দেশে লবণ উৎপাদনে রেকর্ড
চলমান তাপপ্রবাহে দেশের মানুষ অতিষ্ট হলেও এ তাপপ্রবাহ হাসি ফুটিয়েছে কক্সবাজারের লবণ চাষিদের মুখে। কারণ এই তাপপ্রবাহ এনে দিয়েছে ৬৩ বছরের লবণ চাষের ইতিহাসে উৎপাদনের রেকর্ড। চলতি অর্থবছরে দেশের লবণ উৎপাদনের পরিমাণ ছাড়িয়েছে ২৩ লাখ মেট্রিক টন। যা দেশের লবণ উৎপাদনের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
গতকাল মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনের (বিসিক) কক্সবাজার কার্যালয়ের উপ মহাব্যবস্থাপক মো. জাফর ইকবাল ভুঁইয়া এনটিভি অনলাইনকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
মো. জাফর ইকবাল ভুঁইয়া জানান, ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত দেশে লবণ উৎপাদন ২৩ লাখ ১০ হাজার মেট্রিকটন ছাড়িয়ে গেছে। সরকারি হিসেবে গত রোববার (২৮ এপ্রিল) পর্যন্ত চলতি বছর সর্বমোট উৎপাদন হয়েছে ২২ লাখ ৩৪ হাজার ৬৫৮ টন লবণ। লবণ উৎপাদন মৌসুমের এখনও সপ্তাহ দু’য়েক বাকি রয়েছে। তীব্র তাপপ্রবাহের এই ধারা অব্যাহত থাকলে চলতি বছরের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়ে কয়েক লাখ মেট্রিক টন বাড়তি লবণ উৎপাদনের সম্ভাবনা দেখছে বিসিক।
মো. জাফর ইকবাল ভুঁইয়া জানান, দেশের একমাত্র লবণ উৎপাদন এলাকা কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপকূলে চলমান দাবদাহ যেন আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। মাঠে গরমের তাপ আর বাতাসে লবণের উৎপাদন আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। মৌসুমের শেষ পর্যায়ে এসে প্রতিদিন গড়ে ৩৫ হাজার মেট্রিক টন লবন উৎপাদন হচ্ছে। গত বছর এই সময়ে যা ছিল গড়ে ৩০ থেকে ৩২ হাজার মেট্রিক টন।
বিসিক সূত্রে জানা গেছে, গত ২০২২-২৩ মৌসুমে দেশে লবণ উৎপাদন হয়েছিল ২২ লাখ ৩২ হাজার ৮৯০ টন। আর চলতি মৌসুমে ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত লবণ উৎপাদন হয়েছে ২২ লাখ ৩৪ হাজার ৬৫৮ টন। যা গত মৌসুমের লবণ উৎপাদনকে ছাড়িয়ে যায়। মাঠ পর্যায়ে প্রচুর লবণ উৎপাদন হওয়ায় চাষি থেকে শুরু করে লবণ ব্যবসায়ী ও লবণের ওপর নির্ভরশীল কক্সবাজারের মানুষরা অত্যন্ত খুশি। তবে মৌসুমের শেষ পর্যায়ে এসে লবণের দাম কমে যাওয়ায় হতাশ চাষিরা।
বিসিকের কক্সবাজার কার্যালয়ের উপ মহাব্যবস্থাপক মো. জাফর ইকবাল ভুঁইয়া জানান, কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলায় চলতি বছর লবণ উৎপাদন হচ্ছে ৬৮ হাজার ৩৫৭ একর জমিতে। গত বছর উৎপাদন হয়েছিল ৬৬ হাজার ৪২৪ একর জমিতে। জমির পরিমাণ বৃদ্ধির পাশাপাশি চলতি মৌসুমে লবণ চাষির সংখ্যাও বেড়েছে।
মো. জাফর ইকবাল ভুঁইয়া জানান, বাড়তি লবণ উৎপাদন ও সরবরাহের কারণে মাঠ পর্যায়ে ক্রুড লবণের দাম কমে এসেছে। বর্তমানে মাঠ পর্যায়ে লবণ মণপ্রতি ৩০০ থেকে ৩১০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। চাষিরা যদি ধাপে ধাপে লবণ বিক্রি করে তবে দাম বাড়তে পারে। গত ২০২২-২৩ মৌসুমের এই সময়ে মাঠ পর্যায়ে ক্রুড লবণের মণপ্রতি দাম ছিল সর্বনিম্ন ৪২০ টাকা। তিনি জানান, চলতি মৌসুমে দেশে লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ২৫ লাখ ২৮ হাজার মেট্রিক টন। মৌসুম শুরুর পর নভেম্বরের মাঝামাঝি বিরূপ আবহাওয়া, একাধিক ঘূর্ণিঝড়ের কারণে লবন উৎপাদন ব্যাহত হয়েছিল। ওই সময়ে কৃষক পর্যায়ে মাঠ থেকে অল্প অল্প লবণ উত্তোলন হলেও বর্তমানে তীব্র গরমে ভালোমানের দানাদার লবণ উৎপাদন হচ্ছে। স্বাভাবিক সময়ে প্রতি ৭-১০ দিনে মাঠে লবণ পুষ্ট হলেও বর্তমানে সেটি নেমে এসেছে এক দিনে। আর শেষ কয়েকদিনে ১০-১২ ঘণ্টার মধ্যেও মাঠ থেকে লবণ সংগ্রহের রেকর্ড তৈরি হয়েছে।
বিসিকের কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে তীব্র তাপপ্রবাহ কৃষি, মৎস্য, পোল্ট্রিসহ বিভিন্ন খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেললেও লবণ উৎপাদনের জন্য আর্শীবাদ হয়ে এসেছে।
বাংলাদেশ লবণ চাষি কল্যাণ পরিষদের সভাপতি মোস্তফা কামাল চৌধুরী জানান, বর্তমানে মাঠে প্রচুর পরিমাণে লবণ উৎপাদন হচ্ছে। মৌসুমের শুরুতে চাষিরা লবণের ভালো দাম পেলেও এখন লবণের দাম একটু কম। রেকর্ড লবণ উৎপাদন হওয়ায় মাঠ পর্যায়ের চাষিরা খুশি। লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হলে লবণ আমদানির কোনো প্রয়োজন হবে না বলে মনে করেন তিনি। তিনি জানান, মাঠে এখন প্রচুর লবণ পড়ে আছে। বৃষ্টি কিংবা কালবৈশাখী ঝড়ে মাঠের লবন নষ্ট হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। মাঠের গর্তে কিংবা গুদাম বা মিল পর্যায়ে লবণ মজুদ করে ফেলতে পারলে দেশের উৎপাদিত লবণ সংরক্ষিত থাকবে বলেও মনে করেন তিনি।
এদিকে বিসিকের জনসংযোগ কর্মকর্তা পারুল আক্তার কেয়া স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপিতে বলা হয়, জাতীয় লবণনীতি, ২০২২ অনুযায়ী শিল্প মন্ত্রণালয়ের দিকনির্দেশনায় বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) লবণ শিল্পের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে থাকে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতেগড়া প্রতিষ্ঠান বিসিকের মাধ্যমেই ১৯৬১ সাল থেকে দেশে পরিকল্পিতভাবে লবণ উৎপাদন কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে কক্সবাজারে অবস্থিত বিসিকের লবণ শিল্পের উন্নয়ন কর্মসূচি কার্যালয়ের আওতাধীন ১২টি লবণ কেন্দ্রের মাধ্যমে কক্সবাজার জেলার সব উপজেলায় এবং চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে লবণ চাষের জন্য লবণ চাষিদের প্রশিক্ষণ, ঋণ প্রদান এবং প্রযুক্তি সম্প্রসারণসহ সার্বিক সহায়তা প্রদান করা হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, বিগত ৬২ বছরের মধ্যে ২০২২-২৩ অর্থবছরে লবণ উৎপাদনের সর্বোচ্চ রেকর্ড ছিল ২২ লক্ষ ৩২ হাজার ৮৯০ মেট্রিকটন। চলতি লবণ মৌসুমের ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত ২২ লাখ ৩৪ হাজার ৬৫৮ মেট্রিকটন লবণ উৎপাদনের মাধ্যমে বিগত বছরের সব রেকর্ড অতিক্রম করেছে এবং লবণ উৎপাদন অব্যাহত রয়েছে। চলতি লবণ মৌসুমে লবণ চাষকৃত মোট জমির পরিমাণ ৬৮ হাজার ৩৫৭ একর, গত বছর ছিল ৬৬ হাজার ৪২৪ একর। গত বছরের তুলনায় এ বছর লবণ চাষের জমি বৃদ্ধি পেয়েছে এক হাজার ৯৩৩ একর। চলতি লবণ মৌসুমে লবণ চাষির সংখ্যা ৪০ হাজার ৬৯৫ জন, যা গত বছর ছিল ৩৯ হাজার ৪৬৭ জন। গত বছরের তুলনায় এ বছর লবণ চাষির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে এক হাজার ২২৮ জন। বর্তমানে লবণ মাঠ পর্যায়ে মণপ্রতি ক্রুড লবণের গড় মূল্য ৩১২ টাকা, যা গত বছর ছিল ৪২০ টাকা।