বাণিজ্যমেলা নয়, যেন এক মাসের বাজার
বাণিজ্যমেলা যেন লক্ষ্য হারিয়ে ফেলছে। মূল উদ্দেশ্য থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এখন উদ্যোক্তা ও পণ্যের পরিচিতির চেয়ে বিক্রির দিকেই ঝুঁকছে মেলায় অংশ নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে আন্তর্জাতিক এই মেলা এক মাসের বাজারে পরিণত হয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
১৯৯৫ সাল থেকে প্রতি বছর ১ জানুয়ারি শুরু হয়ে মাসব্যাপী চলে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলা। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) যৌথভাবে এবার ২১তম মেলার আয়োজন করেছে।
এ মেলা প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘দেশের এ মেলায় বিদেশিরা এলে, তারা পণ্য দেখলে এক ধরনের প্রচার হতো। বিদেশিরা স্টল দিলেও সুফল আসত। তবে এ মেলার মাধ্যমে রপ্তানিতে খুব বেশি প্রভাব না পড়লেও দেশীয় পণ্যের প্রসারে একটি ভূমিকা রাখে। অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রে এ মেলার একটি ভূমিকা থাকে। মেলার কারণে লোকজন বেশি কেনাকাটা করবে। এতে বাড়তি চাহিদা সৃষ্টি করবে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে একটি ভূমিকা রাখবে। তবে আশার তুলনায় এটা বড় কিছু না। সার্বিক প্রবৃদ্ধি বিবেচনায় এর ভূমিকা তেমন কিছু না।’
ছাড়ের মাধ্যমে মুনাফার চেষ্টা
বিশ্লেষকরা মনে করেন, প্রতিবছর মাসব্যাপী আয়োজিত ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলার লক্ষ্য মূলত দেশীয় পণ্যের মানোন্নয়ন, রপ্তানি বৃদ্ধি, পণ্যের বহুমুখীকরণ এবং নতুন বাজারের অনুসন্ধান করা। তবে এর পরিবর্তে বিভিন্ন প্রলোভন ও ছাড়ের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি থেকে মুনাফা করার দিকেই ব্যবসায়ীরা বেশি ঝুঁকছেন।
বিভিন্ন কোম্পানি নামে-বেনামে একাধিক প্যাভিলিয়ন বা স্টল নেওয়ায় ক্ষুদ্র ও নতুন উদ্যোক্তারা পণ্য প্রচারের সুযোগ হারাচ্ছে। মেলার লক্ষ্য অর্জন নিয়েও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তেমন কোনো পদক্ষেপ নেই বলে অভিযোগ রয়েছে।
বিষয়টি অস্বীকার করে মেলার সদস্যসচিব মো. রেজাউল করিম বলেন, ‘এমনটি হওয়ার সুযোগ নেই। তবে সীমাবদ্ধতার কারণে প্রতি বছরই চাহিদা মোতাবেক স্টল দেওয়া সম্ভব হয় না। মেলায় সাধারণত তিন ধরনের স্টল বরাদ্দ হয়। স্থানীয়, বিদেশি ও বিশেষ বা সংরক্ষিত স্টল। স্টল পেতে অনলাইন বা সরাসরি দুইভাবে আবেদন আহ্বান করা হয়। আবেদনের সঙ্গে বিধি অনুযায়ী কাগজপত্র দাখিল হয়। ২৩টি শর্তপূরণের বিপরীতে স্থানীয় ও বিদেশি আবেদনকারীর স্টল দেওয়া হয়। এমনকি নিয়ম অনুযায়ী বরাদ্দ পাওয়া স্টলও অন্যকে ভাড়া বা হস্তান্তর করতে পারবে না এমন নির্দেশনাও রয়েছে।’
হাতে গোনা বিদেশি স্টল
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নামে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলা হলেও বিদেশি স্টলের সংখ্যা হাতেগোনা। এসব স্টলের পণ্যও দর্শনার্থীদের তেমন আকর্ষণ করে না। দেশীয় প্রতিষ্ঠানই বিদেশের নামে ব্যবসা করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
ইপিবির তালিকায় ২১টি দেশের ৫৪টি প্রতিষ্ঠান বিদেশি হলেও এর বেশির ভাগই দেশীয় এজেন্ট। মাত্র কয়েকটি বিদেশি প্রতিষ্ঠান তাদের স্টল পরিচালনা করছে। এসব স্টলের পণ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মসলা, অ্যালুমিনিয়াম, কাপড়, চকলেট, আচার ইত্যাদি। এ ক্ষেত্রেও পণ্য প্রদর্শনীর চেয়ে বিক্রি করে মুনাফা তোলাই মূখ্য উদ্দেশ্য।
এ বিষয়ে মালয়েশিয়া প্রবাসী দর্শনার্থী মুন্নাফ খান বলেন, ‘মেলা আয়োজনে অনেক অপূর্ণতা রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলা হলেও, সে তুলনায় বিদেশি দর্শনার্থী নেই। বিদেশিদের নিয়ে মেলাগুলো যেমন হয়, তেমন না। এখন এই মেলাকে আমরা এক মাসের বাজার বলতে পারি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, ‘মেলাতে পণ্য প্রদর্শন হবে। পণ্য বিক্রিও হবে। তবে দেশের পণ্য রপ্তানির সাথে এই মেলার তেমন সম্পর্ক নেই। অনেক আগে রপ্তানি বাড়ানোর লক্ষ্যে মেলা অনুষ্ঠিত হতো। কিন্তু এখন তা নেই।’
রপ্তানি বেড়েছে, বৈচিত্র্য কম
ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলার উদ্দেশ্য অনেকাংশে ব্যহত হচ্ছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহমুদ ওসমান ইমাম।
‘বিভিন্ন দেশের খাতের পণ্য রপ্তানি বেড়েছে। তবে বৈচিত্র্য কম। ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলার মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন পণ্যের পরিচিতি ও প্রচার হতে পারত। তেমন কিছু হচ্ছে না। কিছু প্রতিষ্ঠানের আধিপত্যের কারণে নতুন ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা সুযোগ হারাচ্ছে’, বলেন ওসমান ইমাম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই অধ্যাপক বলেন, ‘আমরা যখন বিদেশি বাণিজ্যমেলায় যাই তখন দেখি তারা স্থায়ীভাবে তা স্থাপন করেছে। জাপান ও বেলজিয়ামে এমনটি দেখেছি। তারা আলাদা করে বাণিজ্যমেলা স্থাপন করে। কিন্তু দেশে তা হচ্ছে না। আর বাণিজ্যমেলার মান নিয়েও কাজ হচ্ছে না। এখন যা হচ্ছে তা অনেকটা বাজারের মতো।’
‘মেলা মূলত দুই ধরনের’
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর ভাইস চেয়ারম্যান মাহরুফা সুলতানা বলেন, ‘বাণিজ্যমেলার উদ্দেশ্য হলো দেশীয় প্রতিষ্ঠানকে উৎসাহিত করা। এ মেলা দীর্ঘ সময়ের হওয়ায় পণ্য প্রদর্শনীর সাথে সাথে বিক্রয়েরও লক্ষ্য থাকে।’
সুলতানা আরো বলেন, ‘মেলা মূলত দুই ধরনের হয়। প্রদর্শনী ও বাণিজ্যমেলা। আমাদের এটি বাণিজ্যমেলা। প্রদর্শনী মূলত দুইদিন থেকে এক সপ্তাহ হয়ে থাকে। যেখানে বড় প্রতিষ্ঠানগুলো পণ্য বা সেবা প্রদর্শন করে। কোনো ক্ষেত্রে ক্রয় আদেশ নেয়। কিন্তু স্পটে কোনো পণ্য বিক্রয় হয় না।’
রপ্তানি বাড়ানোর উদ্যোগ জরুরি
ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলায় দেশীয় উদ্যোক্তারা বিদেশি পণ্যের নকশা, রুচি, মান ও চাহিদার বিষয়ে তেমন ধারণা পাচ্ছে না বলেও অভিযোগ রয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে কথা হয় সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) জ্যেষ্ঠ গবেষক খন্দকার মোয়াজ্জেম হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এ ধরনের মেলা দেশি-বিদেশি ক্রেতার কাছে পণ্যের পরিচিতি বাড়ায়। রপ্তানি বাড়ানোর ক্ষেত্রে যেসব দেশে আমাদের পণ্যের চাহিদা রয়েছে, সেখানকার আমদানিকারদের নিয়ে আসা। অর্থাৎ রপ্তানিযোগ্য পণ্যের সাথে আমদানিকারকদের পরিচয় করানো জরুরি। মূলত বাণিজ্যমেলার মাধ্যমে সে কাজটি পুরোপুরি হচ্ছে না। এখন যেটা হচ্ছে ভোক্তারা একই জায়গায় অনেক পণ্য পাচ্ছে।’
মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘বাণিজ্যমেলাকে রপ্তানিযোগ্য করতে বিশেষায়িত পণ্যের উদ্যোগ দরকার। এর মধ্যে বিশেষ পণ্য বাছাই করা, বিদেশিদের জন্য আলাদা সময় রাখা ও বিভিন্ন সুবিধার তথ্য দেওয়া। রাজধানীর কাছে পূর্বাচলে মেলার একটি স্থায়ী কমপ্লেক্স করার কথা বলা হচ্ছে। এটা ভালো দিক। রপ্তানি বাড়ানোর ক্ষেত্রে এর মাধ্যমে বিস্তৃত পরিসরে কাজ করা যাবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে এটা যাতে দৈনিক ভিত্তিতে পণ্য বিক্রির স্থান হয়ে না পড়ে। সেখানে যাতে নতুন উদ্যোক্তারা সুযোগ পান। উৎপাদক যাতে বিদেশি ক্রেতার কাছে সরাসরি তাঁর পণ্যের পরিচিতি তুলে ধরতে পারেন।’
মেলা আয়োজনে নতুনত্ব আনা জরুরি বলে মনে করেন মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, ‘যেহেতু কিছু বিদেশি প্রতিষ্ঠানও মেলায় আসে তাই এটাকে একটি মানে আনতে হবে। মেলার মাধ্যমে একটি দেশের পণ্য রপ্তানিতে যে কাঠামো দরকার তা এখনো তৈরি হয়নি। কারণ রপ্তানি বাড়ানোর ক্ষেত্রে বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্তর্ভুক্তি প্রয়োজন। নতুন ও ছোট উদ্যোক্তাদেরও সুযোগ থাকা জরুরি।’
রপ্তানি বাড়ার আশা
মেলার আয়োজক সূত্রে জানা যায়, ২০১৫ সালে ১৪টি ক্যাটাগরিতে ৫০০টি স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়। চলতি বছর ৩১ দশমিক ৫৩ একর জায়গায় নির্মিত হয়েছে ৫৫৩টি প্যাভিলিয়ন ও স্টল। এর মধ্যে ২১টি দেশের ৫৪টি বিদেশি প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে। প্রথমবারের মতো মেলায় এসেছে ভারতের রপ্তানি খাতের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ইন্ডিয়ান ট্রেড প্রমোশন অরগানাইজেশন।
দেশীয় পণ্যের প্রচার বাড়াতে প্রতি বছর ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে মেলার অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়।
ইপিবি সূত্রে জানা যায়, বাণিজ্যমেলার মধ্যমে ২০১৪ সালে ৮০ কোটি টাকা ও ২০১৫ সালে ৯৫ কোটি টাকার রপ্তানি আদেশ আসে। এবার তার পরিমাণ আরো বাড়বে বলে মনে করছেন তাঁরা।
ইপিবির ডেপুটি সেক্রেটারি ও মেলা কমিটির সদস্য সচিব মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, ‘রপ্তানি বাড়াতে মেলা আয়োজন হয় না। মেলায় পণ্য ও চাহিদার ধরণ সম্পর্কে আরেক প্রতিষ্ঠান ধারণা নেয়। রপ্তানির বাজারকে সম্প্রসারিতি করতে বিভিন্ন দেশে মেলা ও প্রদর্শনীতে বাংলাদেশ অংশ নেয়।’