হাঁসের খামারে ভাগ্য পাল্টে যাচ্ছে ভৈরবের খামারিদের
হাঁসের খামারে ভাগ্য পাল্টে যাচ্ছে কিশোরগঞ্জের ভৈরবের পানিবেষ্টিত গ্রামাঞ্চলের খামারিদের। আর এই সাফল্যের ধারায় উৎসাহিত হয়ে অনেকেই গড়ে তুলেছেন খামার। এতে করে দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে খামার ও খামারির সংখ্যা। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে হাঁস ও ডিম বিক্রি হচ্ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।
অপরদিকে প্রাণিজ পুষ্টির ঘাটতি পূরণসহ জাতীয় কৃষি অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন এইসব উদ্যোগী খামারিরা। দূর হচ্ছে বেকারত্ব। গ্রামীণ অর্থনীতি হচ্ছে চাঙ্গা।
ভৈরব উপজেলার শিমুলকান্দি ইউনিয়নের গোছামারা গ্রামের বাসিন্দা শওকত আলী। তিনি কোদালকাটি নদীর স্টিলের ব্রিজ সংলগ্ন এলাকায় ৬ বছর ধরে হাঁসের খামার করছেন। নদীর প্রাকৃতিক খাবারের পাশাপাশি তিনি বাজারে প্রচলিত ফিডও খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করেন।
শওকত আলী জানান, ৬ বছরের মধ্যে তার খামারে লোকসান হয়নি। তিনি ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা পিস হাঁসের বাচ্চা কেনেন। ৫ থেকে সাড়ে পাঁচ মাস বয়স থেকে প্রতিটি হাঁস ডিম দেওয়া শুরু করে। ডিম বিক্রি করেন ৬০ থেকে ৬৫ টাকা হালি। টানা দুই বছর ডিম দিলে বিনিয়োগের টাকা উঠে মুনাফা চলে আসে। তখন হাঁসগুলো পাইকারি ও খুচরা ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায় বিক্রি করে দেন। যার পুরোটাই থাকে মুনাফা। ফলে মুনাফা দাঁড়ায় মোট বিনিয়োগের দ্বিগুন টাকা। হাঁসের একমাত্র মরণরোগ ‘বার্ডফ্লু’ হয়ে খামারে মড়ক না লাগলে হাঁসের খামারে কোনো লোকসান নেই।
আগামী বছর থেকে তিনি হাঁসের খামারের নিচে তেলাপিয়া জাতীয় অল্প সময়ে বাড়ন্ত মাসের চাষ করার পরিকল্পনা করছেন বলে জানান। যা হাঁসের অবশিষ্ট খাবার খেয়েই বেড়ে উঠবে বলে তার অভিমত।
রোমান আহমেদের বাড়ি ভৈরবের আগানগর ইউনিয়নের দক্ষিণ আগানগর গ্রামে। গ্রামের একপাশে মেঘনা আর অপর পাশে শীতলপাটি নদী। গ্রামের দুই নদীর মধ্যবর্তী স্থানে তাদের বাড়িটির চারপাশে প্রায় ৬ মাসই থাকে থৈ থৈ পানি। যা হাঁসের খামারের জন্য খুবই উপযোগী। আর এই প্রাকৃতিক সুবিধাটিই তাকে হাঁসের খামারি হিসেবে সফলতা এনে দিয়েছে।
রোমান জানান, এইচএসসি পাস করার পর আজ থেকে ৯ বছর আগে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরব পাড়ি জমান ভাগ্য বদলের স্বপ্ন নিয়ে। কিন্তু তিনি সেখানে খুব একটা সুবিধা করতে না পেরে দুই বছর পর হতাশ হয়ে ফিরে আসেন দেশে।
৭ বছর আগে তিনি প্রথমে ৫০০ হাঁস নিয়ে শুরু করেন খামার। পরে আর তাকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বর্তমানে তিনি ৩ হাজার হাঁসের একটি বড় খামার পরিচালনা করছেন।
রোমান জানান, হাঁসের খামারের দুটি প্রধান শর্ত হলো প্রাকৃতিক পানি আর খাবার। অর্থাৎ অঞ্চলটা হতে হবে হাওরাঞ্চল। আর হাঁসের খাবার ৮০ শতাংশ আসতে হবে প্রকৃতি থেকে। এমন সুবিধায় খামার করলে সফলতা কেউ ঠেকাতে পারবে না।
এনামুল উপজেলার শিমুলকান্দি ইউনিয়নের মধ্যেরচর গ্রামের বাসিন্দা। তিনি ১০-১২ বছর যাবত হাঁসের খামারের সঙ্গে জড়িত। বর্তমানে তার ২০০ হাঁস নিয়ে ছোট্ট খামার। এরমধ্যে ১৮০টি হাঁস নারী। ওরা প্রতিদিন একটি করে মোট ১৮০টি ডিম দেয়। প্রতিটি ডিম বর্তমান বাজারদরে ১৫ টাকা ৫০ পয়সা করে বিক্রি করছেন।
এনামুল জানান, ডিম বিক্রি করে প্রতিদিন তার গড়ে আয় হচ্ছে ২৫০০-২৭০০ টাকা। হাঁসের পিছনে তার খরচ হয় প্রতিদিন ১৫০০-১৬০০ টাকা। ফলে অন্যান্য খরচ বাদে তার প্রতিদিনের মুনাফা হচ্ছে ৯০০ থেকে ১০০০ টাকা।
এনামুল আরও বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে কেউ গেলে ৫-৭ লাখ টাকা খরচ হয়। বেতন পায় ২০-২৫ হাজার টাকা। শ্রম দিতে হবে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা। আর দেশে থেকে ৫০০ হাঁসের একটি খামার করলে খরচ হবে তিন লাখ টাকা। এতে দৈনিক মুনাফা পাওয়া যাবে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা। অর্থাৎ মাসিক আয় হবে ৬০ হাজার থেকে ৭৫ হাজার টাকা। বাড়তি লাভ হলো পরিবার পরিজনের সাথে থাকা।
চারটি প্রধান নদীবেষ্টিত হওয়ায় ভৈরব হাঁস পালনের জন্য খুবই উপযোগী। তাই এখানে ১০টি বড়সহ সাড়ে ৪০০ মাঝারি-ছোট হাঁসের খামার গড়ে উঠেছে। এছাড়াও নদীঘেঁষা গ্রামগুলোর প্রতিটি কৃষক পরিবার স্বল্প পরিসরে হাঁস পালনের সাথে জড়িত থেকে নিজেদের পারিবারিক পুষ্টির চাহিদা পূরণসহ আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন।
এ তথ্য জানিয়ে উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. মনিরুজ্জামান তরফদার জানান, তারা হাঁসের খামারিদের গভীর পরিচর্যায় রেখে সব রকমের সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। খামারগুলোর যত্নে তাঁর অফিস উপজেলার ৭টি ইউনিয়নে একজন করে ৭ জন মাঠকর্মী নিয়োগ দিয়েছেন। যাদের কাজ হলো নিয়মিত খামারগুলো পরিদর্শন ও প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিনসহ নানা পরামর্শ দেওয়া।
প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আরও বলেন, এতে করে এখানে দিন দিন হাঁসের খামার আশানুরূপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। হাঁস ও ডিম স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বিক্রি হচ্ছে অন্যান্য এলাকায়। ফলে খামারিদের যেমন ভাগ্য বদলে যাচ্ছে, তেমনি তারা জাতীয় পুষ্টি চাহিদা পূরণসহ অর্থনীতিতে রাখছেন বড় ভূমিকা।