কালো টাকার ‘নিরাপদ গন্তব্য’ ফিলিপাইন
যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে গচ্ছিত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার বা ৮০৮ কোটি টাকা চুরির ঘটনা বিশ্বের ব্যাংকিং খাতে বড় ধরনের নাড়া দিয়েছে। এ ঘটনায় উদ্বিগ্ন বিশ্বের অর্থ ব্যবস্থাপকরা। তবে ‘কেঁচো খুঁড়তে সাপ’ বেরিয়ে আসছে। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে ফিলিপাইনের অর্থ ব্যবস্থার বড় দুর্বলতা বেরিয়ে এসেছে। এতে ফিলিপাইনকে কালো টাকার ‘নিরাপদ গন্তব্য’ বলে মনে করছেন দেশটির আইনপ্রণেতারা।
আজ রোববার ফিলিপাইনের সংবাদপত্র ইনকোয়্যারারের অনলাইনে এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ রহস্যময় হ্যাকাররা চুরির সঙ্গে সঙ্গে ফিলিপাইনে পাঠিয়েছে। এতে ‘জন লি ক্যারি’ উপন্যাসের গোয়ান্দোকাহিনীর বাস্তব চিত্রায়ন হয়েছে। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ ফিলিপাইন কালো টাকার ‘নিরাপদ গন্তব্য’ হিসেবে উদঘাটিত হয়েছে।
ব্যাংক হিসাবধারীদের স্বার্থরক্ষায় বিশ্বের সবচেয়ে ‘কঠোর ব্যাংকিং গোপনীয়তা আইন’ রয়েছে ফিলিপাইনে। তবে এসব আইন দেশটির জুয়ারি প্রতিষ্ঠান ক্যাসিনোগুোলোর জন্য প্রযোজ্য নয়।
এএফপিকে দেওয়া এক স্বাক্ষাৎকারে দেশটির সিনেটর সের্জিও ওসমেনা বলেন, ‘আইনের বড় ফাঁক-ফোঁকর থাকার কারণে কালো বা মন্দ টাকার গন্তব্য হিসেবে ফিলিপাইন অত্যন্ত আকর্ষণীয়। এখানে সহজেই অর্থপাচার করা যায়।’
অর্থ পাচার ঠেকাতে দেশটির আইনে আরো কড়াকড়ি প্রয়োজন বলে মনে করেন সের্জিও ওসমেনা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, চোররা চুরি করে পার পেলে আর চিন্তা থাকে না। অর্থ ফিলিপাইনের ব্যাংক ও ক্যাসিনোগুলো দিয়ে দ্রুত দেশটির বাজারে মিশে যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। অর্থ ফেরত পাওয়ার জন্য চারদিন চেষ্টা করেছিল দেশটির সরকার। কিন্তু ততক্ষণে ওই অর্থ দেশটির ব্যাংক ও ক্যাসিনো দিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। আর গত ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের খোয়া যাওয়া অর্থ ছাড় নিয়ে মৃত্যু ভয়ের গল্প, ঘুষ, ছায়া ব্যবসা এবং ভিলেন অথবা ভুক্তোভোগী এক ব্যাংক ব্যবস্থাপকের গল্প শোনা গেছে।
ফিলিপাইনের মাকাতি নগরের জুপিটার স্ট্রিটের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনের (আরসিবিসি) শাখার ব্যবস্থাপক মায়া সান্তোস দেগুইতোর হাত দিয়েই দেশটিতে অর্থ ছাড় হয়। তিনি এরই মধ্যে দেশত্যাগের চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন। বিমানবন্দর থেকে তাঁকে ফেরত পাঠানো হয়।
দেগুইতো বলেন, ‘আমি কোনো অনিয়ম করিনি। যদি এটা দুঃস্বপ্ন হতো, আমি এখনই জেগে উঠতে চাই। আমি জীবনের হুমকি নিয়ে দিন কাটাচ্ছি।’
ইনকোয়্যারের প্রতিবেদনে বলা হয়, ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী যেই হোক না কেন দেগুইতোর শাখা দিয়ে অর্থ ছাড় হয়েছে। তিনি সবকিছুর জন্য ব্যাংকটির প্রেসিডেন্ট লরেঞ্জো তান দায়ী বলে অভিযোগ করছেন। তবে ব্যাংকটির প্রেসিডেন্ট তা অস্বীকার করেছেন।
অর্থ ছাড়ের ঘটনায় দেগুইতো এরই মধ্যে ফিলিপাইনের তদন্ত দলকে বিশ্বাস করাতে পেরেছেন যে তিনি আর যাইহোক ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী নন।
ফিলিপাইনের সিনেটর রাল্ফ রেক্তো বলেন, এটি একটি বড় ধরনের কর্মকাণ্ড। এটি ফিলিপাইনের কেউ একা করেনি।
জুপিটার শাখা থেকে অর্থ সরানোর সময় ব্যাংকটিতে স্থাপিত সিসিটিভি ক্যামেরা বন্ধ ছিল বলে দেশটির অর্থ পাচারবিরোধী পর্ষদ (এএমএলসি) এরই মধ্যে প্রমাণ পেয়েছে।
আর আরসিবিসির শাখা ব্যবস্থাপক ও ব্যাংক কর্তৃপক্ষের পাল্টা অভিযোগের কারণে এএমএলসির তদন্তকারী দল বিভ্রান্ত হয়েছে বলে ইনকোয়্যারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের খোয়া যাওয়া অর্থ ৫ ফেব্রুয়ারি ফিলিপাইনের আরসিবিসির জুপিটার শাখা দিয়ে দেশটির বাজারে প্রবেশ করে। এই অর্থ ওই ব্যাংক শাখার চারটি হিসাবে জমা হয়। ওই সব হিসাব শুধু এই অর্থ লেনদেনের উদ্দেশ্যেই খোলা হয়।
আরসিবিসির শাখায় যাওয়া অর্থের কিছু অংশ উইলিয়াম গো নামে এক চায়না ব্যবসায়ীর হিসাবে হস্তান্তর করা হয়। তবে ওই ব্যবসায়ী দাবি করেন তার স্বাক্ষর জাল করে ওই হিসাব খোলা হয়েছে।
আরসিবিসিতে যাওয়া অর্থের কিছু অংশ ফিলরেম নামে কটি বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়কারী ব্রোকারে যায়। তবে ওয়েকেং ঝু নামের এক লোকের মাধ্যমে তিন কোটি ডলার ফিলরেমে যায় বলে ব্রোকারটির প্রেসিডেন্ট সালুদ বাউতিস্তা সিনেটকে জানান। ওই লোক একটি ক্যাসিনোর জাংকেট অপারেটর। সেও চায়ানা বংশোদ্ভূত বলে সিনেট জানতে পেরেছে।
ফিলিপাইনের অর্থপাচারবিরোধী পর্ষদ (এএমএলসি) জানায়, ম্যানিলার সমুদ্র উপকূলের সোলারি নামের ক্যাসিনোতে দুই কোটি ৯০ লাখ ডলার প্রবেশ করে। সোলারি বিশ্বের বৃহত্তম জুয়ারি প্রতিষ্ঠান।
সিনেট জানায়, ক্যাসোনতে যাওয়ার সাথে সাথে অর্থ চিপে রূপান্তরিত হয়। আর জুয়া খেলার পর তা আবার টাকার নোটে ফেরত পাওয়া যায়।
ইস্টার্ন হাওয়াই লেজার নামে আরেকটি ক্যাসিনোতেও দুই কোটি ১০ লাখ ডলার যায়। ফিলিপাইনের শান্তা আনা শহরে এটি অবস্থিত।
সিনেটর সের্জিও ওসমেনা বলেন, ‘ঘটনা যেভাবে জড়িয়ে গেছে তাতে তা বরফের পহাড়ের মতো জটিল হয়ে গেছে।’
সের্জিও আরো বলেন, ‘অভিযোগ পাওয়া গেছে বলে আমরা বিস্তারিত ঘটনা জানলাম। তবে মিয়ানমার ও চীন থেকে যদি মাদক পাচারকারীরা অর্থ পাঠায় তখন তো কোনো অভিযোগ পাওয়া যাবে না।’
প্রাতিষ্ঠানিক বৈদ্যুতিক যোগাযোগ ব্যবস্থা সুইপের কোড হ্যাকের মাধ্যমে গত ৫ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভে গচ্ছিত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি করে দুর্বৃত্তরা। এর মধ্যে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার পাঠানো হয় ফিলিপাইনে। বাকি টাকার কিছু অংশ শ্রীলঙ্কায় যায়। তবে তা ফের আনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।