মেহেরপুরে মানব পাচারের ফাঁদে শতাধিক পরিবার
মেহেরপুরে মানব পাচারকারী চক্রের সদস্যদের ফাঁদে পা দিয়ে নিঃস্ব হয়েছে শতাধিক পরিবার। এদের মধ্যে নিখোঁজ রয়েছে অন্তত অর্ধশত। ভালো জীবনের আশায় বিদেশ পাড়ি দিতে গিয়ে চারজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। তাঁরা হলেন গাংনী উপজেলার তেরাইল গ্রামের মামুন (২৫), সদর উপজেলার পাটকেলপোতা গ্রামের আলামিন হোসেন (৩২), সিংহাটি গ্রামের আতিয়ার রহমান (৩৮) ও ঝাঁঝাঁ গ্রামের আনারুল ইসলাম (৪০)।
নিহত মামুনের বড় বোন নাসরিন এনটিভি অনলাইনে জানান, উপজেলার হেমায়েতপুর গ্রামের জাহিদ হোসেন ও তেরাইল গ্রামের জাহাঙ্গীর হোসেন নানা প্রলোভন দেখিয়ে তাঁর ভাইকে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য ট্রলারে তোলে। মুত্যুর আগে মামুন মোবাইল ফোনে পরিবারের সদস্যদের বলেছিল, 'আমি মালয়েশিয়া পৌঁছানোর পর জাহিদ ও জাহাঙ্গীরকে দুই লাখ ৫০ হাজার টাকা দিয়ে দিও।'
কম খরচে মালয়েশিয়া পাঠানোর নামে সমুদ্রপথে থাইল্যান্ডের পাচারকারী চক্রের হাতে তুলে দেওয়া হয় মানুষগুলোকে। প্রথমে স্থানীয় দালালরা এদের নিয়ে যায় টেকনাফ। সেখান থেকে তুলে দেওয়া হয় ট্রলারে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মাত্র ৫০ হাজার বা এক লাখ টাকা দিয়ে মালয়েশিয়া গিয়ে কাজ করে বাকি টাকা পরিশোধ করলেই হবে—এমন প্রলোভনে পড়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ দালালদের হাত ধরে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। ১০, ১৫ বা ২০ দিন পর মোবাইল ফোনে খবর আসে, তারা থাইল্যান্ডের জঙ্গলে দালালদের হাতে আটকা পড়েছে। দুই বা আড়াই লাখ টাকা দিলে মালয়েশিয়া পৌঁছাতে পারবে। বাড়ির লোকেরা হয় ধারদেনা করে, নয় সহায়-সম্বল বিক্রি করে দালালদের হাতে টাকা তুলে দেয়। টাকা পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত চলে শারীরিক নির্যাতন। অসুস্থ হয়ে মারা গেলে সাগরের পানিতে অথবা জঙ্গলের মধ্যে ফেলে দেওয়া হয় লাশ। আবার কখনো মাটিচাপা দেওয়া হয়।
টাকা দিয়ে বাড়ি ফিরে আসা কয়েকজন জানিয়েছেন, মেহেরপুর জেলায় পাচারকারী চক্রের সদস্য হিসেবে কাজ করছেন গাংনী উপজেলার তেরাইল গ্রামের আবদুল গনির ছেলে জাহাঙ্গীর হোসেন, হেমায়েতপুর গ্রামের জাহিদ হোসেন, খড়মপুর গ্রামের আলী হোসেন, কসবা গ্রামের বদর উদ্দিনের ছেলে আব্বাস আলী, সদর উপজেলার শিংহাটি গ্রামের ইমারুল, মোশারফের ছেলে সাজিবুল, ইছাখালি গ্রামের মৃত সুরমান আলীর ছেলে সাদের আলী, আবদুস সাত্তারের ছেলে সিদ্দিক ও শিংহাটি গ্রামের মালয়েশিয়া প্রবাসী ইমাদুল।
তবে ছুটিতে বাড়ি আসা ইমাদুল জানান, তিনি কোনো লোক পাঠানোর কাজ করেন না। তাঁদের এলাকার তিন-চারজন ছেলে থাইল্যান্ডের জঙ্গলে দালালদের কাছে আটকা পড়লে তাঁদের ছাড়িয়ে আনার ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করেন পরিবারের লোকজন। এ অবস্থায় মালয়েশিয়ার ফার্মে কাজ করা কয়েকজন মিয়ানমারের নাগরিকের সাহায্য নেন এবং থাইল্যান্ডের জঙ্গলে অবস্থান করা দালালদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ছাড়িয়ে আনার ব্যবস্থা করেন।
সরেজমিনে ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দালালদের দাবি করা টাকা কক্সবাজারের লাইলী নামের এক নারী ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান এমআর ট্রেডার্সের অ্যাকাউন্টে পাঠানো হয়। তিনজনের জন্য সাড়ে ছয় লাখ টাকা দালাল ইমাদুলের শ্যালক রিপনের কাছে দিলে তিনি চুয়াডাঙ্গা ইসলামী ব্যাংক থেকে তাঁদের ওই অ্যাকাউন্টে পাঠান। রিপন চুয়াডাঙ্গা পৌরসভায় কনসালট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত আছেন। তবে দালালদের অনেকেই এখন আত্মগোপনে রয়েছেন।
মুক্তিপণ দিয়ে বেঁচে আসা কয়েকজন এনটিভি অনলাইনকে জানিয়েছেন, যেসব মানুষকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তাঁদের টেকনাফে নিয়ে প্রথমে লাইলী, মঞ্জু, আসলামের বাড়িতে রাখা হয়। বাড়িগুলো পলিথিনে ছাওয়া ও বেড়া দিয়ে ঘেরা।
একেকটি বাড়িতে ৫০ থেকে ৬০ জনকে জড়ো করা হয়। এর পর একসঙ্গে রাতের আঁধারে ট্রলারে তোলা হয়। একেকটি ট্রলারে তিন থেকে চারশ লোক নিয়ে যায়। ট্রলারে তোলার আগে সবার কাছ থেকে মোবাইল ফোন, ঘড়ি, টাকা-পয়সা সব কেড়ে নেওয়া হয়। টেকনাফের ওই সব বাড়িতে ঢুকলে আর বেরিয়ে আসার কোনো সুযোগ থাকে না। সব সময় অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা পাহারা দেয়। ট্রলারে করে থাইল্যান্ডের পাহাড়ের ওপরে জঙ্গলের ভেতর নিয়ে যায়। সেখান থেকে নিয়ে যায় থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়া সীমান্তে।
সেখানে সব সময় তিন-চার হাজার করে লোক থাকে। সব খানেই অস্ত্রধারী লোকজন পাহারা দেয়। সীমান্ত এলাকার পাহাড়ি জঙ্গলের মধ্যে আটকে রেখে বাড়িতে ফোন করিয়ে টাকা পাঠাতে বলা হয়। টাকা পাঠাতে কোনো ব্যত্যয় ঘটলে নির্যাতন চালানো হয়। মারা গেলে লাশ ফেলে দেওয়া হয় অথবা পুঁতে রাখা হয়।
টাকা পেলে মালয়েশিয়া ঢোকার জন্য কালো ত্রিপলে ঢাকা ছোট ছোট পিকআপে করে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় অনেকে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে, আবার কেউ কেউ অবৈধভাবে ঢুকে পড়ে মালয়েশিয়া।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, লাইলীর ৬১১৭ নম্বর অ্যাকাউন্টে কক্সবাজারের ইসলামী ব্যাংক, কোর্ট বাজার শাখায় ৯/৮/১৪ তারিখে তিন লাখ, ১০/৪/১৪ তারিখে এক লাখ, ২০/৪/১৪ তারিখে ৪০ হাজার, ২১/৪/১৪ তারিখে ৪০ হাজার ও ২০ হাজার টাকা এবং এমআর ট্রেডার্সের ২০৪৬ নম্বর অ্যাকাউন্টে ইসলামী ব্যাংক, ঢাকার ভিআইপি শাখায় ২১/৪/১৪ তারিখে এক লাখ ৬০ হাজার, ২৩/৩/১৫ তারিখে তিন লাখ, ২৪/৩/১৫ তারিখে ৫০ হাজার, ২৫/৩/১৫ তারিখে ৫০ হাজার, ২৯/৩/১৫ তারিখে ছয় লাখ ও দুই লাখ, ৩১/৩/১৫ তারিখে এক লাখ ৯০ হাজার টাকা পাঠানো হয়। সব টাকাই পাঠানো হয়েছে ইসলামী ব্যাংক, চুয়াডাঙ্গা শাখা থেকে। এসব টাকা পাচারকারীদের হাতে আটকা থাকা লোকজনকে ছাড়িয়ে আনতেই দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
মেহেরপুরের পুলিশ সুপার হামিদুল আলম জানান, মানব পাচারকারীদের কোনো ছাড় নেই। কঠোর হস্তে দমন করা হবে। তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ হবে। সেই সঙ্গে এই ঘৃণ্য কাজ থেকে পরিত্রাণ পেতে জনগণকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।