ধর্মের কথা বলে আমানত নিত আরডিপি
নরসিংদীর দুই সহস্রাধিক গ্রাহকের প্রায় ১০ কোটি টাকা নিয়ে উধাও হয়ে গেছে অর্থ লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান ‘আরডিপি ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট’। প্রতারণার শিকার গ্রাহকদের অভিযোগ, কর্মকর্তারা প্রতিষ্ঠানটি শরিয়াহ মোতাবেক চলে এবং ধর্মের কথা বলে মানুষের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করত।
২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে নরসিংদী শহরের রাঙ্গামাটি এলাকার কাজী মার্কেটের তৃতীয় তলায় ভাড়া নিয়ে আমানত সংগ্রহ শুরু করে। পরে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম মনোহরদী, রায়পুরা ও মাধবদী শুরু হয়। কিন্তু পাঁচ মাস আগে কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে তারা পালিয়ে যায়। বিপদে পড়েন আমানতকারীরা।
এ ঘটনার পর থানায় অভিযোগ করা হয়। কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো মামলা হয়নি। গ্রাহকরাই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে কাজী আবদুল হামিদ নামে এক ব্যক্তিকে আটক করে পুলিশে দেয়। গ্রাহকদের অভিযোগ, রহস্যজনক কারণে পুলিশ তাঁকে ছেড়ে দেয় এবং গ্রাহকদের টাকা উদ্ধারের জন্য তৈরি করা কমিটিতে হামিদকে আহ্বায়ক করা হয়।
নানা দেন-দরবার করেও গ্রাহকরা তাঁদের আমানত পাননি। সর্বশেষ আরডিপি কর্তৃপক্ষ চলতি সপ্তাহে জমি বিক্রি করে গ্রাহকদের টাকা পরিশোধের কথা থাকলেও ব্যর্থ হয়।
কাজী আবদুল হামিদ দাবি করেছেন, তিনি নিজেও প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে প্রতারণার শিকার হয়েছেন।
এর মধ্যেই আজ শুক্রবার সকালে গ্রাহকরা প্রতিষ্ঠানটির নরসিংদীর শাখা ব্যবস্থাপক হাবিবুর রহমানকে (৩৫) পেয়ে শহরের রাঙ্গামাটি এলাকায় একটি বাড়িতে আটক করে রাখেন। এ খবর পেয়ে প্রতারণার শিকার অনেক গ্রাহক সেখানে এসে জড়ো হন। তবে তাঁরা হাবিবুরকে পুলিশে হস্তান্তর করেননি। সামাজিকভাবে বিচার করে টাকা আদায় করা হবে বলে জানিয়েছেন বিক্ষুব্ধ গ্রাহকরা।
এ ব্যাপারে নরসিংদী সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল কাশেম বলেন, বেশ কিছুদিন ধরে আরডিপির টাকা নিয়ে জটিলতা চলছে। বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা চলছে। তবে ব্যবস্থাপক আটকের খবর তিনি পাননি বলে জানান।
জেলা সমবায় কর্মকর্তা আশরাফুল ইসলাম বলেন, আরডিপি নরসিংদীতে নিবন্ধিত নয়। তাই আইনি জটিলতার কারণে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
সদর উপজেলার চিনিশপুর আবু বক্কর ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘কাজী মার্কেটের মালিকের ছোট ভাই কাজী আবদুল হামিদ আরডিপির উপদেষ্টা ছিল। উনি বলেছিলেন, প্রতিষ্ঠানটি শরিয়াহ মোতাবেক পরিচালিত, সব কর্মকর্তা-কর্মচারী ধার্মিক। তাই ওনার পরামর্শে চলতি বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি ছেলেমেয়েদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য তিন লাখ টাকা জমা রেখেছিলাম। কিন্তু তিন মাসের ব্যবধানেই প্রতিষ্ঠানটি টাকা-পয়সা নিয়ে উধাও হয়ে যায়।’
আমিনুল ইসলাম জানান, ‘যারা ধর্মের নাম ব্যবহার করে আমাদের হয়রানিতে ফেলেছে, আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দিয়েছে আমরা তাদের বিচার ও আমাদের টাকা ফেরত চাই।’
প্রতিষ্ঠানটির সাবেক চেয়ারম্যান ইব্রাহিম খলিল নারায়ণগঞ্জের জেলা শিবিরের সাবেক সভাপতি। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অধিকাংশই জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলেও দাবি করেন মাদ্রাসাশিক্ষক আমিনুল।
শহরের গাবতলী এলাকার গৃহবধূ শাহিনা আক্তার ২০১২ সালে আরডিপিতে প্রথমে দুই লাখ টাকা জমা রাখেন। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ধাপে তিনি নিজে ৩০ লাখ টাকা ও আত্মীয়-স্বজন, ঘনিষ্ঠদের দিয়ে ৫৬ লাখ টাকা আরডিপিতে জমা রেখেছেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহকদের টাকা পরিশোধ না করে হঠাৎ করে কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়ায় বিপাকে পড়েছেন দুবাইপ্রবাসীর এই স্ত্রী।
শাহিনা আক্তার কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘অধিক মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গ্রাহকদের কাছ থেকে মাসিক, দৈনিক ও মেয়াদি আমানত সংগ্রহ করে। তারা একের পর এক প্যাকেজ দিয়ে আমাদের মাথা নষ্ট করে টাকাগুলো নিছে। তারা টাকা লুটে চলে গেছে কিন্তু আমার বাড়িতে থাকার অবস্থা নেই।’
শাহিনা আরো জানান, সদর উপজেলার বাদুয়ারচর গ্রামের ডালিম মিয়া ৪৫ লাখ, কাজী মোশাররফ হোসেন ১৬ লাখ, কাজী আবদুর রহমান ছয় লাখ ও নাজমা বেগম আট লাখ টাকা আরডিপিতে রেখেছিলেন। তারাও প্রতারণা শিকার হয়েছেন।
জনতার হাতে আটক আরডিপি কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, দেশের বিভিন্ন স্থানে থাকা জমি বিক্রি করে গ্রাহকদের টাকা পরিশোধ করা হবে।’
তবে এ ব্যাপারে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কাউকে পাওয়া যায়নি।