নরসিংদীতে আশা জাগাচ্ছে লটকন
নরসিংদীতে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে লটকন চাষ শুরু হয় সাত-আট বছর আগে। অল্প এ সময়ে এই ফলই জেলার অন্যতম অর্থকরী ফসল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। বর্তমানে এ এলাকায় লটকনের বাণিজ্যিক উৎপাদন ব্যাপকভাবে বেড়েছে।
চলতি মৌসুমে এ ফল বেচাকেনায় ৩০ কোটি টাকার লেনদেন হতে পারে বলে মনে করছেন চাষিসহ সংশ্লিষ্টরা।
নরসিংদী জেলায় উৎপাদিত লটকন আকারে বড়, দেখতে হলদে আর স্বাদে মিষ্টি। দেশের বিভিন্ন বাজারের পাশাপাশি বিদেশের বাজারও রয়েছে এর চাহিদা।
লটকনের পাপড়ি ঝরে না। সরাসরি গাছের কাণ্ড থেকে বের হয় এ ফল। স্থানীয়ভাবে এটি বুগি নামে পরিচিতি। টক আর মিষ্টির দ্বৈত স্বাদ এ ফলটিকে দিয়েছে বিশেষত্ব। এই ফলের বাণিজ্যিক চাষাবাদে হাসি ফুটছে নরসিংদীর কৃষকের মুখে।
মাঠ বাস্তবতা
বিদেশে লটকন রপ্তানি করেন নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার চৈতন্য গ্রামের ইমাম উদ্দিন সরকার। তিনি বলেন, ‘কেমিক্যালমুক্ত, কোনো ধরনের রাসায়নিকের ব্যবহার না থাকায় লটকন বিদেশে পাঠাতে কোনো সমস্যা হয় না। এবার আমি লটকন বিক্রি করে প্রায় ১০ লাখ টাকা উপার্জনের লক্ষ্য নিয়েছি।’
কম খরচ আর অল্প পরিশ্রমে ফলন ও মূল্য দুটোই ভালো হওয়ায় লটকন এখন চাষিদের কাছে অন্য ফসলের তুলনায় অর্থনৈতিকভাবে লাভবান বলে পরিচিতি পেয়েছে। বিদেশফেরত ও বহু বেকার যুবক লটকনের চাষ করে তাঁদের মুখে ফুটিয়েছেন অর্থনৈতিক সাফল্যের হাসি।
এখন মানভেদে লটকন তিন হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা মণ দরে পাইকারি বিক্রি হচ্ছে। খুচরা দাম ৮০ থেকে ১০০ টাকা কেজি।
এ ফল বিক্রির জন্য কৃষকদের ভাবতে হয় না। পাইকাররা বাগান থেকেই লটকন কিনে নিয়ে যাচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, নরসিংদীর শিবপুর উপজেলায় সবচেয়ে বেশি লটকনের বাগান রয়েছে। লটকন গাছে নারী-পুরুষ রয়েছে। ফল আসার আগ পর্যন্ত নারী-পুরুষ চিহ্নিত করা দুষ্কর। চারা লাগানোর কমপক্ষে পাঁচ-ছয় বছর পর ফল আসে। এ কারণে প্রথমদিকে চাষিরা লটকন চাষে উৎসাহিত হননি।
প্রথমদিকে চারার জন্য নার্সারিগুলোর ওপর নির্ভর করলেও এখন তারা তা করছে না। এখন নিজেরাই চারা তৈরি করছে।
সাধারণত দেখা যায়, এক বিচিবিশিষ্ট লটকন থেকে অধিক নারী গাছের জন্ম নেয়। তা ছাড়া চারা অবস্থায় গাছের বিভিন্ন লক্ষণ দেখে অভিজ্ঞরা নারী চারা শনাক্ত করতে পারেন। বাছাইয়ের এ পদ্ধতি বিজ্ঞানসম্মত না হলেও চাষিরা বেশ সাফল্য পাচ্ছেন।
বিভিন্ন জায়গায় দেখা গেছে, বাগানগুলোতে নির্দিষ্ট দূরত্বে তিনটি করে চারা রোপণ করা হচ্ছে। চার-পাঁচ বছর পর প্রথম ফল এলে নারী গাছ রেখে বাকিগুলো কেটে ফেলা হচ্ছে। একটি পূর্ণবয়স্ক লটকন গাছে ৫ থেকে ১০ মণ পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়।
লটকন চাষি তোফাজ্জল হোসেন জানান, লটকন গাছের পুষ্টির সুষমতা ও আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে গোড়া থেকে প্রধান কাণ্ডগুলোতে ঝোপায় ঝোপায় এত বেশি ফল আসে যে তখন গাছের ডাল পর্যন্ত দেখা যায় না।
কৃষি বিভাগের ভাষ্য
নরসিংদী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে জানা যায়, জেলার শিবপুর, বেলাব ও রায়পুরা উপজেলার মাটি লটকন চাষের জন্য খুবই উপযোগী এলাকা। গত বছর জেলার প্রায় ৫৩৫ হেক্টর জমিতে লটকনের চাষ হয়েছিল। এ বছর আবাদ হয়েছে প্রায় সাড়ে ৫০০ হেক্টর জমিতে। বাণিজ্যিক ছাড়াও বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন ঘরবাড়ির পাশে ও পতিত জমিতেও লটকন গাছ রয়েছে, যা কৃষি বিভাগের হিসাবের বাইরে।
কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, প্রতি হেক্টর জমিতে গড়ে সাড়ে ১৬ টন লটকন উৎপাদিত হচ্ছে। সেই হিসাবে চলতি বছর লটকন উৎপাদনের সম্ভাবনা ধরা হয়েছে নয় হাজার ৫৭০ টন।
বর্তমানে ফরমালিনের ভয়ে ফল খাওয়া নিয়ে শঙ্কায় থাকেন অনেকেই। লটকন ফরমালিনমুক্ত ফল হওয়ায় তা সবার কাছে বেশ পছন্দের। গাছ থেকে পাড়ার পর সাধারণত দুদিন এর সৌন্দর্য অক্ষুণ্ণ থাকে।
সেই সৌন্দর্য ও স্বাদ অক্ষুণ্ণ রেখে কীভাবে লটকন দীর্ঘস্থায়ী সংরক্ষণ করা যায়, তা নিয়ে গবেষণা চলছে বলে জানিয়েছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক লতাফত হোসেন। তিনি জানান, এবার সময়মতো বৃষ্টি হওয়ায় অন্য বছরের তুলনায় ফলন ভালো হয়েছে। কৃষকদের মুখে হাসি ফুটেছে। ভালো জাতের লটকন মধ্যপ্রাচ্য, লন্ডন ও ইউরোপে রপ্তানি হচ্ছে।