কাল আখেরি মোনাজাত, আরো ২ মুসল্লির মৃত্যু
কাল রোববার আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে ৫১তম বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব। রোববার সকাল ১০টা থেকে সাড়ে ১১টার মধ্যে এই মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে বলে ইজতেমা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।
মোনাজাতের আগে অনুষ্ঠিত হবে হেদায়েতি বয়ান। তাবলিগ জামাতের শীর্ষস্থানীয় মুরুব্বিদের পরামর্শের ভিত্তিতে বিশ্ব তাবলিগ জামাতের শীর্ষ মুরুব্বি ভারতের দিল্লির হজরত মাওলানা সা’দ আহমেদ আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। মোনাজাতে বাংলাদেশসহ সারা দুনিয়ার মানুষের সুখ, শান্তি ও কল্যাণ কামনা করে দোয়া করা হবে।
বিদেশি নিবাসের পূর্বপাশে বিশেষ মোনাজাত মঞ্চ থেকেই রোববার শুরু হবে আখেরি মোনাজাত। আখেরি মোনাজাতে ২০-২৫ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসল্লি অংশ নেবেন বলে আয়োজকদের ধারণা।
দ্বিতীয় পর্বের দ্বিতীয় দিনে আজ শনিবার তুরাগতীরে টঙ্গীর ইজতেমা মাঠে বয়ান করেন তাবলিগ জামাতের শীর্ষস্থানীয় মুরুব্বিরা। বয়ান শুনতে ও আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে আজ সকালেই টঙ্গী ও এর আশপাশের এলাকা জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে। টঙ্গীর তুরাগতীরে বিশ্ব ইজতেমায় আসা লাখ লাখ মুসল্লির পদভারে মুখর হয়ে উঠেছে। শনিবারও টঙ্গী অভিমুখী বাস, ট্রাক, ট্রেন, লঞ্চসহ বিভিন্ন যানবাহনে ছিল মানুষের ভিড়। রোববার আখেরি মোনাজাতের আগ পর্যন্ত মানুষের এ ঢল অব্যাহত থাকবে।
এদিকে আখেরি মোনাজাত উপলক্ষে মুসল্লিদের সুবিধার্থে শনিবার দিবাগত রাত থেকে টঙ্গী ও এর আশপাশের এলাকায় যানবাহন চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে পুলিশ। রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত এ বিধিনিষেধ বলবৎ থাকবে।
দ্বিতীয় দিন শনিবার যাঁরা বয়ান করলেন : আজ ফজরের নামাজের পর থেকে বয়ান করেছেন ভারতের মাওলানা মো. খোরশেদ আলম। এ সময় বাংলায় তরজমা করেন বাংলাদেশের মাওলানা মো. জাকির হোসাইন। পাশাপাশি ইংরেজি, উর্দুসহ বিভিন্ন ভাষায় তা তরজমা করা হয়। এ ছাড়া বাদ জোহর ভারতের মাওলানা মো. ফারুক হোসেন, বাদ আসর ভারতের মাওলানা মো. ইউসুফ ও বাদ মাগরিব ভারতের মাওলানা মো. শওকত আলী বয়ান করেছেন বলে জানান তাবলিগ জামাতের বাংলাদেশের অন্যতম মুরুব্বি প্রকৌশলী মো. গিয়াস উদ্দিন।
যা বয়ান করলেন : বয়ানে তাবলিগের মুরুব্বিরা বলেন, আল্লাহতায়ালা আপনাকে-আমাকে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন এবং আল্লাহতায়ালা এটা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, দুনিয়াতে যে একবার আসবে তাকে মৃত্যুবরণ করতে হবে। আল্লাহ পাকের এ সিদ্ধান্তের কোনো পরিবর্তন হবে না। দুনিয়া হচ্ছে ধোঁকার ঘর, এ দুনিয়া হচ্ছে ধোঁকার জীবন। মিছে এই দুনিয়ার আরাম আয়েসের কথা ভুলে গিয়ে আখেরাতের কথা চিন্তা করতে হবে। দুনিয়ার জিন্দেগি ক্ষণস্থায়ী, যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষের দিল থেকে আসবাবের (সম্পদের) এক্বিন বের না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তার দিলে কুদরতি এক্বিন পয়দা হবে না। সবাইকে দ্বীনের জন্য মেহনত করতে হবে। আল্লাহর কাছে আমল ছাড়া এ দুনিয়ার জিন্দেগির কোনো মূল্য নেই।
বয়ানে আরো বলা হয়, দ্বীনের দাওয়াতের মাধ্যমে ইমান মজবুত হয়। ইমান মজবুত হলে আল্লাহর সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আর এ সম্পর্ক গড়ে উঠলে দুনিয়া ও আখেরাতে কামিয়াবি হাসিল হয়।
তাশকিলের কামরায় চিল্লাভুক্ত মুসল্লি : ইজতেমার প্যান্ডেলের উত্তর-পশ্চিমে তাশকিলের কামরা স্থাপন করা হয়েছে। বিভিন্ন খিত্তা থেকে বিভিন্ন মেয়াদে চিল্লায় অংশ গ্রহণেচ্ছু মুসল্লিদের এ কামরায় আনা হচ্ছে এবং তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে। পরে কাকরাইল মসজিদের তাবলিগের মুরুব্বিদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এলাকা ভাগ করে তাঁদের দেশের বিভিন্ন এলাকায় তাবলিগ জামাতে পাঠনো হবে।
বিদেশিসহ আরো মুসল্লির মৃত্যু : বিশ্ব ইজতেমায় দ্বিতীয় পর্বে যোগ দিতে আসা মালয়েশিয়ার এক নাগরিকসহ আরো দুই মুসল্লি শনিবার সকাল পর্যন্ত ইন্তেকাল করেছেন। এ নিয়ে এবারের ইজতেমার দুই পর্বে এ পর্যন্ত মোট ১২ মুসল্লি মারা গেছেন।
ইজতেমার পুলিশ নিয়ন্ত্রণ কক্ষ সূত্র জানায়, শুক্রবার সকালে মালয়েশিয়ার নাগরিক শাহিদান ইব্রাহিম (৪৮) বিদেশি নিবাসে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে টঙ্গী সরকারি হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখান থেকে তাঁকে ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নেওয়ার পথে তিনি মারা যান। ইজতেমা ময়দানে তাঁর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। তাঁর মরদেহ নিজ দেশে পাঠানোর জন্য মালয়েশিয়ান দূতাবাসে পাঠানো হবে বলে পুলিশ জানিয়েছে।
এদিকে, শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে ইজতেমার ময়দানে বার্ধক্যজনিত কারণে আবুল কাশেম (৬৫) মারা যান। তিনি জামালপুর সদর উপজেলার কাচারিপাড়া এলাকার বাসিন্দা।
জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত : ইজতেমাস্থলের আশপাশে বিভিন্ন খাবার দোকান ও হোটেলে শুক্রবার থেকে শনিবার দুপুর পর্যন্ত জেলা প্রশাসনের একাধিক ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়ে ভেজাল খাবার পরিবেশন ও বিক্রির দায়ে বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশ ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে মোট এক লাখ ৯৬ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করেন। ইজতেমাস্থলের আশপাশে পাঁচটি করে দুই শিফটে গাজীপুর জেলা প্রশাসনের মোট ১০টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হয়। গাজীপুরের ১৪ জনসহ বিভিন্ন জেলার মোট ২৪ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ওই সব আদালত পরিচালনা করছেন।
বিদেশি মুসল্লি : পুলিশ নিয়ন্ত্রণ কক্ষ সূত্র জানায়, ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বে শনিবার পর্যন্ত জর্ডান, লিবিয়া, আফ্রিকা, লেবানন, আফগানিস্তান, ফিলিস্তিন, আমেরিকা, তুরস্ক, ইরাক, সৌদি আরব, ভারত, পাকিস্তান, ইংল্যান্ডসহ বিশ্বের ৯৬টি দেশের ছয় হাজার ৫১৮ জন মুসল্লি ইজতেমায় অংশ নিয়েছেন। বিভিন্ন ভাষাভাষী ও মহাদেশ অনুসারে ইজতেমা ময়দানে বিদেশি মেহমানদের জন্য মোট তিনটি টেন্ট নির্মাণ করা হয়েছে।
এদিকে বিদেশি তাঁবুতে রান্নার জামাতের জিম্মাদার মো. নূরুল ইসলাম জানান, মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্র ও ধর্মমন্ত্রীসহ ২২ জনের মালয়েশিয়ার দল টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমায় যোগ দিয়েছেন। বৃহস্পতিবার রাতে তাঁরা ইজতেমা ময়দানে মালয়েশিয়ান তাঁবুতে অবস্থান নেন।
তবে গাজীপুরের পুলিশ বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারেনি।
বিশেষ ট্রেন : এবারের ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বের আখেরি মোনাজাত উপলক্ষে বাংলাদেশ রেলওয়ের পক্ষ থেকে আখাউড়া, কুমিল্লা, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন রুটে ২৯টি বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ইজতেমা উপলক্ষে এসব ট্রেনে অতিরিক্ত বগি যুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া আখেরি মোনাজাতের আগে ও পরে সব ট্রেন টঙ্গী স্টেশনে যাত্রাবিরতি করবে।
টঙ্গী রেলওয়ে জংশন সূত্রে জানা গেছে, দ্বিতীয় পর্বের ১৫ জানুয়ারি থেকে ১৭ জানুয়ারি আখেরি মোনাজাত পর্যন্ত টঙ্গী থেকে জামালপুর, আখাউড়া, লাকসাম রুটে কয়েকটি বিশেষ ট্রেন চলবে। রোববার আখেরি মোনাজাতের দিন টঙ্গী থেকে ঢাকা, লাকসাম, আখাউড়া, ময়মনসিংহ এবং ঈশ্বরদী পথে একাধিক বিশেষ ট্রেন যাতায়াত করবে। আখেরি মোনাজাতের পরের দিন টিকেটধারী মুসল্লিরা যাতে উঠতে পারেন সে জন্য সব ট্রেন টঙ্গী স্টেশনে যাত্রাবিরতি দেবে। এ ছাড়া ইজতেমায় আসা যাত্রীদের কথা বিবেচনায় রেখে টঙ্গী রেলওয়ে জংশনে অতিরিক্ত টয়লেট ও বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে।
যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ : গাজীপুরের পুলিশ সুপার হারুন অর রশীদ জানান, শনিবার রাত ১২টা থেকে রোববার আখেরি মোনাজাতের দিন বিকেল পর্যন্ত ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের গাজীপুরের ভোগড়া বাইপাস মোড় থেকে কুড়িল বিশ্বরোড, আশুলিয়া বাইপাইল থেকে আবদুল্লাহপুর, কামারপাড়া, টঙ্গী স্টেশন রোড থেকে মীরের বাজার পর্যন্ত অ্যাম্বুলেন্স ও পুলিশের গাড়ি ছাড়া সাধারণ যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে। সে জন্য মুসল্লিদের যাতায়াতের সুবিধার্থে আখেরি মোনাজাতের দিন রোববার ভোর থেকে গাজীপুরের ভোগড়া বাইপাস মোড় এলাকা থেকে ইজতেমাস্থল পর্যন্ত মুসল্লিদের সুবিধার্থে জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে প্রায় অর্ধশত বিআরটিসি বাস ও ব্যক্তি মালিকানাধীন (ইজতেমার স্টিকার লাগানো) শাটল বাস চলাচল করবে।
যেসব স্থানে গাড়ি পার্কিং নিষেধ : মহাখালী ক্রসিং থেকে টঙ্গী হয়ে জয়দেবপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত মহাসড়কের দুই পাশ, আবদুল্লাহপুর থেকে বাইপাইল, প্রগতি সরণির মধ্যবাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রগতি সরণি সড়কের দুই পাশে গাড়ি পার্কিং নিষেধ করেছে পুলিশ।
মোনাজাতের দিন ঢাকা থেকে ইজতেমাস্থলগামী মুসল্লিদের ট্ঙ্গী ব্রিজ পরিহার করে আবদুল্লাহপুর-আশুলিয়া সড়ক ধরে হেঁটে ইজতেমা ময়দানের পশ্চিম পাশ দিয়ে ভাসমান সেতু দিয়ে ময়দানের ভেতরে প্রবেশের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন গাজীপুর ট্রাফিক বিভাগের সহকারী পুলিশ সুপার সাখাওয়াত হোসেন।