হত্যা ও লাশের রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক নেই : খালেদা জিয়া
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘মানুষের জীবন নিয়ে অপরাজনীতি আমরা করি না। হত্যা ও লাশের রাজনীতির সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। এমন হীন ও নৃশংস অপরাজনীতি আমরা কখনো করব না।’
আজ বৃহস্পতিবার খালেদা জিয়ার নামে দেওয়া এক বিবৃতিতে এ কথা বলা হয়। এতে তিনি আরো বলেন, ‘এখন যারা ক্ষমতা আঁকড়ে আছে, তারাই অতীতে আন্দোলনের নামে যাত্রীবাসে গানপাউডার দিয়ে আগুন লাগিয়ে ডজন ডজন মানুষকে পুড়িয়ে মেরেছে।’
বিএনপি চেয়ারপারসনের পক্ষ থেকে দলের ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান বিবৃতিটি পাঠান। বিবৃতিতে তিনি ‘যৌক্তিক পরিণতিতে না পৌঁছানো পর্যন্ত চলমান আন্দোলন অব্যাহত’ রাখার ঘোষণা দিয়েছেন।
‘তীব্র নিন্দা জানাই’
বিবৃতিতে খালেদা জিয়া বলেন, ‘আমরা বারবার বলে এসেছি, আমাদের আন্দোলন সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক। এ আন্দোলন আমরা জনগণকে সঙ্গে নিয়েই অগ্রসর করে নেওয়ার নীতিতে বিশ্বাস করি। কিন্তু আমাদের আন্দোলন চলাকালে যাত্রীবাহী ও অন্যান্য যানবাহনে পেট্রলবোমা মেরে ইতোমধ্যে নারী-শিশুসহ বেশ কয়েকজন নাগরিকের জীবন কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এই শোচনীয় মৃত্যুর পাশাপাশি বার্ন ইউনিটে ঝলসানো দেহ নিয়ে অনেকে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। নিরপরাধ মানুষের ওপর এই বীভৎস আক্রমণের আমরা তীব্র নিন্দা জানাই। যাঁরা হতাহত হয়েছেন, তাঁদের প্রতি গভীর সহানুভূতি ও সমবেদনা জানাই। এই সব হীন ও নৃশংস হামলায় জড়িত প্রকৃত অপরাধীদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি আমরা আগেই জানিয়েছি, আজ আবারও তার পুনরাবৃত্তি করছি।’
‘যেকোনো পরিণতির জন্য আমি তৈরি’
খালেদা জিয়া বলেন, ‘সম্প্রতি আমার কনিষ্ঠপুত্রের আকস্মিক মৃত্যুতে আমি মানসিকভাবে এক চরম শোকাবহ পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছি। এই বিপর্যয়ের ধকল কাটিয়ে ওঠার আগেই আমার সঙ্গে কী ধরনের নিষ্ঠুর আচরণ করা হয়েছে এবং হচ্ছে তা-ও সকলেই দেখছেন। সুপরিকল্পিতভাবে সর্বমুখী চাপ ও অনিরাপদ পরিস্থিতি তৈরি করে তারা আমাকে জনগণ ও নেতা-কর্মী থেকে বিচ্ছিন্ন করতে সচেষ্ট। কিন্তু আমি সকলকে পরিষ্কার ভাষায় বলতে চাই, কোনো অনৈতিক চাপ বা ভীতির মুখে আমি নত হব না। যেকোনো পরিস্থিতি বা পরিণতির জন্য আমি তৈরি আছি।’
‘ভীতিকর পরিবেশ সরকারই সৃষ্টি করেছে’
বিবৃতিতে খালেদা জিয়া বলেন, ‘জনগণ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে মুষ্টিমেয় স্তাবক ও সুবিধাভোগীর দ্বারা বেষ্টিত সরকার জনগণের আন্দোলনে ভীত হয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
এসব বাহিনীর নিয়ন্ত্রণভার দলবাজ ও বিতর্কিত কতিপয় কর্মকর্তার হাতে তুলে দিয়ে তাদের মাধ্যমে জনগণ ও প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর চরম জুলুম-নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালানো হচ্ছে।’
বিএনপির প্রধান বলেন, ‘মিথ্যা মামলায় গ্রেফতারের ভয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন কয়েক লক্ষ। অনেকের বাড়িঘরে গভীর রাতে হানা দিয়ে ভাঙচুর, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগের পাশাপাশি মহিলাসহ পরিবারের সদস্যদের নির্যাতন ও হেনস্তা করা হচ্ছে। এভাবে সারা দেশে এক ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে।’
‘৩৩ নেতা-কর্মীকে হত্যা, গ্রেপ্তার ১৭ হাজার’
বিবৃতিতে দাবি করা হয়, ‘গত ৬ জানুয়ারি দেশব্যাপী অবরোধ কর্মসূচি শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ৩৩ জন বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীকে আওয়ামী সন্ত্রাসী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলি, সাজানো বন্দুকযুদ্ধ ও নৃশংস অন্যান্য পন্থায় হত্যা করা হয়েছে। গুলি করে ও অন্যান্য পন্থায় আহত করা হয়েছে শত শত নেতা-কর্মীকে। আটকের পর নিখোঁজ রয়েছে অসংখ্য নেতা-কর্মী। ১৭ হাজারের বেশি নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।’
‘তদন্ত ও তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই মামলা করছে’
খালেদা জিয়া বলেন, ‘জীবন-বিনাশী এসব ঘৃণ্য হামলার ব্যাপারে ইতোমধ্যেই জনমনে গভীর সন্দেহ ও প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। কারণ পরিপূর্ণ নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রহরায় এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে জবরদস্তি করে শাসকগোষ্ঠী কিছু কিছু যানবাহন রাস্তায় নামাচ্ছে। সেই সব যানবাহনে কেমন করে ঘাতক বোমার নৃশংস হামলায় হতাহতের ঘটনা ঘটে, তা এক জ্বলন্ত প্রশ্ন। দ্বিতীয়ত, এসব হামলার ঘটনায় ঘটনাস্থল থেকে আজ পর্যন্ত তেমন কাউকে হাতেনাতে ধরা সম্ভব হয়নি। কোথাও কোথাও বোমা, গুলি, আগ্নেয়াস্ত্রসহ শাসক দলের চেলা-চামুণ্ডারা পুলিশের হাতে ধরা পড়লেও উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে তাদের ছেড়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটছে। অথচ ঘটনার পরপরই বিরোধী দল ও আন্দোলনের বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীনরা একতরফা প্রচারণা শুরু করে দিচ্ছে। কোনো তদন্ত ও তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই আমিসহ বিরোধী দলের শীর্ষস্থানীয় ও স্থানীয় নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে পুলিশ মামলা দায়ের করছে।’
বিএনপির চেয়ারপারসন আরো বলেন, ‘কারারুদ্ধ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধেও এসব ঘটনায় মামলা হচ্ছে। বিভিন্ন বিষয়ে আমাকে সহায়তাকারী অরাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ এমনকি প্রবীণ শিক্ষাবিদ অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদকে পর্যন্ত বোমাবাজির মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে। আমাদের পার্টির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব, আমার উপদেষ্টা ও দলের যুগ্ম মহাসচিবসহ সিনিয়র নেতাদের পর্যন্ত রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।’
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ
বিবৃতিতে খালেদা জিয়া বলেন, ‘আওয়ামী শাসকদের একদলীয় ধাঁচের স্বৈরশাসন কায়েমের অপতৎপরতার কারণে অতীতে দেশ জঙ্গিবাদের কবলে পড়েছিল। আমরা তা দমন করেছিলাম। আজ আবার তারা একই কায়দায় উদারনৈতিক রাজনীতির ধারাকে নিশ্চিহ্ন করতে যে নীতি অবলম্বন করছে, তাতে আবারো সেই একই আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এতে শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো অঞ্চলের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। আমরা এই কঠিন বাস্তবতার দিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও গণতান্ত্রিক বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।’
‘গণমাধ্যম সরকারি নিয়ন্ত্রণে’
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘জনগণের ওপর এমন চরম জুলুম-অত্যাচারের পাশাপাশি গণমাধ্যমকে সম্পূর্ণভাবে সরকারি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আন্দোলনরত বিরোধী দল, জনগণ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিরুদ্ধে একতরফা অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। সবার মৌলিক-মানবিক সমস্ত অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। ক্ষমতাসীন ছাড়া প্রায় সব রাজনৈতিক দলের স্বাভাবিক ও নিয়মতান্ত্রিক কার্যক্রম পরিচালনাও অসম্ভব করে তোলা হয়েছে।’