেদ জানান, হৃদযন্ত্রে দুটি রিং স্থাপন করা হয়েছে। ভালো আছেন তিনি, কিন্তু কোথায় আছেন, কোন ডাক্তার দেখছেন, তা বলা নিষেধ আছে। নিরাপত্তাজনিত কারণে বিষয়গুলো প্রকাশ্যে আনা হয়নি।
গত বছর জুনের ৬ তারিখ আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন নিজের ফেসবুকে। তিনি লিখেন, ‘(মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মহানুভবতা এবং ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আজ আমি মহান আল্লাহ্র রহমতে অনেক সুস্থ এবং স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছি। এবং তাঁর সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ুর জন্য আমার আজীবন প্রার্থনা)। আমি ইচ্ছা করলেই দেশের বাহিরে গিয়ে আমার হৃদ রোগের চিকিৎসা করাতে পারতাম, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সেই সুযোগও আমাকে দিয়েছিলেন।
কিন্তু আমার দেশপ্রেম আমাকে দেশ ত্যাগ করতে দেয়নি। আমি যেভাবে চেয়েছিলাম সেভাবেই সবকিছু শুরু হয়েছিল। আমার বুকে ছিল জাতীয় পতাকা এবং পতাকার উপর ছিল পবিত্র কোরান।’
‘আমি এনআইসিভিডির সকল ডাক্তার এর সর্বাত্মক সহযোগিতা পেয়েছি। যা ভাষায় বর্ণনা করা আমার পক্ষে সম্ভব না। আমি শ্রদ্ধা ও সম্মানের সাথে তাদের নামগুলো স্মরণ করছি। বন্ধুরা,
আমার এই হৃদরোগ চিকিৎসাটি ছিল অত্যন্ত জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ, তাই আমার নিকটস্থ আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী, শিল্পী, সাংবাদিক ও অনেক কাছের শুভাকাঙ্ক্ষীদেরও কিছু বলে যাইনি। আমি অন্তর থেকে সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলাম।’
আজ মঙ্গলবার ভোরে রাজধানীর আফতাবনগরের নিজ বাসায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর। প্রখ্যাত এই সংগীত পরিচালক ১৯৫৬ সালের ১ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন তিনি। ১৯৭০ দশকের শেষলগ্ন থেকে আমৃত্যু বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পসহ সংগীতশিল্পে সক্রিয় ছিলেন।
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল ১৯৭৮ সালে ‘মেঘ বিজলী বাদল’ ছবিতে সংগীত পরিচালনার মাধ্যমে চলচ্চিত্রে কাজ শুরু করেন। অসংখ্য চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা করেছেন। তিনি রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মান একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং রাষ্ট্রপতির পুরস্কারসহ অন্যান্য অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হন।
তাঁর সুরের উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে রয়েছে ‘সেই রেললাইনের ধারে’, ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না’, ‘সুন্দর সুবর্ণ তারণ্য লাবণ্য’, ‘আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন’, ‘আম্মাজান আম্মাজান’, ‘পড়ে না চোখের পলক’, ‘ও মাঝি নাও ছাইড়া দে ও মাঝি পাল উড়াইয়া দে’ ও ‘এই বুকে বইছে যমুনা’ ইত্যাদি।