চাকরি না পেয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে সনদ জমা
শারীরিক প্রতিবন্ধী তিনি। স্নাতকোত্তর পাস করে চাকরির আশায় ঘুরেছেন দ্বারে দ্বারে। এভাবে শেষ হয়ে গেছে সরকারি চাকরিতে ঢোকার বয়সসীমা। প্রতিবন্ধী বলে বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানও তাঁকে নেয়নি। চাকরি হওয়ার আর কোনো সম্ভাবনা না থাকায় যে রাষ্ট্র তাঁকে সনদগুলো ধাপে ধাপে দিয়েছিল সেই রাষ্ট্রকেই তিনি সেগুলো ফিরিয়ে দিলেন।
চাকরি না পাওয়া যুবকের নাম মাহাফুজার রহমান (৩৬)। তিনি লালমনিরহাট সদর উপজেলার গোকুন্ডা ইউনিয়নের রতিপুর গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক সৈয়দ আলীর ছেলে।
মাহাফুজার রহমান আজ বুধবার দুপুরে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে পাঠানোর জন্য লালমনিরহাটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) রেজাউল আলম সরকারের হাতে সব পরীক্ষা পাসের সনদসহ প্রতিবন্ধী সনদ তুলে দেন। সেই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বরাবর একটি লিখিত আবেদনও দিয়েছেন।
সনদ গ্রহণ করে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) রেজাউল আলম সরকার সাংবাদিকদের বলেন, মাহাফুজারের দেওয়া আবেদনসহ সনদগুলোর ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জন্ম থেকেই মাহাফুজারের ডান হাতটি সম্পূর্ণরূপে অচল ও অনুভূতিহীন। এই হাত দিয়ে তিনি কোনো কিছুই করতে পারেন না। ফলে একমাত্র ভরসা বাঁ হাত এবং অন্যদের সহযোগিতা। এরপরও প্রবল ঝোকের কারণেই লেখাপড়া শুরু করে অর্জন করেছেন সর্বোচ্চ ডিগ্রি। ১৯৯৮ সালে এসএসসি ও ২০০১ সালে প্রথম বিভাগে এইচএসসি পাস করেন। এরপর রংপুরের কারমাইকেল কলেজ থেকে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। একই কলেজ থেকে ২০০৬ সালে পাস করেন স্নাতকোত্তর।
মাহাফুজাররা তিন ভাই ও দুই বোন। দুই ভাইয়ের আলাদা সংসার। বর্তমানে স্ত্রী, এক সন্তান, বাবা-মা ও এক বোন মিলে তাঁর পাঁচজনের সংসার। অবসরপ্রাপ্ত বাবার পেনশনের টাকা এবং স্বজনদের সহায়তার ওপর নির্ভর করেই এখন তাঁদের সংসার চলছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
মাহাফুজার রহমান অভিযোগ করেন, ২০১২ সালে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক নিয়োগ পদের পরীক্ষায় প্রায় ৩৩ বছর বয়সে প্রতিবন্ধী কোটায় তিনি অংশ নিয়ে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। প্রতিবন্ধী কোটায় একমাত্র প্রার্থী হিসেবে তিনিসহ জেলার পাঁচ উপজেলার ৪৫ জন উত্তীর্ণ হন। এরপর মৌখিক পরীক্ষার পর ১৩ জনকে চূড়ান্ত করে নিয়োগ দেওয়া হয়।
মাহাফুজার অভিযোগ করেন, ‘ওই পরীক্ষায় অন্যান্য কোটা পূরণ করা হলেও প্রতিবন্ধী কোটাটি পূরণ করা হয়নি। সেই কোটা পূরণ হলে একমাত্র প্রার্থী হিসেবে হয়তো চাকরিটি আমার হয়ে যেত। প্রধানমন্ত্রী বরাবর পাঠানো আবেদনপত্রেও আমি এই বিষয়টি তুলে ধরেছি।’
এর আগে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়, সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংকসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অসংখ্য আবেদন করেছিলেন মাহাফুজার। এর মধ্যে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের একটি নিয়োগের লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন কিন্তু পরে মৌখিক পরীক্ষা থেকে ছিটকে পড়েন। তাঁর স্ত্রী নাছরিন নাহার লাকিও স্নাতকোত্তর পাস করে এখনো কোনো চাকরি জোটাতে পারেননি।
প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো আবেদনে মাহাফুজার রহমান উল্লেখ করেন ‘২০১৩ সালের প্রতিবন্ধী সুরক্ষা আইনে নিয়োগ লঙ্ঘনের শান্তিপূর্ণ অংশ হিসেবে এবং ভবিষ্যতে আর কোনো শিক্ষিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তি যাতে আমার মতো অধিকার বঞ্চিত না হন সেজন্য স্বেচ্ছায় ও সজ্ঞানে আমার অর্জিত সব শিক্ষাগত যোগ্যতার সার্টিফিকেট আপনার কাছে অর্পণ করছি। এসব দিয়ে আমার বেকার জীবনের কোনো কষ্ট আর লাঘব হবে না।’
জানতে চাইলে আজ সন্ধ্যায় মাহাফুজার রহমান ব্যান্ডসংগীত শিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর ‘শুকতলি খয়ে গেছে ছিড়ে গেছে জামা/একটা চাকরি হবে ও চাঁদ মামা...’ গানটি উল্লেখ করে বলেন, ‘আমারা মামা-খালু কেউ নেই। তাই চাকরি খুঁজতে খুঁজতে আমার অবস্থাও হয়েছে ওই গানের মতো। ফলে বাধ্য হয়েই আমি আমার সার্টিফিকেটগুলো ফিরিয়ে দিলাম রাষ্ট্রকে।’
এরপরও প্রধানমন্ত্রীর কাছে আপনার কোনো চাওয়া আছে কি না- জানতে চাইলে মাহফুজার বলেন, ‘দেশে যোগ্যতা সম্পন্ন সব প্রতিবন্ধীর কোটা পূরণ করা হোক।’