নরসিংদীতে তাঁতের দখল নিয়েছে পাওয়ারলুম
শত বছরের পুরোনো নরসিংদীর হস্তচালিত তাঁতশিল্প। সেই শিল্পকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল এক সমৃদ্ধ বাণিজ্যনগরী। মৌলিক চাহিদা বস্ত্রের জোগান দিতে গড়ে উঠেছিল বহু হস্তচালিত তাঁতের কারখানা। সেসব কারখানায় পা ও হাতের নিপুণ ছন্দে সুতার একের পর এক বুননে কারিগররা তৈরি করতেন শাড়ি, লুঙ্গি ও গামছা। আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়ায় সেই তাঁতশিল্পের কারিগরদের দিন কাটছে এখন অভাব-অনটনে।
এবার রোজার ঈদ সামনে রেখে হাসি নেই নরসিংদীর তাঁতশিল্পীদের মুখে। একসময় তাঁতশিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ এলাকা হিসেবে নরসিংদীর খ্যাতি ছিল দেশজুড়ে, যা দেশের সীমানা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বিদেশেও। সেই হাতেটানা তাঁত এখন বিলুপ্তির পথে। হস্তচালিত তাঁতের স্থান দখল করেছে বিদ্যুৎ চালিত তাঁত বা পাওয়ারলুম।
পটভূমি
নরসিংদীতে ঠিক কবে থেকে তাঁতশিল্প গড়ে উঠেছে, তা বলা মুশকিল। তবে প্রবীণ তাঁত কারিগরদের সঙ্গে কথা বলে ও ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, আদি বসাক সম্প্রদায়ের তাঁতিরাই হচ্ছে আদি তাঁতি। তাঁদের একশ্রেণির যাযাবর বলা চলে।
প্রায় শত বছর পূর্বে আদি বসাক সম্প্রদায়ের তাঁতিরাই হস্তচালিত তাঁতের কাজ শুরু করেন। শুরুতে তাঁরা সিন্ধু অববাহিকা থেকে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে এসে তাঁতের কাজ শুরু করেন। কিন্তু সেখানকার আবহাওয়ায় শাড়ির মান ভালো না হওয়ায় তাঁরা নতুন জায়গার সন্ধানে বের হয়ে পড়েন। চলে আসেন বাংলাদেশের রাজশাহী অঞ্চলে। সেখানেও আবহাওয়া অনেকাংশে প্রতিকূল দেখে বসাকরা দুই দলে ভাগ হয়ে যান। একদল চলে আসেস নরসিংদী ও কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর। অন্যদল যান ঢাকার ধামরাইয়ে। তবে তাঁদের কিছু অংশ সিল্কের কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে রাজশাহীতেই থেকে যান।
নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার হাসনাবাদ, আমিরগঞ্জ, চরসুবুদ্দি, হাইরমারা, নিলক্ষা, নলবাটা, কাট্টাখালি, মনিপুরা, নরসিংদী সদরের সাটিরপাড়া, রাঙামাটি, হাজিপুর, ঘোড়াদিয়া, চরাঞ্চলের করিমপুর, নজরপুর, চম্পকনগর, বাবুরহাট (শেখেরচর), মাধবদী, কৌলানপুর, ভাটপাড়া, ভগীরথপুর এবং পলাশ উপজেলার ঘোড়াশাল, ডাঙ্গা পাইকশা এলাকাগুলো ছিল হস্তচালিত তাঁতের জন্য বিখ্যাত। সব মিলিয়ে জেলায় লক্ষাধিক তাঁতকল ছিল। এখানকার তৈরি তাঁতের পোশাক দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের চাহিদা মিটিয়ে বাইরেও রপ্তানি করা হতো। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে হস্তচালিত তাঁতের স্থান দখল করেছে পাওয়ারলুম বা বিদ্যুৎ চালিত তাঁত। স্বল্প সময় আর অল্প শ্রমে অধিক কাপড় উৎপাদন হওয়ায় এ অঞ্চলের তাঁতিরা ঝুঁকছেন পাওয়ার লুমের দিকে।
তাঁতশিল্পী ও তাঁতকল মালিকদের ভাষ্য
রায়পুরা উপজেলার হাসনাবাদ এলাকার হস্তচালিত তাঁতের কারিগর নুরুল আমিন বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে এই কাজের সঙ্গে জড়িত হয়েছি। জীবনে অন্য কোনো কাজ শিখিনি। আমরা সারা দিন কাজ করে যে পরিমাণ কাপড় তৈরি করি, পাওয়ারলুমে কয়েক ঘণ্টায় সেই পরিমাণ কাপড় তৈরি হয়। সারা দিন কাজ করে চারটি গামছা তৈরি করতে পারি। প্রতি গামছায় ৪০-৫০ টাকা করে পাই, যা দিয়ে একদিনের বাজার খরচও চলে না।’
তাঁতকল মালিক মো. আহসান মিয়া বলেন, ‘একসময় আমাদের এলাকাজুড়ে তাঁতকল ছিল। পাওয়ারলুমের সঙ্গে উৎপাদনে টিকতে না পেরে অনেকেই এ পেশা ছেড়ে দিয়েছে। তবে আমাদের কারখানা থেকে আড়ংয়ের মতো নামীদামি কোম্পানিগুলো কাপড় নিচ্ছে। তাই আমরাসহ বেশ কয়েকটি কারখানা এখনো টিকে আছে।’
চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি ও নরসিংদী জেলা পাওয়ারলুম টেক্সটাইল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এ কে এম ফজলুল হক বলেন, জেলার তিন লক্ষাধিক তাঁত কারখানা রয়েছে। এর সঙ্গে সাত লক্ষাধিক লোকের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তাঁতশিল্পেও প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে। খুব অল্প সময়ে বেশি কাপড় উৎপাদন হয়। তাই হস্তচালিত তাঁতশিল্প প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে গেছে।
ফজলুল হক আরো বলেন, একসময় নরসিংদীর সব অঞ্চলেই হস্তচালিত তাঁত ছিল। সে সময় পাওয়ারলুম ছিল না। তবে বর্তমানে বিদ্যুৎ চালিত তাঁত বা পাওয়ারলুমে দ্রুত উৎপাদন হয়। তাই সবাই ধীরে ধীরে পাওয়ালুমের দিকে আগ্রহী হচ্ছে।