শুঁটকি মৌসুমে সাগরে যেতে পারছে না জেলে, অপেক্ষায় শত শত ট্রলার
শুঁটকি মৌসুম শুরু হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কাজ শুরু করতে পারেনি সুন্দরবন সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরপারের জেলেরা। বনবিভাগের একাধিক বিধিনিষেধের কারণে বিপাকে পড়েছে ৫০ হাজারেরও বেশি জেলে, মহাজন ও তাঁদের পরিবার। মাছ ধরতে যাওয়ার অনুমতির জন্য মংলায় অবস্থান করছে শত শত নৌকা ও ট্রলার। বন কর্মকর্তরা বলছেন, বিষয়টি ঊর্ধ্বতন মহলের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছে।
দুবলার চরে অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই পাঁচ মাস ধরে চলে সাগর থেকে মাছ আহরণ এবং শুঁটকি তৈরির কাজ। মৌসুমের শুরুতেই জেলেরা সেখানে অস্থায়ী বসতি গড়ে তোলে। তৈরি করে মাছ শুকানোর মাচা। শুঁটকি মৌসুমকে ঘিরে চরে জড়ো হয় বহু জেলে ও মহাজন। দুবলার চর, মেহের আলী, আলোরকোলসহ বিভিন্ন চরে মৌসুম জুড়ে থাকে ব্যস্ততা।
কিন্তু এবারের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। মৌসুম শুরুর পর প্রায় এক মাসের বেশি সময় চলে গেলেও এখনো দুবলার চরে যেতে পারেননি জেলেরা।
মংলার পশুর নদের চিলা, বিদ্যারবাহন, লাউডোব ও বানীশান্তাসহ বিভিন্ন এলাকায় অপেক্ষা করছে কয়েকশত জেলে নৌকা ও ট্রলার। জেলেরা ‘পাস’ না পেয়ে চরম দুশ্চিন্তার মধ্যে আছেন। চড়া সুদে ঋণ নিয়ে প্রতি বছর শুঁটকি মৌসুমে জেলেরা সাগরে যায়। মূলত এই শুঁটকির মৌসুমের রোজগার দিয়েই চলে তাঁদের পুরো বছর। কিন্তু এখনো সাগরে যেতে না পারায় প্রতিদিন লোকসান গুনতে হচ্ছে জেলে ও মহাজনদের।
স্থানীয় জেলে ও মহাজন মায়িন ফরাজি, আক্কেল শেখ, শহিদ মল্লিক জানান, বন বিভাগের আগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সুন্দরবনের পশুর ও শিবসা নদী দিয়ে সব ধরনের ইঞ্জিনচালিত নৌকা ও ট্রলার চলাচল বন্ধ থাকায় সাগরে যেতে পারছেন না তাঁরা।
দুবলাগামী জেলে জিন্নাত শেখ, খানজাহান আলী, ডেবিড মাঝি, আন্তন মাঝি জানান, প্রতি বছর বনবিভাগের নিয়মকানুন মেনেই সাগর থেকে মাছ আহরণ ও সাগরপারের সুন্দরবনের দুবলার চরে শুঁটকি তৈরি করেন তাঁরা। এবারও তাঁরা বনবিভাগের সব নিয়ম মেনেই শুঁটকি তৈরি করবেন। বন থেকে কোনো গাছ, পাতা কাটবেন না বলেই সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন সবধরনের কাঠ। এমনিতেই মৌসুম শুরুর পর প্রায় এক মাস অতিবাহিত হয়ে গেছে। এখন তাঁদের যাওয়ার অনুমতি দেওয়া না হলে তাঁদের পথে বসতে হবে, ধারদেনা করায় বাড়ি ফেরারও সুযোগ নেই জেলেদের।
সাগরে যাওয়ার অনুমতির বিষয়ে পূর্ব সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘বিষয়টি ঊর্ধ্বতন মহলের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে। সিদ্ধান্ত হলেই তাঁদের যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হবে। যেহেতু আগে থেকেই পশুর ও শিবসা নদী দিয়ে চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আছে সে ক্ষেত্রে জেলেরা সাগরে যেতে চাইলে তাঁরা বলেশ্বর হয়ে যেতে পারে। এতে সাগরে গিয়ে মাছ ধরতে পারবে কিন্তু চরে উঠে বসতি নির্মাণ ও শুঁটকি তৈরি করতে পারবে না। ঊর্ধ্বতন মহল সিদ্ধান্ত দিলে জেলেরা বসতি নির্মাণ ও শুঁটকি তৈরি করতে পারবে। সে পর্যন্ত উপরের মহলের সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করতে হবে।’
তবে মংলার চিলার স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য হালিম হাওলাদার বলেন, ‘জেলেরা চরে গিয়ে সুন্দরবনের বিপুল পরিমাণ গাছ কেটে নৌকার নোঙ্গর, ঘর ও মাচা তৈরি করে।’ তাই সুন্দরবন সুরক্ষায় কোনো ধরনের পাস না দেওয়াই ভালো বলে তিনি মনে করেন।
এ বিষয়ে দুবলা ফিসারম্যান গ্রুপের চেয়ারম্যান মেজর (অব.) জিয়া উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘প্রশাসনিক জটিলতার কারণে মহাদুর্ভোগে পড়েছে জেলেরা। দুবলায় যাওয়া জেলেরা চরে উঠতে না পেরে সাগরে নৌকায় ভাসছে, যা অমানবিক।’ তিনি আরো বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী সুন্দরবন সুরক্ষার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাঁর এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে জেলেরা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করবেন। জেলেরা সুন্দরবনের মধ্যে অবস্থান করবেন না, মাছ ধরবেন না, বনের কোনো ক্ষতি করবেন না। এ ছাড়া দেশীয় জেলেরা সাগরে যেতে না পারায় ভারত, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের জেলেরা সমুদ্রের মৎস্য সম্পদ লুটে নিচ্ছে।’ দেশীয় সম্পদ রক্ষায় যত দ্রুত সম্ভব সমস্যা নিরসন করে জেলেদের সাগরে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া দরকার বলেও তিনি জানান।