শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছি, ৫ আগস্ট বলেছিলেন রাষ্ট্রপতি
গণঅভ্যুত্থানের মুখে প্রধানমন্ত্রীত্ব ছেড়ে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর ৫ আগস্ট রাতে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। সেই ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘আপনারা জানেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন এবং আমি তা গ্রহণ করেছি।’ বিটিভিসহ দেশের ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যমগুলোতে সেই ভাষণ সম্প্রচার হয়, যা এখনও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল। যদিও সম্প্রতি মানবজমিনের প্রকাশনা জনতার চোখের প্রচ্ছদ প্রতিবেদনে ‘নেপথ্যের গল্প’তে প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী জানান, রাষ্ট্রপতি তাকে জানিয়েছেন, তিনি শুনেছেন শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন, কিন্তু তার কাছে কোনো দালিলিক প্রমাণ নেই।
রাষ্ট্রপতির বরাতে এমন বক্তব্য প্রকাশের পর তা নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে, বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছে তীব্র প্রতিক্রিয়া। আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ ইস্যুতে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন মিথ্যাচার করেছেন বলে মন্তব্য করেছেন।
আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘আমার কথা হচ্ছে রাষ্ট্রপতি যে বলেছেন—উনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র পাননি। এটা মিথ্যাচার। এটা উনার শপথ লঙ্ঘনের শামিল।’ তিনি বলেন, ‘উনি নিজেই ৫ আগস্ট রাত ১১টা ২০ মিনিটে পেছনে তিন বাহিনীর প্রধানকে নিয়ে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী উনার কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন এবং উনি তা গ্রহণ করেছেন।’
গত শনিবার (১৯ অক্টোবর) জনতার চোখ ডট কমে ‘উনি তো কিছুই বলে গেলেন না...’ শিরোনামে প্রকাশিত ‘নেপথ্যের গল্প’তে মানবজমিন পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী লেখেন, ‘প্রশ্ন উঠেছে প্রধানমন্ত্রী যদি পদত্যাগ করে থাকেন তাহলে সেটা গেল কোথায়? কারও কাছে এই প্রশ্নের জবাব নেই। তিন সপ্তাহ ধরে অনুসন্ধান চালিয়েছি। খোঁজ নিয়েছি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগেও। যেখানটায় প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের পদত্যাগপত্র থাকার কথা। কোথাও নেই। শেষ পর্যন্ত বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্ট সাহাবুদ্দিনের মুখোমুখি হলাম। অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে তিনি আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন।’
মতিউর রহমান চৌধুরী আরও লেখেন, ‘শেখ হাসিনার জমানায় বঙ্গভবন ছিল আমার জন্য নিষিদ্ধ। স্যার, আপনি কেমন আছেন? ভাই, আপনি আমাকে স্যার বলবেন না। আমরা তো দু’জনই একসঙ্গে সাংবাদিকতায় এসেছিলাম। আমি পাবনায় আর আপনি ঢাকায়। বাংলার বাণীতে দু’জনই কাজ করেছি। পুরনো স্মৃতি স্মরণ করে আবেগ জায়গা করে নিলো অনেকক্ষণ। স্বাভাবিক হতেই প্রশ্ন করলাম আপনার কাছে কি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগপত্রটা আছে? আমি শুনেছি তিনি পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু আমার কাছে কোনো দালিলিক প্রমাণ নেই। বহু চেষ্টা করেও আমি ব্যর্থ হয়েছি। তিনি হয়তো সময় পাননি। ৫ আগস্ট সকাল সাড়ে দশটায় বঙ্গভবনে ফোন এলো প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন থেকে। বলা হলো, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গভবনে আসবেন মহামান্য প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য। এটা শুনেই প্রস্তুতি শুরু হলো বঙ্গভবনে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ফোন এলো তিনি আসছেন না।’
অথচ, গত ৫ আগস্টে জাতির উদ্দেশে ভাষণে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, ‘আপনারা জানেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগ জমা দিয়েছেন এবং আমি তা গ্রহণ করেছি। প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে আজ বঙ্গভবনে তিন বাহিনীর প্রধান এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কয়েকজন সমন্বয়কের সাথে আলোচনা হয়। শুরুতেই সেনাপ্রধান বিরাজমান সার্বিক পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তার আলোচনা সম্পর্কে আমাকে অবিহিত করেন। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দও এ সময় তাদের বক্তব্য তুলে ধরেন। সভায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত শহীদদের স্মরণে শোক প্রস্তাব গৃহীত হয়। এ ছাড়া জরুরি ভিত্তিতে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।’
ভাষণে রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, ‘সকল দল ও অংশীজনদের সাথে আলোচনা করে গঠিত অর্ন্তবন্তীকালীন সরকার যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও বিভিন্ন মিথ্যা মামলায় আটকসহ সকল বন্দিদের মুক্তি দেওয়া হবে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহতদের পরিবারদের ক্ষতিপূরণ প্রদান ও আহতদের সুচিকিৎসার প্রয়োজনীয় সকল সহায়তা দেওয়া হবে।’ তিনি বলেন, সর্বসম্মতিক্রমে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।’
মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, ‘আমি দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে এবং লুটতরাজ ও ধ্বংসত্মক কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। জনগণের জানমাল ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষায় সশস্ত্র বাহিনীকে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ প্রদান করছি।’
রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি ও সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং সরকারি সম্পত্তি রক্ষায় সকলকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি। দেশের অর্থনীতি প্রশাসন ও শিল্প কলকারাখানা চালু রাখার লক্ষ্যে সকলকে কার্যকর ভূমিকা রাখার আহ্বান জানাই। ছাত্রনেতৃবৃন্দ ও শিক্ষকদের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে অতিশ্রীঘ্রই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়া হবে। এ ছাড়া যারা হত্যা ও সহিংসতার সাথে জড়ির নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হবে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী অনতিবিলম্বে বর্তমান সংসদ বিলুপ্ত করা হবে। দেশের সকল অফিস আদালত আগামীকাল থেকে স্বাভাবিকভাবেই চলবে।
আসুন আমরা দেশকে বাঁচাতে একযোগে কাজ করি। পারস্পারিক হিংসা বিদ্বেষ ভুলে ও প্রতিহিংসার ঊর্ধ্বে উঠে দেশকে এগিয়ে নিতে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখার জন্য আমি বিনয়ের সাথে আপনাদের প্রতি অনুরোধ করছি।’
একটি সুন্দর ও সোনালি ভবিষ্যতের প্রত্যাশায় আমরা এগিয়ে যাব ইনশাআল্লাহ। মহান আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।