ফিলিপাইনের আরসিবিসির ব্যবস্থাপক ‘বলির পাঠা’
যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের হ্যাক হওয়া অর্থ ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনের (আরসিবিসি) গ্রাহকদের নামে ছাড় হয়েছে। দেশটির মাকাতি সিটির জুপিটার স্ট্রিটের আরসিবিসির শাখা থেকে এ ঘটনা ঘটে। আরসিবিসির অভ্যন্তরীণ তদন্তের অংশ হিসেবে ওই শাখার ব্যবস্থাপককে এরই মধ্যে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তবে ওই শাখার ব্যবস্থাপককে ব্যবহার করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন তাঁর আইনজীবী।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হ্যাকড হওয়া ৯৫ কোটি ১০ লাখ ডলার ফিলিপাইনে অনুপ্রবেশ করেছে বলে বিভিন্ন গণমধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের খোয়া যাওয়া অর্থের মধ্যে আট কোটি ১০ লাখ ডলার ফিলিপাইনে ব্যাকিং চ্যানেলে ঢুকে পড়ে। আর দেশটির আরসিবিসি ব্যাংকের মাধ্যমে স্থানীয় গ্রাহকদের নামে ছাড় করা হয়েছে। ফিলিপাইনে এখন পর্যন্ত ধরা পড়া সবচেয়ে বড় অর্থ পাচারের ঘটনা এটি।
আজ রোববার ফিলিপাইনের সংবাদ মাধ্যম ইনকোয়্যারারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের অর্থ পাচার নিয়ে দেশটির ব্যাংকি খাতে তোলপাড় শুরু হয়েছে। আর আরসিবিসির অভ্যন্তরীণ তদন্ত নিয়ে ব্যাংকটির প্রধান নির্বাহী ও জুপিটার শাখার ব্যবস্থাপকের মধ্যে বাক্যবাণ চলছে।
আরসিবিসির জুপিটার শাখার ব্যবস্থাপক মায়া সান্তোস দিগুইতোর আইনজীবী হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন ফার্দিনান্দ তোপাসিও। আইনজীবীর মাধ্যমে মায়া সান্তোস আরসিবিসির প্রেসিডেন্ট লোরেঞ্জো তানের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডের বিষয়ে তদন্তের দাবি করেছেন।
কিন্তু লরেঞ্জো তানের আইনজীবী ফ্রান্সিস লিম দাবি করেছেন আরসিবিসি খুবই পেশাদারত্বের সঙ্গে তদন্ত পরিচালনা করছে।
ফিলিপাইনের এক রেডিওকে দেওয়া স্বাক্ষাৎকারে মায়া সান্তোস দাবি করেছেন আরসিবিসির প্রেসিডেটেন্টর গতিবিধিতে পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। তবে এ কথাকে তিনি অভিযোগ বলে মনে করেন না। সান্তোস বলেন, লোরেঞ্জো তান শুধু আরবিসির প্রেসিডেন্ট নন, তিনি ব্যাংকটির প্রধান নির্বাহী। ফলে যাবতীয় অর্থ লেনদেনের ব্যাপার তাঁর জানার কথা।
মায়া সান্তোসের আইনজীবী তোপাসিও সাংবাদিকদের বলেন, আরসিবিসির যথাযথ বিবেচনা বা মূল্যায়ন পাচ্ছেন না তাঁর মক্কেল মায়া। আর লোরেঞ্জো তানের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের ব্যাপারে তদন্ত করা হচ্ছে না।
তোপাসিও বলেন, আরসিবিসি যদি সত্য উন্মোচন করার ব্যাপারে আন্তরিক হয় তাহলে প্রমাণিত হবে অর্থ পাচারের ঘটনায় সান্তোস ‘বলির পাঠা’ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছেন। আরসিবিসির উচিত তানকে দ্রুত বরখাস্ত করা এবং তাঁর সঙ্গে কোনো ধরনের সম্পর্ক নেই এমন কোনো কর্মকর্তাকে দিয়ে ঘটনার তদন্ত করা।
শুক্রবার আরসিবিসির প্রেসিডেন্টের আইনজীবী লিম জানান, মুক্ত তদন্তের জন্য তান ছুটিতে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, পাচারকৃত আট কোটি ১০ লাখ ডলার অর্থ প্রাথমিকভাবে ফিলিপাইনের এক বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়কারীর কাছে পাঠানো হয়। পরে তা সোলেয়ার রিসোর্ট অ্যান্ড ক্যাসিনো, সিটি ও অব ড্রিমস ও মাইডাস— এ তিন ক্যাসিনোয় স্থানান্তর করা হয়। সেখানে এ অর্থ জুয়ার টেবিলে ব্যবহারের উদ্দেশে বেটিং চিপসে রূপান্তর করা হয়। পরবর্তী সময়ে এসব চিপসকে আবার নগদ অর্থে রূপান্তর করে হংকংয়ের একাধিক ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করা হয়।
সান্তোসের আইনজীবী জানান, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের অনুমোদন নিয়ে শাখা ব্যবস্থাপক লেনদেন করেন। ২০১৫ সালের মে মাসের মধ্যে সান্তোসকে পাঁচটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার নির্দেশ দেওয়া হয়। এ জন্য তাকে পাঁচটি পরিচয়পত্রও সরবরাহ করা হয়। অর্থ পাচারের এ ঘটনা প্রকাশ হওয়ার পর এসব পরিচয়পত্র ভুয়া বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তোপাসো বলেন, সান্তোস এখন মুখ খুলতে চাইছেন। কারণ তাঁর ধারণা, এ পুরো ঘটনায় তাঁকে ফাঁসানো হয়েছে। তবে অর্থ লেনদেনের এ কার্যক্রম সম্পন্ন করার বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশ ছিল। উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের না জানিয়ে এত বড় অঙ্কের অর্থ লেনদেন সম্ভব নয়।
চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কয়েকটি ব্যাংক থেকে পাচারকৃত আট কোটি ১০ লাখ ডলার আরসিবিসির পাঁচটি ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। আন্তর্জাতিক ওয়্যার ট্রান্সফারের মাধ্যমে এ অর্থ স্থানান্তর করা হয়। এ স্থানান্তরের বিষয়ে প্রতিনিধি ব্যাংকের দায়িত্ব পালন করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ব্যাংক অব নিউইয়র্ক, সিটিব্যাংক ও ওয়েলস ফারগো। আত্মসাত্কারীরা সুইফট ব্যবস্থার মাধ্যমে তাদের ফিলিপিনো প্রতিনিধিকে অর্থ স্থানান্তরের বিষয়ে অবহিত করে।
ফিলিপাইনে পৌঁছার পর কয়েক মাস আগে খোলা আরসিবিসির উল্লিখিত পাঁচটি হিসাবে এ অর্থ পাঠানো হয়। পরে তা স্থানীয় মুদ্রা পেসোয় রূপান্তরের জন্য পাঠানো হয় বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়কারী প্রতিষ্ঠান ফিলরেমে। এর পর আবারো আরসিবিসিতে পাঠিয়ে একজন চীনা-ফিলিপিনো ব্যবসায়ীর ব্যাংক হিসাবে এ অর্থ একত্র করা হয়।
অর্থ পাচারের ঘটনায় এরই মধ্যে উচ্চপদস্থ ব্লু রিবন তদন্ত কমিটি (সিনেট) গঠিত হয়েছে ফিলিপাইনে। এ বিষয়ে একটি গণশুনানি করার কথা রয়েছে সিনেটের। এ ছাড়া ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন ও ফিলিপাইনের রাষ্ট্রীয় অ্যামিউজমেন্ট অ্যান্ড গেমিং করপোরেশন পৃথকভাবে ঘটনাটির তদন্ত করছে।