সেচ প্রকল্পে জমি বাড়ার পরিবর্তে কমেছে
প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়েছে ৩৮৪ কোটি টাকার পাবনা সেচ ও পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প, যার প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল সাড়ে ১৮ হাজার হেক্টর জমি সেচের আওতায় আনা। কিন্তু শুরুতেই হোঁচট খেয়ে পাঁচ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়ার মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে প্রকল্পটি। পরে বিগত ২২ বছরে এ প্রকল্পে সেচের আওতা বৃদ্ধি পাওয়া তো দূরের কথা, উল্টো কমতে কমতে এখন সেখানে জমির পরিমাণ এক হাজার হেক্টরে এসে দাঁড়িয়েছে।
কৃষকদের অভিযোগ, পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) অবহেলা আর অনিয়মের কারণেই প্রকল্পটির এমন দূরবস্থা হয়েছে।
এ ব্যাপারে পাউবোর প্রধান পানি ব্যবস্থাপক নাসির উদ্দিন খান বলেন, ‘পাবনা সেচ প্রকল্পটির এমন দুরবস্থা দেখে আমি খুবই মর্মাহত। বলা যায়, এ প্রকল্পটি এক রকম অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে। সেচ প্রকল্পের আওতাভুক্ত জমির পরিমাণ কমতে কমতে এক হাজার হেক্টরে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি, সেচ প্রকল্পের অবকাঠামো শুধু দুর্বলই হয়নি, কোনো কোনো এলাকার সেচখালই একেবারে বিলীন হয়ে গেছে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাব।’
তবে তাঁর এ বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে পাউবোর বেড়া শাখার নির্বাহী প্রকৌশলী কবিবুর রহমান এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘অনেক কৃষক বোরো চাষের পরিবর্তে অন্য ফসলের দিকে ঝুঁকে পড়ায় তাঁরা সেচখালের পানি নিতে অনাগ্রহী। ফলে সেচের আওতাভুক্ত জমির পরিমাণ কিছুটা কমেছে। আর যেসব সেচখালের আওতাভুক্ত কৃষক পানি নিতে অনাগ্রহী, শুধু তাঁদেরই পানি দেওয়া বন্ধ রাখা হয়েছে। সেচ প্রকল্পটিকে অভিভাবকহীন ও অকার্যকর বলে যে অভিযোগ করা হচ্ছে, তা ঠিক নয়। অভিভাবকহীন ও অকার্যকর হলে সেচখালে ঠিকমতো পানি যাচ্ছে কীভাবে!’
পাউবো সূত্র জানায়, ১৯৯২ সালে ৩৮৪ কোটি টাকা ব্যয়ে পাবনা সেচ প্রকল্প চালু হয়। এ জন্য বেড়া উপজেলার বৃশালিখায় হুরাসাগর নদের পাড়ে পানি তোলার জন্য এবং কৈটোলায় যমুনা নদীর পাড়ে পানিনিষ্কাশনের জন্য নির্মাণ করা হয় দুটি শক্তিশালী পাম্প স্টেশন। এ ছাড়া নির্মাণ করা হয় ছোট-বড় অসংখ্য সেচখাল, নিষ্কাশন খাল, বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ, জলকপাট (স্লুইসগেট), কালভার্টসহ বিভিন্ন অবকাঠামো।
প্রথম পর্যায়ে লক্ষ্য ছিল পাবনার সাড়ে ১৮ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়া এবং তা বন্যামুক্ত রাখা। পরে পাবনার নয়টি, নাটোরের দুটি ও সিরাজগঞ্জের একটি উপজেলার এক লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর জমিকে প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু শুরুতে পাঁচ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়ার মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে প্রকল্পটি।
সরেজমিনে বেড়া উপজেলার চাকলা, দমদমা ও খাকছাড়া এবং সাঁথিয়া উপজেলার পুণ্ডুরিয়া এলাকা ঘুরে দেখা যায়, জমির পাশ দিয়ে যাওয়া সেচখালগুলোয় পানি নেই। গ্রামের কৃষকরা জানান, গ্রামের ফসলের জমির ওপর দিয়ে যাওয়া টি-৬ সেচখালের পূর্ব অংশে এবারও লোক দেখানো সংস্কারকাজ হয়েছে। কিন্তু এই অংশে এবার কোনো পানিই আসেনি। কৃষকরা চাষ করছেন সেচযন্ত্রের পানিতে।
একই গ্রামের পশ্চিম দিকে ওই সেচখালটিকে আরো ভগ্নদশায় দেখা যায়। খালটি ধরে কিছুটা এগোনোর পর খালের কোনো অস্তিত্বই চোখে পড়ে না। সেচখালের ওই স্থানটি ভেঙে সৃষ্টি হয়েছে যান চলাচলের রাস্তা। সেচখালের কিছু অংশ জুড়ে আবার ঘরবাড়িও দেখা যায়।
বিপর্যস্ত ওই সেচখালের পাশের জমিতে সেচযন্ত্রের মাধ্যমে সেচ দিচ্ছিলেন ফরিদ উদ্দিন। তিনি জানান, পাঁচ-ছয় বছর ধরে এ সেচখাল ভেঙেচুরে রয়েছে, অথচ পাউবোর কোনো কর্মকর্তাই এটা ঠিক করতে বা দেখতে আসেন না। সেচখালে পানি না আসায় এই এলাকার কৃষকরা তাঁর সেচযন্ত্র থেকে জমিতে সেচ দেন।
বেড়া উপজেলার চাকলা পানি ব্যবস্থাপনা দলের সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন, ইছামতী পানি ব্যবস্থাপনা দলের সভাপতি মঞ্জুরুল কাদের, সাঁথিয়া উপজেলার করমজা পানি ব্যবস্থাপনা দলের সভাপতি আবু দাউদসহ পাঁচ-ছয়জন এনটিভি অনলাইনকে জানান, সেচখালে ঠিকমতো পানি আসে না। আবার ঠিকমতো মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ না করায় অনেক সেচখাল বিলীন হওয়ার মুখে। অথচ সেচখাল রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের জন্য প্রতিবছরই প্রচুর বরাদ্দ আসছে। বরাদ্দ পাওয়া অর্থ লুটেপুটে খাওয়ার কারণেই সেচ প্রকল্পটি অকার্যকর হয়ে পড়েছে বলে তাঁরা অভিযোগ করেন।
সেচখালের পাড় ভেঙে যাওয়া প্রসঙ্গে পাউবোর বেড়া শাখার নির্বাহী প্রকৌশলী কবিবুর রহমান জানান, বিভিন্ন কারণে সেচ অবকাঠামো দুর্বল হলেও তা মেরামতের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ পাওয়া যাচ্ছে না। সেচখাল মেরামতের জন্য গত বছর দুই কোটি টাকা পাওয়া গেলেও এবার পাওয়া গেছে মাত্র ৭৫ লাখ টাকা।
এদিকে বারবার সেচখালের পাড় ভাঙার পাশাপাশি ঠিকমতো সেচের পানি না পাওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন প্রকল্প এলাকার অনেক কৃষক। গত ১৪ মার্চ পাউবোর প্রধান পানি ব্যবস্থাপক নাসির উদ্দিন খান বেড়ায় সেচ প্রকল্পের পানি ব্যবহারকারীদের প্রশিক্ষণ দিতে এলে ক্ষুব্ধ কৃষকরা তাঁকে অবরুদ্ধ করে রাখেন। একপর্যায়ে তিনি সেচ প্রকল্পের সমস্যাগুলো ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানোর আশ্বাস দিয়ে অবরোধমুক্ত হন।