‘রবিনহুডে’র রাজ্যে ওরা নিরাপদ
রাজধানীর খিলগাঁও এলাকার তিলপাপাড়া জামে মসজিদের পাশেই একটি চারতলা বাড়ি। সিঁড়ি বেয়ে বাড়ির ছাদে উঠতেই চমকে যাওয়ার মতো অবস্থা! এটা তো কুকুর-বিড়ালের রাজ্য! শুরুতে ভড়কে গেলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘোর কেটে যাবে। অসংখ্য কুকুর-বিড়াল নিজেদের ভাষায় অভ্যর্থনা জানাবে আপনাকে। কাছে যেতেই শরীর বেয়ে কোলে উঠতে চাইবে। যেন কতকাল তারা আপনার অপেক্ষাতেই ছিল, একটু আদর পাওয়ার জন্য। আপনিও চুপ হয়ে থাকতে পারবেন না। ছুটে যেতে ইচ্ছে করবে তাদের কাছে। মনে হবে এখানেই থেকে যাই!
একটা নিরাপদ আশ্রয়
চারকোনা ছাদের খোলা আকাশ, ছাউনি আর দুটি কক্ষের আনাচে কানাচে এই কুকুর-বিড়ালদের বসবাস। যত্নের কমতি নেই, নেই খাবারের অভাব। দৌড়াদৌড়ি আর ডাকাডাকিতে যেন মেতে উঠেছে পুরো ছাদ। সবারই আছে আলাদা আলাদা নাম। লায়ন, মায়া, জয়, ব্ল্যাকি আরো কত কী! নাম ধরে ডাকলেই ওরা সাড়া দেয়। এখন পর্যন্ত ৫৯টি কুকুর-বিড়াল রয়েছে ওই বাড়িতে।
এদের কারো পা নেই, কেউ বা অন্ধ, আবার কেউ বা ধুঁকছে জটিল অসুখে। এ ছাড়া সইতে হয়েছে মানুষের নির্মমতা। খেলার ছলে অনেকেই দিয়েছে কষ্ট, করেছে নির্যাতন। অনেকে আবার শখের বসে বিদেশি কুকুর-বিড়াল কেনার পর দায়িত্ব নিতে পারেনি বলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত এ অসহায় অবুঝ কুকুর-বিড়ালদের ঠাঁই হয়েছে এই ছাদে। আর তাদের পরম মমতায় আগলে রেখেছেন আফজাল খান নামের এক যুবক।
‘রবিনহুড দি অ্যানিমেল রেসকিউয়ার’ সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা আফজাল খান। প্রাণীদের ভালোবেসে ২০ জন স্বেচ্ছাসেবী কাজ করছেন তাঁর সঙ্গে।
‘অনুভূতি দিয়ে ওরা ভালোবাসা প্রকাশ করে’
কথা বলতে বলতে একটি বিড়াল নিয়ে আসেন আফজাল। জানালেন, বিড়ালটি পক্ষাঘাতগ্রস্ত। নিজে নিজে পায়খানা-প্রস্রাব করতে পারে না। আফজাল একটা উঁচু জায়গায় বসলেন। বিড়ালটাকে কোলে নিয়ে পেটের নিচে চাপ দিলেন। বিড়ালটা মলত্যাগ করল। মাথাটা পরম মমতায় হেলে রাখল আফজালের কনুইয়ে। আফজাল নিজেই তা পরিষ্কার করলেন। পরম যত্নে বিড়ালটাকে শুইয়ে দিলেন ওর জায়গায়।
একবার হঠাৎ করে ‘জয়’, ‘জয়’ নামে ডাকলেন। ভেতর থেকে একটা কুকুর ধীর পায়ে বের হয়ে এলো। আফজাল জানালেন কুকুরটা অন্ধ, চোখে দেখে না। ওর দাঁতও নেই। কেউ মেরে দাঁতও ভেঙে দিয়েছে। কুকুরটাকে গোসল করানো হলো।
আফজালের একটা ‘লায়ন’ আছে। লায়ন নামের ওই কুকুরটা হাঁটতে পারে না। ওর ওপর দিয়ে গাড়ি চলে যায়। পেছনের দুটো পা একেবারেই অকেজো। লায়নের জন্য একটা ‘ওয়াকিং হুইল’-এর ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেটা পেলে সারাক্ষণ দৌড়াদৌড়ি করে সে।
আফজাল বলেন, ‘ওদেরও অনুভূতি আছে, ওরা হয়তো কথা বলতে পারে না। কিন্তু ওরা ওদের অনুভূতি দিয়ে ভালোবাসাটা প্রকাশ করে।’
বিড়ালের কান্না শুনেই…
আফজালের শুরুটা ২০১০ সালের দিকে। রাতে গাড়িতে করে বাসায় ফিরছিলেন। বৃষ্টি হচ্ছিল। রাস্তায় বিড়ালের কান্নার শব্দ শুনতে পান তিনি। তিনি বলেন, ‘বুঝতে পারছিলাম না, এত বৃষ্টির মধ্যে এই বিড়ালের কান্নার শব্দটা কোথা থেকে আসছে। তখন আমি গাড়ি থেকে নেমে দেখতে পাই, কেউ একজন পলিথিনে করে একটি বিড়ালের বাচ্চাকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে চলে যায়। আমার কাছে খুব খারাপ লাগে বিষয়টা। তখন থেকেই তাদের প্রতি একটা অনুভূতি জন্মায়।’
তিনি রবিনহুড
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রাণীদের উদ্ধারকাজে বের হন আফজাল। কোনো প্রাণী যদি ভবনের কার্নিশ বা পাইপের ভেতরে আটকা পড়ে যায়, কেউ যখন তাদের উদ্ধার করতে পারে না, তখন একমাত্র ভরসা আফজাল। এখন পর্যন্ত প্রায় ৬০০টির মতো প্রাণীকে উদ্ধার করেছেন তিনি। এ জন্য তাঁকে ডাকা হয় রবিনহুড নামেও।
আফজাল বলেন, ‘অনেকে খরগোশ, বিড়াল, কুকুর বা পাখি পোষে। প্রাণীগুলো খেলতে খেলতে জানালা দিয়ে কার্নিশে পড়ে যায় বা ভবনের ওপর আটকে থাকে। প্রাণীদের উদ্ধার করা একটু কঠিন হয়। কারণ মানুষকে উদ্ধারের সময় বিপদগ্রস্ত মানুষ কো-অপারেশন করে। কিন্তু প্রাণী সেটা বোঝে না। তারা অনেক ভয়ে থাকে। আক্রমণাত্বক হয়ে যায়। তখন তা প্রাণী ও মানুষ উভয়ের জন্য বিপজ্জনক। এমনও দিন গেছে, একটি বিড়াল ৩৫ দিন আটকে ছিল, ওকে কার্নিশে খাবার ছিটিয়ে দিত আশপাশের লোকজন। পরে আমাদের জানানো হলো। আমরা তাকে উদ্ধার করি। এই লাইফ রিস্কটাই আমি নিয়ে আসছি। এ কারণেই আমাকে রবিনহুড বলা হয়।’
‘রবিনহুড দি অ্যানিমেল রেসকিউয়ার’ নামের একটি ফেসবুক গ্রুপ আছে আফজালের সংগঠনের। উদ্ধার নিয়ে কেউ কিছু জানতে চাইলে তথ্য দেন। কেউ কোনো প্রাণীকে উদ্ধারের জন্য সহযোগিতা চাইলে আফজাল ওই ভবনের ভিডিও পাঠানোর অনুরোধ করেন। ওই ভিডিও দেখে প্রস্তুতি নিয়ে বের হন তিনি।
রাজারবাগ পুলিশলাইনসের একটি ভবনের উঁচুতলায় একটি কুকুর আটকা পড়ে। কোনোভাবেই কুকুরটিকে উদ্ধার করা যাচ্ছিল না। খবর পেয়ে যান আফজাল। পুলিশ সদস্যরা তাঁকে দেখে অবাকই হন। এই ছেলে উদ্ধার করবে কুকুরটাকে? আফজাল নিজের লোকজন নিয়ে কুকুরটিকে উদ্ধার করেন। তিনি বলেন, ‘আমার ৪২ মিনিটের মতো সময় লেগেছিল।’
‘একটি হাসপাতাল দিতে চাই’
আফজালের সঙ্গে এখন কাজ করেন প্রায় ২০ জন স্বেচ্ছাসেবী। ভালোবেসেই কাজটা করেন তাঁরা। আফজাল জানালেন, নিজেদের টাকা খরচ করে উদ্ধারে যান তাঁরা। এরপর বেতন দিয়ে লোক রাখা বেশ কঠিনই। কিন্তু এখানেই থেমে যেতে চান না তিনি।
আফজাল বলেন, ‘আমরা একটি হাসপাতাল দিতে চাই।’ কোনো প্রাণী আহত হলে ভর্তি হবে ওই হাসপাতালে। যত্ন করা হবে। পাশাপাশি একটা ফস্টার হোমও করার ইচ্ছে তাঁর। কোনো প্রাণী অসহায়ভাবে মারা যাবে, সেটা হতে দেওয়া যায় না।
আফজাল আরো বলেন, ‘প্রাণীদের উদ্ধারের জন্যও আমরা একটি ট্রেনিং সেন্টার দিতে চাই।’
এলাকায় সমস্যা করবে না কুকুর
পাড়ায় কুকুররা চিৎকার করে। দলবেঁধে দৌড়াদৌড়ি করে। এটা অনেকেরই অপছন্দ। এ কারণে অনেকে কুকুর নিধনের পক্ষেও বলেন। আফজাল জানান, খাবার পায় না বলেই কুকুরগুলো এমন করে। অথচ ওদের এক বেলা খাবারের ব্যবস্থা করাটা খুবই সহজ।
আফজাল বলেন, ‘সরকার এখন অনেক সচেতন। ময়লা নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ডাস্টবিন থেকে। রাস্তার কুকুরদের খাবারের উৎস থাকছে না। ওরা খাবার খেতে পারে না, ওরা পানি পায় না; তাই চিৎকার করে। এক এলাকার কুকুর আরেক এলাকায় যায়। তখন দেখা যায়, আরো ভায়োলেশন তৈরি হয়। ওদের মধ্যে মারামারি হয়। তখন অনেক মানুষ বিরক্ত হয়ে ওদের আঘাত করে।’
আফজাল বলেন, ‘যদি আমরা আর্থিক সহযোগিতা পাই, ঢাকা শহরের যত ওয়ার্ড আছে, সব ওয়ার্ডে একটি করে ভ্যান দিতে চাই। প্রতি এলাকার ২০টি বাসা থেকে এক বেলা খাবার ওই ভ্যানে দেওয়া হবে। এসব খাবার একটি নির্দিষ্ট জায়গায় রাখা হবে। কুকুরেরা এসে খাবে। বিশ্বাস করেন খাবার পেলে ওরা কোনো সমস্যার কারণ হবে না।’
অনেকেই মনে করে, কুকুর-বিড়াল মানেই জলাতঙ্ক হবে। ওরা আঁচড় দিলে, কামড় দিলে সমস্যা হবে। আফজাল বলেন, ‘এটা একদমই ভুল একটা কথা। আমরা সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পেইন করতে চাই। এমনটি হলে তো আমি বহু আগেই মরে যেতাম, আমি নয় বছর ধরে এদের নিয়ে কাজ করছি। অজস্র আঁচড়-কামড় আমার গায়ে আছে, আমার ছোট বোনের গায়ে আছে, আমার ভলান্টিয়ারদের গায়ে আছে। জলাতঙ্ক অবশ্যই হয়, যদি সেই প্রাণীটার কোনো র্যাবিস বা জলাতঙ্কের টিকা না থাকে। আর যাদের জলাতঙ্ক আছে, তারা মূলত চলাচল করতে পারে না, খেতে পারে না, মুখ দিয়ে ফেনা বের হয়। শহরে এ ধরনের কুকুর তেমন দেখা যায় না। যদি কুকুর-বিড়াল রাস্তায় আপনাকে কামড় দেয়, আপনি অ্যান্টিসেপটিক বা বাংলা সাবান দিয়ে জায়গাটা ধুয়ে ফেলতে পারেন।’
খাবারের পাশাপাশি চিকিৎসাও চলে
আফজালের ওই আশ্রয়ে মোট ৫৯টি কুকুর-বিড়াল আছে। প্রতিদিন আট কেজি মাংস প্রয়োজন। প্রতি মাসে লাগে ২৪০ কেজি। এদের জন্য চাল লাগে ১৩০ কেজি।
আফজাল বলেন, ‘অসুস্থ কুকুর-বিড়ালের চিকিৎসাও চলে। এদের জন্য প্রতিদিন ওষুধও লাগে। একেকটি জন্য আলাদা আলাদা ওষুধ। এ জন্য আমাদের প্রচুর খরচ হয়। আমাদের নিজস্ব কোনো ক্লিনিক নেই, তবে আমরা তা করতে চাচ্ছি, সহযোগিতা পেলে আমরা করব।’
আফজাল বলেন, ‘আমি কখনোই এদের ব্রিডিংয়ের পক্ষে নই। আমি নিজেও বিদেশি কুকুর-বিড়াল থাকলেও ব্রিডিং করাই না। অনেকে বিদেশি প্রাণীদের ব্যবহার করে বাচ্চা জন্ম দেওয়ায়, পরে বিক্রি করে দেয় ওই বাচ্চাকে। তো এটা আমার কাছে অমানবিক বলে মনে হয়। মানুষ এখনো এদের পণ্য হিসেবে ব্যবহার করে। অনেকে নিজের শখের জন্য এদের পালে। কিন্তু পালার পর, দায়িত্ব নিতে না পেরে এদের বিক্রি করে দেয়, অথবা রাস্তায় ফেলে দেয়।’
আফজালের বড় শক্তি হলো, তাঁর ছোট বোন তাইয়্যেবা নাসরিন রাকা সব সময় রয়েছেন তাঁর পাশে। দেখা গেছে, নিজ হাতেই আফজালের ছোট বোন কুকুর-বিড়ালকে খাওয়াচ্ছেন, আদর করছেন। আর এই অসহায় প্রাণীগুলোও যেন অনেক স্বস্তিতে হাসি আর খেলাধুলায় মেতে উঠেছে। তাঁদের আর কোনো ভয় নেই। কারণ তারা পাশে পেয়েছে এক রবিনহুড।