ধানের জেলা দিনাজপুরে চা চাষে সফলতা
এতকাল দেশের উত্তরের জেলা দিনাজপুরের খ্যাতি ছিল ধানের জেলা হিসেবে। সেই জেলার মাটি এবার চা চাষেও দেখাল অভাবনীয় সফলতা। আগে যেখানে দিনাজপুর যেতে সড়কের দুই ধারে দেখা যেত কেবলই ধানের ক্ষেত, সেখানে এখন মাঝেমধ্যে চায়ের বাগান গড়ে উঠেছে।
গ্রামের নাম সোনাজুড়ি। দিনাজপুরের বিরামপুর-ফুলবাড়ী সড়কের ধানজুড়ি থেকে তিন-চার কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে গেলেই এই গ্রাম। গ্রামটিতে গেলে চোখে পড়ে একটি চা বাগান। বিস্তৃত এলাকাজুড়ে সবুজ বেষ্টনীর মধ্যে আলো-ছায়ায় গড়ে ওঠা এই চা বাগানটি দেখলে আর চোখ ফেরানো যায় না।
পাহাড়ি ঢালু বা উঁচু ভূমি চা চাষের জন্য উপযুক্ত। কিন্তু দিনাজপুরের সমতলে চা চাষ! অসম্ভব এই বিষয়টি সম্ভব করে দেখিয়েছেন চা বাগানটির মালিক মো. মুক্তার হোসেন। পেশায় একজন সরকারি চাকরিজীবী তিনি। বর্তমানে তিনি ঢাকায় প্রধান হিসাবরক্ষণ কার্যালয়ে সুপারিনটেনডেন্ট পদে কর্মরত আছেন।
দেশের অন্যান্য জেলায় চা চাষ করা গেলে দিনাজপুরে কেন নয়? এক সহকর্মীর এমন কথা বেশ মনে ধরে মুক্তারের। সিদ্ধান্ত নেন সেখানেই চা চাষ করবেন তিনি। শুরুটা তখন থেকেই। বছর দেড়েক আগে প্রায় নয় বিঘা জমি লিজ নিয়ে চা চাষ শুরু করেন তিনি। আর এখন তাঁর চা বাগান থেকে বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত করা হচ্ছে চা পাতা।
মুক্তার হোসেন জানান, লিজ নেওয়া প্রায় নয় বিঘা জমিতে প্রথমে আমবাগান করেন তিনি। কিন্তু আশানুরূপ সাফল্য পাননি। পরে ঠাকুরগাঁওয়ে চাকরি করার সময় সমতলে চা চাষের বিষয়টি তিনি সহকর্মী ইফতেখার রসুলকে জানান। তখন ইফতেখার তাঁকে চা বাগান করার পরামর্শ দেন।
সহকর্মীর কথায় পঞ্চগড়ে চা চারার নার্সারিগুলোতে যোগাযোগ করেন তিনি। সেখান থেকে জনবল এনে মাটি পরীক্ষা করান। পরীক্ষায় মাটি চা চাষের উপযোগী পাওয়া গেলে চা বাগান করার প্রস্তুতি নেন তিনি। এর পর পঞ্চগড় থেকে চা গাছের চারা সংগ্রহ করে জমিতে লাগানো হয়। প্রায় চার লাখ টাকা খরচ করে গত বছরের এপ্রিল মাসে চা চাষ শুরু করেন তিনি। প্রতিটি চারাগাছ সাড়ে চার টাকা মূল্যে সাড়ে ১৭ হাজার চারাগাছ কেনা হয়।
মোক্তার আরো জানান, এক মাস আগে থেকে বাণিজ্যিকভাবে গাছ থেকে পাতা তুলে পঞ্চগড়ের করতোয়া ‘টি ফার্মে’ বিক্রি করা হচ্ছে। প্রতি কেজি পাতা ২৪ থেকে ২৫ টাকা দরে বিক্রি করা হচ্ছে। চা বাগান পরিচর্যায় দুজন শ্রমিক সার্বক্ষণিক কাজ করছেন। প্রতি ৩৫ থেকে ৪০ দিন পর পর গাছ থেকে পাতা তোলা হয়। এ সময় ১০ থেকে ১২ জন শ্রমিকের প্রয়োজন হয়।
স্থানীয় চা শ্রমিক আশরাফুল ও মতিন জানান, চা বাগানের নিবিড়ভাবে পরিচর্যা করতে হয়। বর্ষা মৌসুমে বাগানে যেন পানি না জমে, সে জন্য গাছের গোড়া উঁচু করে দিতে হয়। চা গাছে ছায়া দিতে মাঝেমধ্যে লাগানো হয়েছে পেয়ারা ও আমগাছ। এ ছাড়া খরার সময় পানি ছিটিয়ে গাছ সতেজ রাখতে হয়। মাঝেমধ্যে জীবাণুনাশক ওষুধও স্প্রে করতে হয়।
তাঁরা জানান, চা পাতার তোলার সময় প্রতিদিন ২৫০ টাকা হারে কাজ করেন তাঁরা। এর ফলে স্থানীয় অনেকেরই কর্মসংস্থান হয়েছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নিক্সন চন্দ্র পাল বলেন, ‘বিরামপুরের মাটি চা চাষের জন্য উপযোগী। বছরে দুই থেকে তিনবার জৈব সারের পাশাপাশি ইউরিয়া, পটাশ, টিএসপি সার প্রয়োগ করলেই চলে। গাছ যত বড় হবে, পাতার পরিমাণ ততই বাড়বে। তবে লাল মাকড়সা ও মশা চা পাতা যেন না খেয়ে ফেলে, তার জন্য কিছু ওষুধ ছিটানো লাগে।’
তিনি আরো বলেন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে মুক্তার হোসেনের মতো অনেকেই বিরামপুরসহ আশপাশের এই অঞ্চলে ব্যাপকভাবে চা চাষে আগ্রহী হয়ে উঠবে। ফলে চা শিল্পে দেশে আমদানি নির্ভরতা কমবে।