সরকার ও প্রশাসনের আলোচিত যত ঘটনা
বিদায়ী বছরে সরকার, প্রশাসন ও কূটনীতিক পর্যায়ে বেশ কয়েকটি ঘটনা ছিল আলোচিত। এসময় মাঠ প্রশাসনসহ প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে রদবদল হয়েছে। পাশাপাশি দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের লক্ষ্যে বাংলাদেশে নিযুক্ত প্রভাবশালী দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতদের অব্যাহত চেষ্টা ও তৎপরতাও ছিল চোখে পড়ার মতো। এসময় ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর ঢাকা সফর ছিল আলোচনার কেন্দ্রে। সবকিছু ছাপিয়ে দিল্লিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সেলফি তোলা ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সে ছবি গণমাধ্যমে সরবরাহের ঘটনা ছিল আলোচনার শীর্ষে।
শেখ হাসিনার সঙ্গে বাইডেনের সেলফি
ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে বিশ্বের ২০ সদস্যের প্রধান অর্থনৈতিক গ্রুপের নেতাদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যোগ দিয়েছিলেন। আয়োজক দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে শেখ হাসিনা এ সম্মেলনে অংশ নেন।
গত ৯ সেপ্টেম্বর সকালে দিল্লির প্রগতি ময়দানের ভারত মান্দাপাম কনভেনশন সেন্টারে সম্মেলনটি শুরু হয়। সম্মেলনের উদ্বোধনী পর্ব শেষ হওয়ার পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এক পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গেও কুশল বিনিময় করেন তিনি। এসময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলও উপস্থিত ছিলেন। তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নিজেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার কন্যা সায়মা ওয়াজেদের সঙ্গে সেলফি তোলেন বলে সাংবাদিকদের জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন।
এ ঘটনার পর শেখ হাসিনা ও জো বাইডেনের সেলফি বাংলাদেশের রাজনীতিতে নানা আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এ সেলফি নিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সেলফি তোলা দেখে বিএনপির ঘুম হারাম হয়ে গেছে। বিএনপির লাফালাফি বন্ধ হয়ে গেছে। দেখতে দেখতে ১৫ বছর কেটে গেছে; আমেরিকার দিকে তাকিয়ে ছিল তারা। একটা সেলফি দেখেই চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে তাদের। রাতের ঘুম শেষ হয়ে গেল।’
মার্কিন প্রেসিডেন্টের সেলফি প্রসঙ্গে ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যের উত্তরে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, সেলফিটা বাঁধিয়ে গলার মধ্যে পরে ঘুরেন। সেলফির জন্য কিন্তু র্যাবের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা কিংবা ভিসা নীতি উঠে যায়নি।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের ঢাকা সফর
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ দুই দিনের সফরে গত ১১ সেপ্টেম্বর ঢাকা আসেন। নয়াদিল্লিতে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণ শেষে বাংলাদেশ সফরে আসেন তিনি। গত ৩৩ বছরে কোনো ফরাসি প্রেসিডেন্টের এই প্রথম ঢাকা সফর।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ তার দেশের মাফরাসি আকাশযানের ওপর আস্থা রাখার জন্য এবং তাদের থেকে উড়োজাহাজ ও স্যাটেলাইট কেনার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
সংবাদ সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ বলেন, “ইউরোপীয় অ্যারোনটিকসে আস্থা রাখার জন্য এবং ১০টি এ-৩৫২ নেওয়ার বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দেওয়ার জন্য আমি ধন্যবাদ জানাতে চাই। উড়োজাহাজের দিক দিয়ে এয়ারবাস একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্র্যান্ড। ফ্রান্স বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইটের পেছনে ভূমিকা রেখেছে। জ্বালানি ও সামরিক খাতের পাশাপাশি সংস্কৃতি, শিক্ষা ও ঐতিহ্যের ক্ষেত্রে আপনারা ফ্রান্সের প্রতি আস্থা রাখতে পারেন।”
রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফর
গত ৭ সেপ্টেম্বর রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ ২৪ ঘণ্টার সফরে বাংলাদেশে আসেন। তাঁর সফরটি ছিল নানা দিক থেকে তাৎপর্যমণ্ডিত। প্রথমত, এটি ছিল বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ শক্তি রাশিয়ার কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রথম বাংলাদেশ সফর। দ্বিতীয়ত, রাশিয়ার ক্ষমতার পরিমণ্ডলে লাভরভ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তৃতীয়ত, তিনি এমন এক সময় এ সফরে এসেছিলেন, যখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বিশ্বব্যবস্থায় নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
চতুর্থত, বাংলাদেশে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনও যে মস্কোর কাছে গুরুত্ব বহন করছে, লাভরভের সফরে সেই আভাস পাওয়া গেছে। পরিবর্তিত ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে পুরোনো মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করতে মস্কো আগ্রহী বলে মনে হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরে হঠাৎ রাশিয়ার নৌবহর
রাশিয়ার একটি নৌবহর চট্টগ্রাম বন্দরে গত ১২ নভেম্বর। এ বিষয়ে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা তাস এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ৫০ বছরে এই প্রথম কোনো রুশ যুদ্ধ জাহাজ বাংলাদেশের বন্দরে এলো। তাস জানায়, প্যাসিফিক ফ্লিট নামে ওই নৌবহরে অ্যাডমিরাল ট্রাইবাটস ও অ্যাডমিরাল প্যান্টেলেভ নামে দুটি সাবমেরিন বিধ্বংসী যুদ্ধজাহাজ ছিল। সেইসঙ্গে ছিল পেচেঙ্গা নামে একটি ট্যাঙ্কার। নৌবহরটি এরই মধ্যে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে নোঙর করে কয়েকদিন ছিল। এর আগে শেষবার বাংলাদেশে রুশ নৌবহর মোতায়েন করা হয়েছিল ৫০ বছর আগে। বাংলাদেশের নির্বাচনের আগমুহূর্তে চট্টগ্রাম বন্দরে রাশিয়ার যুদ্ধজাহাজ নোঙর করা নিয়ে প্রশাসনে বেশ আলোচনার জন্ম দেয়।
যুগ্ম সচিব পদে ২২১ কর্মকর্তার পদোন্নতি
গত ৪ সেপ্টেম্বর যুগ্ম সচিব পদে বড় ধরনের পদোন্নতি দিয়েছে সরকার। ২২১ জন উপসচিব ও সমপদমর্যাদার কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিয়ে যুগ্ম সচিব করা হয়েছে। ২২১ জনের মধ্যে ৬ জন কর্মকর্তা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের দূতাবাস ও হাইকমিশনে কর্মরত।
উপসচিব পদে ২৪০ কর্মকর্তার পদোন্নতি
গত ১১ নভেম্বর জনপ্রশাসনে উপসচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। মোট ২৪০ কর্মকর্তাকে সরকারের উপসচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এর মধ্যে একটি প্রজ্ঞাপনে ২৩১ জন এবং আরেকটি প্রজ্ঞাপনে ৯ জনকে পদোন্নতি দেওয়ার কথা জানানো হয়। এবার নতুন করে ২৯তম বিসিএসের প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদোন্নতির জন্য বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য ক্যাডারের বিভিন্ন বিসিএসের কর্মকর্তারাও এ পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। উপসচিব পদে সাধারণত প্রশাসন ক্যাডার থেকে ৭৫ শতাংশ এবং অন্যান্য ক্যাডার থেকে ২৫ শতাংশ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়।
পুলিশে বড় পদোন্নতি
গত ৬ নভেম্বর অতিরিক্ত উপপুলিশ মহাপরিদর্শক (অতিরিক্ত ডিআইজি) পদে (গ্রেড-৪) পদোন্নতি পেয়েছেন ১৫২ পুলিশ কর্মকর্তা। এর মধ্যে সুপার নিউমোরারি অতিরিক্ত ডিআইজি হয়েছেন ১৪০ জন। ১২ জন স্বাভাবিক পদোন্নতি পেয়েছেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ১৪০টি সুপারনিউমোরারি পদের বিপরীতে ১৪০ পুলিশ সুপারকে পদোন্নতি দেওয়া হলো। যে সব কর্মকর্তা মিশনে, শিক্ষাছুটি/প্রেষণ ও লিয়েনে কর্মরত আছেন সেসব কর্মকর্তা মূল কর্মস্থলে যোগদানের পর তাদের পদোন্নতি কার্যকর হবে এবং প্রকৃত যোগদানের তারিখের আগে কোনো আর্থিক সুবিধা পাবেন না।
এতে আরও বলা হয়, পদগুলোতে কর্মরত পদধারীদের পদোন্নতি, অবসর, অপসারণ বা অন্যকোনো কারণে পদ শূন্য হলে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিলুপ্ত হবে এবং পদ সৃষ্টির তারিখ থেকে ১৪০টি সুপারনিউমোরারি পদের মেয়াদ হবে এক বছর। পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তারা স্বপদে বহাল থেকে দায়িত্ব পালন করবেন।
সুপারনিউমোরারি পদ বলতে বুঝায় পদগুলোতে কর্মরত পদধারীদের পদোন্নতি, অবসর, অপসারণ বা অন্য কোনো কারণে পদ শূন্য হলে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিলুপ্ত হবে।
আরেকটি প্রজ্ঞাপনে আরও ১২ জন পুলিশ সুপারকে অতিরিক্ত উপপুলিশ মহাপরিদর্শক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। তারা স্বাভাবিক পদোন্নতি পেয়েছেন।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, তাদের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিবের বরাবর যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে পদোন্নতিপ্রাপ্ত পদে যোগদানপত্র পাঠাতে হবে।