বখাটের ফাঁদে বারোতেই থেমে গেছে হাসি
যে বয়সে হেসেখেলে বেড়ানোর কথা, সে বয়সেই নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছিল বরগুনার ১২ বছর বয়সী কিশোরী হাসি। ফুসলিয়ে তার সঙ্গে ছবি তুলে সেই ছবি দেখিয়েই আবার তাকে যৌন নির্যাতন চালাত এক বখাটে যুবক। এখানেই শেষ নয়। একান্ত সেই ছবিটি আবার হাতবদল হয়ে পৌঁছে যায় যুবকের বন্ধুদের কাছে। সঙ্গে হাতবদল হয় হাসিও!
দিনের পর দিন বাড়তে থাকে নির্যাতনের মাত্রা। যৌন সম্পর্কে নিমরাজি হওয়ায় একদিন কিশোরীর বন্ধুরা সেই ছবিটি সারা গ্রামে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়।
কিশোরীর বড় বোন জানান, একদিকে লোকলজ্জার ভয়, অন্যদিকে নির্মম যৌন নির্যাতন। ঘরে অসুস্থ প্রতিবন্ধী মা। বাবা আবুল হাওলাদার (৬৫) একজন রিকশাচালক। ভাইবোন সবাই ব্যস্ত নিজ নিজ সংসারে। কোথায় যাবে ছোট্ট হাসি? অতটুকু শরীর আর ভীত বিহ্বল মন। একসময় আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয় ছোট্ট হাসি। গত ২৯ আগস্ট সোমবার রাতে ঘরের আড়ার সঙ্গে দড়িতে ঝুলে আত্মহত্যা করে সে।
হাসির মৃত্যুর সাতদিন পর গতকাল রোববার দুপুরে এনটিভির প্রতিবেদকের অফিসে আসেন হাসির বড় ভাই রিকশাচালক আবদুর রাজ্জাক (৩৭)। কাঁদতে কাঁদতে জানান, যৌন হয়রানি আর নির্যাতনের কারণে হাসি আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে।
এরপর সদর উপজেলার গুলবুনিয়া গ্রামে সরেজমিন অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে ছোট্ট কিশোরী হাসির ওপর যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের চিত্র। রোববার বিকেলেই সরেজমিন তাঁদের বাড়িতে গেলে দেখা যায়, বাড়ির রাস্তার পাশে হাসির কবরে বসে কাঁদছেন বাবা আবুল হাওলাদার। প্রতিবেদক কথা বলতে এগিয়ে গেলে তিনি ডুকরে কেঁদে ওঠেন। শেষ পর্যন্ত কান্নার তোড়ে আর কথাই বলতে পারেননি বয়োবৃদ্ধ আবুল হাওলাদার। স্বজনরা জানালেন, সবার ছোট মেয়েটিকে খুব ভালোবাসতেন বাবা। আর হাসির এমন মৃত্যুর পর খানিকটা অপ্রকৃতিস্থ হয়ে গেছেন তিনি।
হাসির পরিবার, স্বজন ও গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দরিদ্র রিকশাচালকের মেয়ে হাসির বয়স ছিল মাত্র ১২। গ্রামের স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ত সে। এরই মধ্যে থেমে গেছে তার জীবন। এইটুকুন বয়সে নির্মম যৌন হয়রানি আর নির্যাতন সইতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয়েছে তাকে। গত ২৯ আগস্ট রাতে আত্মহত্যার পরের দুই দিনে ময়নাতদন্ত আর দাফনের মধ্য দিয়ে চাপা পড়ে গেছে হাসির সকল না বলা যন্ত্রণা। সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতেই স্বাভাবিক গ্রামের পরিবেশ। শুধু অপূরণীয় ক্ষত হাসির বাবা-মা আর স্বজনদের মনে।
হাসির বাবা-মা ও স্থানীয় গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একই গ্রামের ছেলে বরগুনা সরকারি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র ইমাম হোসেন ইছা (১৯) প্রায়ই উত্যক্ত করত হাসিকে। হাসির খালাতো বোন করিমা জানান, স্কুলে যাওয়া-আসার পথে, কখনো বা বাড়ির পাশের সেতুতে দাঁড়িয়ে হাসিকে প্রেমের প্রস্তাব দেয় ইছা। একসময় ইছার প্রেমের ফাঁদে পড়ে হাসি।
এরপর একদিন বিকেলে বাড়ির পাশের একটি নির্জন সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে ইছার মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় ইছার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে ছবি তোলে হাসি। পরে সেই ছবি ফাঁস করে দেওয়ার কথা বলে প্রায়ই হাসিকে যৌন হয়রানি ও নির্যাতন করতে থাকে ইছা। এরপর একদিন ইছার মোবাইল থেকে সেই ছবি চুরি করে নেয় ইছার বন্ধু একই গ্রামের নয়ন (১৬)। এবার দরিদ্র কিশোরী হাসিকে মেনে নিতে হয় বখাটে নয়নের সকল ‘আবদারও’!
করিমা জানান, ছবি ফাঁস করে দেওয়ার কথা বলে নয়নও প্রায়ই হাসিকে যৌন হয়রানি ও নির্যাতন করত। এ কথা ইছাকে জানালে সে কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে উল্টো নয়নের কাজে সায় দেয়। মন ভেঙে যায় হাসির।
তবে এখানেই শেষ নয়। আবার হাতবদল হয় মোবাইল ফোনের সেই ছবি। আর ছবির সঙ্গে সঙ্গে আবারও হাতবদল হতে হয় হাসিকে। এবার হাসির জীবনে আসে তৃতীয় যুবক একই গ্রামের ছেলে সুমন (১৭)। সেও ইছা ও নয়নের বন্ধু এবং সহযোগী।
হাসির খালাতো বোন করিমা অশ্রুসিক্ত হয়ে জানান, একদিকে লোকলজ্জার ভয়, অন্যদিকে নির্মম যৌন নির্যাতন। ঘরে অসুস্থ প্রতিবন্ধী মা। বাবা আবুল হাওলাদার (৬৫) একজন রিকশাচালক। ভাইবোন সবাই ব্যস্ত নিজ নিজ সংসারে। কোথায় যাবে ছোট্ট হাসি। অতটুকু শরীর আর ভীত বিহ্বল মন। একসময় আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয় সে। গত ২৯ আগস্ট সোমবার রাতে ঘরের আড়ার সঙ্গে দড়িতে ঝুলে আত্মহত্যা করে হাসি।
বখাটে ইছা (বাঁয়ে) ও নয়ন। ছবি: এনটিভি
এ ঘটনা জানার পর হাসিকে নির্যাতনকারী নয়নের সঙ্গে কথা বলেন এনটিভির প্রতিবেদক। নয়ন অকপটে স্বীকার করে হাসিকে যৌন হয়রানির কথা। জানায়, ইছার মোবাইল থেকে চুরি করে সে হাসি আর ইছার ঘনিষ্ঠ ছবি নিয়েছিল। তবে পরে তার ওই মেমোরি কার্ড নষ্ট হয়ে গেছে বলেও জানায় সে।
নয়ন আরো জানায়, দিনের পর দিন ইছা হাসিকে মোবাইলের ছবি ফাঁস করে দেওয়ার কথা বলে যৌন হয়রানি চালিয়ে আসছিল। এরপর তার মোবাইল থেকে ছবি নিয়ে সুমনও হাসিকে নির্যাতন করেছে বলে স্বীকার করে সে।
তবে যৌন হয়রানির কথা স্বীকার করেনি ঘটনার মূল অভিযুক্ত ইছা। সব অভিযোগ অস্বীকার করে ইছার দাবি, হাসির সঙ্গে তার কোনো রকম সম্পর্ক ছিল না। নয়ন ও সুমনই হাসিকে নির্যাতন করেছে।
বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধানের পর এনটিভির প্রতিবেদক বরগুনার পুলিশ সুপার (এসপি) বিজয় বসাককে জানালে তিনি রোববার সন্ধ্যায়ই পুলিশ পাঠিয়ে ইছা ও নয়নকে গ্রেপ্তার করান। এনটিভির সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি জানান, যে বয়সে আনন্দ-হাসিতে হাসির পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার কথা সে বয়সে নির্মম যৌন নির্যাতনের কারণে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছিল হাসি।
এসপি বলেন, ‘নারী নির্যাতন, যৌন হয়রানি এবং মাদকের বিরুদ্ধে বরগুনা জেলা পুলিশ সব সময় সোচ্চার।’
সোমবার সকালে হাসির ভাই আবদুর রাজ্জাক আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে ইছা ও নয়নকে আসামি করে বরগুনা থানায় মামলা করেছেন বলে জানান এসপি।