তথ্যচিত্রে কামারুজ্জামানের নৃশংসতা
১৯৭১ সালে তৎকালীন শেরপুর মহকুমায় ছিল কুখ্যাত আলবদর বাহিনীর সাতটি ক্যাম্প। এর মধ্যে শেরপুরের সুরেন্দ্র মোহন সাহার বাড়ির ক্যাম্পটি ছিল সবচেয়ে বিভীষিকাময়। ৮০-৯০ জন মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের সহযোগীদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয় এ ক্যাম্পে। দিনের পর দিন ক্যাম্পের অন্ধকার কুঠুরিতে আটকে রেখে বন্দীদের ওপর চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন।
ক্যাম্পগুলোর তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন তৎকালীন ময়মনসিংহ আলবদর বাহিনীর সমন্বয়ক ও পরবর্তী সময়ে জামায়াতে ইসলামীর সিনিয়র সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগী আলবদর বাহিনীর মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার চাঞ্চল্যকর সব তথ্য নিয়ে নির্মিত ‘আলবদর : এ কিলিং স্কোয়াড অব পাকিস্তান আর্মি ১৯৭১’ নামের একটি তথ্যচিত্র থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের উদ্যোগে ২০১১ সালে এ তথ্যচিত্রটি নির্মিত হয়। ২০১২ সালের ৩০ মার্চ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে সরকার গঠিত তদন্ত সংস্থার কাছে তথ্যচিত্রটি জমা দেয় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রধান কৌঁসুলির দেওয়া অভিযোগপত্রে এই তথ্যচিত্রটির কথা উল্লেখ আছে।
তথ্যচিত্রটির নির্মাতা ফখরুল আরেফিন খান। প্রযোজক ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি ও ১৯৭১ ফাউন্ডেশন। এক ঘণ্টা তিন মিনিটের তথ্যচিত্রটির ১১ থেকে ১৬ মিনিট পর্যন্ত শেরপুরে কামারুজ্জামানের নৃশংসতার তথ্যপ্রমাণ, ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার ও তখনকার বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা আছে।
তথ্যচিত্রটিতে সুরেন্দ্র মোহন সাহার ক্যাম্পের প্রহরী ও আলবদর সদস্য মোহন মুন্সী সে সময়কার ঘটনাগুলোর বিবরণ দিয়েছেন। তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন এই নির্মম নির্যাতন। হত্যার পর দেয়ালে লেগে থাকা ছোপ ছোপ রক্তের দাগ এখনো চোখে ভাসে আর অসহায় মানুষগুলোর গগনবিদারী চিৎকার এখনো কানে বাজে বলে জানিয়েছেন একাত্তরের নৃশংস আলবদর বাহিনীর সদস্য বয়োঃবৃদ্ধ এ মানুষটি।
১৯৭১ সালে আলবদর বাহিনীর হাতে বন্দী হয়েছিলেন শেরপুরের রাজনীতিবিদ সাদউর রহমান ওরফে সাদু চেয়ারম্যান। হত্যার জন্য লাইনে দাঁড় করানো হয়েছিল তাঁকে। কিন্তু মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসতে সক্ষম হন তিনি। তথ্যচিত্রের সাক্ষাৎকারে ওই সাদু চেয়ারম্যান বলেন, ‘তারা আমারে বাঁধছে। আর আমার শালার (শ্যালক) হ্যান্ডকাফের সঙ্গে আরো তিনজনরে বাঁধছে।আমাদের নদীর কিনারে নিয়ে গেছে। যেহেতু হ্যান্ডকাফটা লুজ আছিল, তাই হেডা খুইলা নদীতে ঝাঁপ দেই।’
তথ্যচিত্র দেখানো হয়, ময়মনসিংহ জেলা আলবদরের প্রধান সংগঠক কামারুজ্জামানই শেরপুরে সুরেন্দ্র সাহার বাড়িতে গড়ে তোলেন কুখ্যাত আলবদর ক্যাম্প। এই ক্যাম্পে বন্দী মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা তালুকদারকে গুলি করে হত্যা করা হয় তাঁরই নির্দেশে।
তথ্যচিত্রে ওই ঘটনার বর্ণনা দিয়ে মোস্তফা তালুকদারের ছোট ভাই মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আমার বড় ভাই শহীদ গোলাম মোস্তফা তালুকদার স্বাধীনতার ডাকে প্রতিবেশী দেশ ভারতে চলে যান। প্রশিক্ষণ শেষে দেশের ভেতর গোয়েন্দা কাজে নিয়োজিত হন এবং তাঁর সহযোগীদের যুদ্ধক্ষেত্রে সহযোগিতা করেন। ২৩ আগস্ট (১৯৭১) তিনি শেরপুরে আসেন এবং শেরপুর কলেজ মোড়ে একটি দোকান থেকে ব্যাটারি কেনেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নিয়মিত প্রোগ্রামগুলো শোনার জন্য। পরে জানতে পারি, ওই দোকানের সামনে থেকেই শেরপুরের আলবদর বাহিনীর প্রধান কুখ্যাত কামারুজ্জামানের নির্দেশে তাঁকে অ্যারেস্ট (গ্রেপ্তার) করা হয়। সেই কলেজের পাশেই ছিল সুরেন্দ্র মোহন সাহার বাড়ি। সে বাড়িতেই নাৎসি ক্যাম্প খোলা হয় এবং শেরপুরের মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের সহযোগীদের নিয়ে এসে অমানুষিক অত্যাচার করা হয়। সে দিন মেজর রিয়াজ (পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা) শেরপুরে ছিল।’
মোশাররফ হোসেন আরো জানান, ‘কামারুজ্জামান তাঁকে বলেন, ‘‘আমরা একজন মুক্তিবাহিনী, জয় বাংলার লোক পেয়েছি। এরা সব কুখ্যাত এবং সবাই জয় বাংলার লোক।’’ তখন মেজর রিয়াজ বলে, ‘‘ঠিক আছে তাকে রেখে দাও। আমরা আসতেছি।’’ এরপর তারা চলে যায় নকশী ক্যাম্পে। যাওয়ার আগে কামারুজ্জামান নাসির ও কামরানকে, যে কামরানের দোহাই দিয়ে কামারুজ্জামান বলতে চাইছেন, তখন আমি ছিলাম না, ছিল কামরান, তাদের নির্দেশ দিয়ে যায় মোস্তফাকে শ্যুট করার।’
তথ্যচিত্রে মোহন মুন্সী তাঁর সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘কামারুজ্জামান নাসিম ও কামরানকে কী জানি কইয়া চইলা গেল। এর আধা ঘণ্টা পর নাসির আর কলসবাড়িয়ার কামরান তাঁকে (গোলাম মোস্তফা তালুকদার) নিয়া যায়।’
পরদিন গোলাম মোস্তফার লাশ পাওয়া যায় শেরপুরের এক সেতুর নিচে। তথ্যচিত্রে তাঁর ছোট ভাই মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আমরা পরের দিন সকালে তাঁর লাশ পেয়েছি শের ব্রিজের নিচে। সে সময় লাশের বাম পায়ের মাংস ছিল না। ডান পায়েও তাই। বুকে গুলি লেগে পেছন দিয়ে বের হয়ে গেছে। এ অবস্থায় লাশ গ্রামের বাড়িতে দাফন করি।’
গোলাম মোস্তফার মতো এ রকম ৮০-৯০ জন মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের মানুষকে হত্যার সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় ওই ক্যাম্পে। এ প্রসঙ্গে মোহন মুন্সী বলেন, ‘অন্তত ১০০ জনকে ধইরা আনা হইছিল। আমি অন্তত তাই জানি। এর মধ্যে ধরেন ৮০-৯০ জনই গেছেগা।’
সুরেন্দ্র মোহন সাহার দোতলা বাড়ির সেই ক্যাম্পটি ধারণ করা হয়েছে তথ্যচিত্রে। ঘুরে ঘুরে সেই ক্যাম্পটি দেখান মোশাররফ হোসেন। তাঁর দেওয়া বর্ণনামতে, প্রথমে আলবদর ও রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের সহযোগীদের ধরে এনে দোতলায় ওঠার সিঁড়ির নিচে রাখত। এখানে ছুরি, কাঁচিসহ নির্যাতনের উপকরণ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া সিঁড়ির চারপাশে ছিল রক্তের দাগ। সে সময় সিঁড়ির নিচে একটা গর্ত ছিল। তাতে হাত-চোখ বাঁধা মানুষগুলোকে ফেলে নির্যাতন করা হতো। তারপর নিয়ে যাওয়া হতো দোতলায়। দোতলায় একটা অফিস ছিল। সেখানেও নির্যাতন করা হতো। নির্যাতনের পর চোখ বেঁধে রেখে দেওয়া হতো।
মোশাররফ হোসেন আরো বলেন, ‘দেশ স্বাধীনের পর আমরা চারপাশের দেয়ালজুড়ে রক্ত পেয়েছি। রুমের ভেতর ছিটে ছিটে রক্ত লেগেছিল। এসব দেখে শেরপুরের মানুষ হতভম্ব হয়ে গেছে, যে কী হয়েছে এখানে!’
নির্যাতনের বর্ণনা দেন মোহন মুন্সীও। তিনি সিঁড়ির নিচের একটি ঘর দেখিয়ে বলেন, ‘আমি এ ঘরটাতেই থাকতাম। তয় বেশির ভাগ সময়ই সিঁড়ির ওখানেই থাকতাম। মুক্তিযোদ্ধাগো আইনা ওই সিঁড়ির নিচে থুইত। মাইরা মাইরা রাখত আর আমি ওখান থাইকা চিৎকার হুনতাম।’ প্রতিবেদক তখন প্রশ্ন করেন, ‘মোস্তফা নাকি খুব পানি খাইতে চাইছিল?’ জবাবে মোহন বলেন, ‘হ, চাইছিল। খাওয়াইছে না (নাকি) না খাওয়াইছে আমি কইতে পারুম না। তয় চিৎকার পারছে।’