‘প্রধানমন্ত্রী, আপনিই আমাদের উদ্ধার করতে পারেন’
‘কাজের প্রলোভন দেখিয়ে আমাদের ভারতে নিয়ে আসা হয়েছে। অনেকে বেড়াতে এসে ধরা পড়েছে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে। আমাদের পাসপোর্ট নেই। আমরা মা, বাবা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে জীবন কাটাচ্ছি। আপনার সহযোগিতা পেলে বাবা ও মায়ের কাছে ফিরতে পারি। এই অসহায় ও দুর্দশা থেকে আপনিই আমাদের উদ্ধার করতে পারেন।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে এ চিঠি লিখেছে ভারতে পাচারের শিকার হওয়া ৩৮ শিশু। বাংলাদেশের মোট ৪৭ শিশু ও কিশোর গত দেড় থেকে দুই বছর ধরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুঘাট শুভায়ণ অবজারভেশন হোমে আটক আছে। আইনি জটিলতায় এসব শিশু-কিশোর দেশে ফিরতে পারছে না। গতকাল সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর চিঠি লিখে ৩৮ শিশু।
দেশে বাবা ও মায়ের কাছে ফিরতে দেরি হওয়ায় মানসিক ও শারীরিকভাবে ভেঙে পড়েছে এসব শিশু। তাদের দেশে পাঠানোর যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছে তারা। এমন অভিযোগ করে গত ২৯ ও ৩০ জুলাই এসব শিশু-কিশোর খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে অনশনও করে। ওই হোমের কর্মকর্তা ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার (এনজিও) কর্মকর্তাদের আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে অনশন ভাঙে এসব শিশু-কিশোর।
দিনাজপুরের হিলি সীমান্তসহ আশপাশের সীমান্ত দিয়ে বিভিন্ন সময়ে দালালেরা কাজের প্রলোভন দেখিয়ে এসব শিশুকে ভারতে পাচার করে।
দক্ষিণ দিনাজপুরের বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা স্পারের জেলা সঞ্চালক সুরজ দাস জানান, শুভায়ন হোমে এই মুহূর্তে ৪৭ জন বাংলাদেশি শিশু আটক আছে। যাদের বেশির ভাগই দুই বছর ধরে এই হোমে আছে। এদের কেউই কোনো সাজা ভোগ করছে না। কিন্তু কেবল দুই দেশের আইনি জটিলতায় এরা বন্দি জীবনযাপন করছে। এরা বেশির ভাগ কাজের সন্ধানে এ দেশে অনুপ্রবেশ করে। কেউ বা বেড়ানোর উদ্দেশে কেউ আবার আত্মীয়র বাড়িতে এসে ধরা পড়ে।
দক্ষিণ দিনাজপুরের শুভায়ণ অবজারভেশন হোমের সুপারিনটেনডেন্ট দাওয়াদর্জি শেরপা বলেন, ‘এরা সবাই আঠার বছরের কম বয়সী। তাই এদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা করা হয় না। কেবল দুই দেশের আইনি জটিলতার কারণেই এদের দেশে ফেরত পাঠাতে বিলম্ব হয়। শিশুরা মনে করে আমরা তাদের ফেরত পাঠাতে দেরি করছি, আসলে এমনটা নয়। বাংলাদেশ থেকে তাদের নাম-ঠিকানা আসতে অনেক সময় লেগে যায়। তাই ফেরত পাঠাতে বিলম্ব হয়।’ তবে অচিরেই তাদের ফেরত পাঠাতে সব ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে তিনি জানান।
দাওয়াদর্জি শেরপা আরো জানান, হোমের শিশুরা একদিন খাবার না খেয়ে অনশন করে। পরে আবার তারা খাবার খেয়েছে। শিশুরা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি আবেদন করে তাদের দ্রুত ফেরত নেওয়ার দাবি জানিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বরাবর লেখা চিঠিতে স্বাক্ষর আছে ৩৮ শিশু-কিশোরের। আটক থাকা শিশুরা হলো দিনাজপুরের কাহারোলের সোহেল রানা, মিজানুর রহমান, অমৃত রায়, গৌতম রায়, সুজন আলী, আজিজুল ইসলাম, সদরের মোস্তফা, বীরগঞ্জের আরিফুল ইসলাম, হাকিমপুরের সুজন, রহান কবির, খুলনার দৌলতপুরের রাফি শেখ, যশোহরের ইলিয়াস আলী, পাবনার ফরিদপুরের এনামুল হক, ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জের অসীম, মুকিদুল, বালিয়াডাঙ্গির বাদশা হক, চাঁপাইনবাবগঞ্জের জেনারুল ইসলাম, সোহেল রানা, কক্সবাজারের উখিয়ার ইলিয়াস, চকরিয়ার রবি আলম, বান্দরবান আলীকদমের নুরল ইসলাম, কুমিল্লার বুড়িচংয়ের আলামিন, ঢাকার কেরানীগঞ্জের জুবায়ের আহমেদ, সোহান শেখ, রাজশাহীর গোদাগাড়ীর মমিন, কৃষ্নো নাথ, কৃষ্নো টপ্প, কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ীর দুলাল আলী, জাহিদ হাসান, রাজু ইসলাম, নাজমুল হক, স্বাধিন আসলাম, নাগেশ্বরীর মুসে আলী, তসলিম আলী, পঞ্চগড়ের দেবিগঞ্জের স্বপন রায়, সুজন, পটুয়াখালির কলাপাড়ার রয়েল হোসেন, জয়পুরহাটের কালাইয়ের জুনেত।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ অংশের দিনাজপুর ও জয়পুরহাটের সঙ্গে ভারতের প্রায় ২৬২ কিলোমিটার সীমান্ত আছে। এই সুযোগে দালালেরা হিলি, পাঁচবিবি, জয়পুরহাট, বিরামপুর ও দিনাজপুর সীমান্তের অবৈধ পথে পুরুষ-মহিলাদের পাশাপাশি এসব শিশু-কিশোরদের চাকরির প্রলোভনে অনায়াসেই পাচার করছে ভারতে। কোনো কোনো শিশু ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী এবং পুলিশের কাছে ধরা পড়লেও এর বেশিরভাগ শিশু পাচার হয়ে যাচ্ছে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে। কিন্তু পাচারকারীরা থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। আটক হওয়া শিশুদের পাসপোর্ট না থাকার অপরাধে (১৮ বছরের নিচে) জেল-হাজতের পরিবর্তে দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুঘাট শুভায়ণ অবজারভেশন হোমে (শিশু কল্যাণ আবাস) আটক রাখা হয়। এদের কেউ-কেউ ভাগ্যের জোরে দেশে ফিরতে পারলেও অনেকেই দুই দেশের আইনি জটিলতার কারণে দীর্ঘদিন ধরে থেকে যায় সেখানে।