জমির জন্য আন্দোলনে ‘মূল মালিকরা’
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে একটি চিনিকলের অধিগ্রহণ করা জমি নিয়ে শুরু হয়েছে নানা নাটকীয়তা। স্থানীয় সাওতাল ও বাঙালিদের দাবি, যেহেতু অধিগ্রহণ করা জমিতে এখন আর আখ চাষ হয় না, তাই চুক্তি অনুযায়ী এসব জমি এখন তাদের ফেরত দিতে হবে। কিন্তু মিল কর্তৃপক্ষ এ দাবি মানতে নারাজ। তাঁদের বক্তব্য হচ্ছে, অধিগ্রহণ করা জমি কখনো ফেরত দেওয়া হয় না।
১৯৫৪-৫৫ সালে রংপুরের মহিমগঞ্জে প্রতিষ্ঠা করা হয় রংপুর সুগার মিল। এই মিলে আখ সরবরাহের জন্য পার্শ্ববর্তী সাহেবগঞ্জ এলাকায় তৈরি করা হয় বাগদা ইক্ষু ফার্ম। এই ফার্মের ১৮৪২ একর জমিতে রংপুর সুগার মিলের জন্য আখ চাষ করা হতো। পাকিস্তান ডেভেলপমেন্ট কোম্পানির (পিআইডিসি) অনুকূলে নোটিশ জারি করে এসব জমির দখল নেয়। এ সময় প্রায় দুই হাজার পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়। এর অর্ধেকেরও বেশি ছিলেন সাওতাল জনগোষ্ঠীর।
আন্দোলনকারীদের দাবি, উচ্ছেদের আগে প্রদেশ সরকারের সঙ্গে মিল কর্তৃপক্ষের একটি চুক্তি সই হয়। যে চুক্তি অনুযায়ী, অধিগ্রহণ করা জমি আখ চাষের জন্য ব্যবহৃত হবে। কোনো কারণে রংপুর সুগার মিল বন্ধ হয়ে আখ চাষের প্রয়োজনীয়তা শেষ হলে, খামারের সমস্ত জমি পূর্বাবস্থায় ফিরে যাবে। অর্থাৎ এসব জমির মূল মালিকরা তাদের জমি ফেরত পাবেন।
জমি ফিরে পেতে একটি কমিটিও গঠন করেন ক্ষতিগ্রস্তরা। সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান আলী এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট কোম্পানির অনুকূলে এসব জমি ইক্ষু চাষের জন্য অধিগ্রহণের নোটিশ জারির পর ১৯৬২ সালের ৭ জুলাই হাইকোর্টে একটি চুক্তি হয় প্রদেশ সরকার ও কোম্পানির মধ্যে। চুক্তিতে শর্ত ছিল, এখানকার ৭৫ শতাংশ লোকের কাজের ব্যবস্থা করতে হবে। যেহেতু স্থানীয়রা অদক্ষ, সেহেতু প্রশিক্ষণ দিয়ে তাঁদের কাজের ব্যবস্থা করতে হবে। চুক্তিতে কতদিন পর্যন্ত জমিগুলো অধিগ্রহণকৃত থাকবে তার কোনো তারিখের উল্লেখ নেই। সেখানে বলা হয়, অধিগ্রহণ করা সম্পত্তির মালিক প্রদেশ সরকার। করপোরেশন কোনোভাবেই এসব সম্পত্তির কোনো পরিবর্তন করতে পারবে না। যদি সম্পত্তিটা করপোরেশনের কাজে ব্যবহার না হয়, তাহলে তা আবার প্রদেশ সরকারকে ফিরিয়ে দিতে হবে। সরকার এসব সম্পত্তি আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবে।’
শাহজাহান আলী আরো জানান, ১৯৭০ সালে মুক্তিযুদ্ধের আগেই পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি মিল ফেলে চলে যায়। কোনো সরকারের কাছে মিলের সম্পত্তি হস্তান্তর না করেই তারা এক প্রকার পালিয়ে চলে যায়। স্বাধীনতার পরপর তা বাংলাদেশ চিনিশিল্প করপোরেশনের অধীনে চলে যায়। করপোরেশন প্রচুর লোকসান দিয়ে দীর্ঘদিন চিনিকলটি চালায়। পরে ২০০৪ সালে মিলটি বন্ধ ঘোষণা করে। ২০০৫ সাল থেকে এই জমিগুলো স্থানীয় প্রভাবশালীদের কাছে লিজ দেয়।
চুক্তি সংক্রান্ত কাগজপত্র হাতে পাওয়ার পর স্থানীয় লোকজন জমি ফিরে পাওয়ার জন্য আন্দোলন শুরু করে বলে জানান শাহজাহান আলী। এ সময় স্থানীয় সংসদ সদস্যকে নিয়ে মতবিনিময় সভারও আয়োজন করা হয়। প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে স্মারকলিপিও দেন আন্দোলনকারীরা। সংসদ সদস্য জমি ফেরত পাওয়ার বিষয়ে আন্দোলনকারীদের আদালতের শরণাপন্ন হতে পরামর্শ দেন। তবে আদালতে গেলে যদি জমি ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা একেবারে শেষ হয়ে যায় এই ভয়ে তাঁরা আদালতে যাননি বলেও জানান শাহজাহান আলী।
আন্দোলনকারীদের এই নেতা আরো জানান, পরে জেলা প্রশাসকের পরামর্শে তাঁরা দরখাস্ত করেন। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করেন সহকারী কমিশনারসহ (ভূমি) প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তারা। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, রংপুর সুগার মিল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, আবেদনকারীদের বক্তব্য এবং দাখিল করা কাগজপত্র অনুযায়ী আবেদনকারীদের বক্তব্যের সত্যতা পাওয়া গেছে।
এরপর চিনিশিল্প করপোরেশন ও সচিবালয়ে এই প্রতিবেদনের অনুলিপি পাঠানো হয় আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে। পরে গাইবান্ধায় প্রতিবাদ সমাবেশ করেন তাঁরা।
শাহজাহান আলী অভিযোগ করেন, এরই মধ্যে চিনিকলে ব্যবস্থাপনা পরিচালক আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করেন। অনেককে হয়রানি করা হয়। এমনকি এখনো বাড়িঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হচ্ছে।
কাদের কাছে খামারের জমি লিজ দেওয়া হয় জানতে চাইলে শাহজাহান আলী বলেন, ‘স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যবসায়ী রফিক, শওকত আলী, আলম এরা এখানে ধান, গম, পাট, আলু, তামাক, লাউসহ বিভিন্ন সবজি চাষ করে। অথচ চুক্তি অনুযায়ী, আখ চাষ না হলে জমি ফেরত পাবেন প্রকৃত মালিকরা।’
আন্দোলনের একপর্যায়ে গত ১ জুলাই কিছু জমি দখল করে আন্দোলনকারীরা দুই হাজারের মতো বাড়িঘর তুলেছেন বলে জানান শাহজাহান আলী। পুরোনো মালিকানার কাগজ ধরে ধরে বর্তমান মালিকদের কাছে জমি বুঝিয়ে দিচ্ছেন বলেও জানান তিনি।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক (ডিসি) আবদুস সামাদ এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমি এ ব্যাপারে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিবের সঙ্গে বিস্তারিত কথা বলেছি। সে কারণে এ বিষয়ে আপনার সঙ্গে আর কোনো কথা বলব না।’
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে এনটিভি অনলাইনের পক্ষ থেকে রংপুর সুগার মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল আওয়ালের সঙ্গে কথা বলা হয়। তিনি জানান, রংপুর সুগার মিলের অন্তর্ভুক্ত একটি খামার আছে সাহেবগঞ্জে। ১৮৪২ একরের এই খামারটি ১৯৫৬ সালে মিল চালুর সময়ই সরকার অধিগ্রহণ করে। সেই থেকে এটি সুগার মিলের খামার হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। নানা কারণে ২০০৪ সালে সুগার মিলটি লে-অফ হয়ে যায়। ফলে খামারের কার্যক্রমও শেষ হয়ে যায়। ২০০৪ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত মিলটি লে অফ ছিল। এই সময়ের জন্য খামারের জমিগুলো মিল ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দরপত্র আহ্বান করে লিজ দেওয়া হয়েছিল। এগুলো লিজ নিয়েছিলেন স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা।
২০০৬ সালে আবার মিল চালু হলে লিজ প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পরে গত মৌসুম থেকে এসব জমি আবার মিলের অধীনে চলে আসে বলে জানান ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তিনি বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী পুরো জমির অর্ধেক অংশ এক বছর চাষ হয়, পরের বছর বাকি অর্ধেক চাষ হয়। লিজ শেষ হওয়ার পর স্থানীয় প্রভাবশালীরা বিভিন্ন রকমের ষড়যন্ত্র শুরু করেন। এর অংশ হিসেবে তাঁরা তখন স্থানীয় আদিবাসীদের ব্যবহার করেন, তাদের প্রলুব্ধ করেন। এরপর স্থানীয়রা মিলে ভূমি উদ্ধার কমিটি গঠন করে আন্দোলন শুরু করে। তাদের বোঝানো হয় যে, এসব তোমাদের জমি। কিন্তু সরকারের অধিগ্রহণের আইন অনুযায়ী, শতভাগ ক্ষতিপূরণ দিয়েই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। আবার ফেরত দেওয়ার কোনো ব্যবস্থাই নেই। কিন্তু স্থানীয়দের এভাবে বোঝানো হয় যে, এসব জমি আবার ফেরত পাওয়া যাবে। গত ৩০ জুন সাঁওতাল বিদ্রোহের ১৬৮তম বার্ষিকীতে সারা দেশ থেকে সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর মানুষদের এখানে জমায়েত করা হয়। আন্দোলন পরিচালনা করছে স্থানীয় কিছু বাঙালি। তবে পুলিশ মোতায়েন থাকায় সেদিন খামারের কোনো ক্ষতি করতে পারেনি আন্দোলনকারীরা। এর পরদিন তারা জমি দখল করে বাসস্থান নির্মাণ করতে শুরু করে। পরে মিল কর্তৃপক্ষ বিষয়টি প্রশাসনকে জানায়। কিন্তু ১ তারিখ রাতেই গুলশান ট্র্যাজেডি ঘটে যায়। এর পরপরই শুরু হয় ঈদের ছুটি। ফলে প্রশাসনের প্রয়োজনীয় নজর এদিকে পড়েনি।’
পরে সব ঘটনা মন্ত্রণালয়কে জানানো হয় বলে জানান আবদুল আওয়াল। তিনি বলেন, গতকাল মঙ্গলবার অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদের জন্য অভিযান পরিচালনা করা হয়। তবে পর্যাপ্ত পুলিশ মোতায়েন না থাকায় এবং প্রচুর আদিবাসী এখানে এসে উপস্থিত হওয়ায় পুলিশও পিছু হটে।
আবদুল আওয়াল অভিযোগ করেন, আন্দোলনকারীরা একপর্যায়ে খামারের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আক্রমণ করে। ৮-১০ জন প্রহরীকে মারাত্মকভাবে আহত করে। এ ছাড়া খামারের সম্পদের প্রচুর ক্ষতি করে।
আবদুল আওয়াল আরো বলেন, ‘স্থানীয় সংসদ সদস্য আন্দোলনকারীদের বারবার বলেছেন যে, দাবি থাকলে আদালতে যাও। খরচ প্রয়োজনে আমি দেব। যখন তারা দখল নেয়, তখনো বলা হয়েছে। কিন্তু তারা কোনো সাড়া দেয়নি।’ সরকারি অধিগ্রহণ করা জমি কখনো ফেরত দেওয়া হয় না জানিয়ে এই মিল কর্মকর্তা বলেন, দীর্ঘ ৭০ বছর ধরে এসব জমিতে আখের চাষ হচ্ছে। মিল কর্তৃপক্ষই এসব জমির যাবতীয় খাজনা দেওয়াসহ সব ধরনের আনুষ্ঠানিকতা পালন করছে।
ভূমি উদ্ধার কমিটির সভাপতি স্থানীয় ছাত্রলীগের একজন নেতা ছিলেন জানিয়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, আ. লীগের ছত্রছায়ায় এসব কাজ করা হচ্ছিল। কিন্তু যেহেতু স্থানীয় সংসদ সদস্য একজন সরকারি লোক, তাই সরকারের চাপের কারণে তিনি রাজনৈতিকভাবে কিছু করতে পারছেন না।
এসব কারণে এলাকায় ভীষণ সংকট সৃষ্টি হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন আবদুল আওয়াল।
এদিকে গোবিন্দগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মোজাম্মেল হক এনটিভি অনলাইনকে জানান, ১৯৫৪ সালে সুগার মিলটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে এসব জমিতে মিলেরই আখ চাষ করা হতো। হঠাৎ করে তিন চার বছর ধরে ওখানকার সাঁওতালসহ কিছু বাঙালি জমি ফেরত দেওয়ার দাবি তোলেন। এ নিয়ে তাঁরা আন্দোলনও করেন। অথচ আদালতের আশ্রয় নিতে পরামর্শও দেওয়া হলেও তারা সেটা করছেন না। গত ১ জুলাই রাতারাতি প্রায় দেড়-দুইশ বিঘা জমিতে অবৈধ স্থাপনা তৈরি করেন। সাঁওতাল আদিবাসীরা তীর-ধনুক নিয়ে প্রস্তুত হয়ে থাকেন। জমি দখলমুক্ত করতে গিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাঁদের কাছে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখতে চান। স্থানীয় এমপি সাহেবও সেখানে গিয়েছিলেন। কিন্তু আন্দোলনকারীরা কাউকে পাত্তা দেননি। তারা স্থাপনা নির্মাণ করতেই থাকে। পরে মিল কর্তৃপক্ষের অনুরোধে পুলিশ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে যায়। এক অংশ উচ্ছেদ করার পর তীর-ধনুক নিয়ে দখলকারীরা পুলিশের ওপর হামলা চালায়। তীরবিদ্ধ হয়ে দুই পুলিশ সদস্য গুরুতর আহত হন। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ শটগানের ফাঁকা রাবার বুলেট ছোড়ে।
পরে আদিবাসীরা চিনিকলের খামারে আক্রমণ করে তাদের নিরাপত্তারক্ষীদের মারধর করে বলে দাবি করেন ওসি। এ ঘটনায় একটি মামলা করা হয়েছে এবং গতকালই পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানান তিনি।