পরিবেশবান্ধব শিল্প বাড়াতে চান সাজিদ
কাজী সাজিদুর রহমান। বাড়ি খুলনার নিরালায়। দেশের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে ২০০৩ সালে বিএসসি শেষ করেন। আরো পড়াশোনার আগ্রহ ছিল। কিন্তু মনের মধ্যে ছিল উদ্যোক্তা হওয়ার তেষ্টা । শুরু করেন ছোট পর্যায়ে ঠিকাদারি দিয়ে। এর পর ইন্ডেন্টিং। তবে সব কিছু গুটিয়ে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠা করেন কেপিসি ইন্ডাস্ট্রি। এখন দেশের সেবা খাতের বড় বড় প্রতিষ্ঠানে একচেটিয়া কাগজের তৈরি কাপ, প্লেট, বক্স সরবরাহ করছে তাঁর প্রতিষ্ঠান। এ উদ্যোগের কারণেই চলতি বছর তিনি হয়েছেন বর্ষসেরা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা। গত ৩ এপ্রিল এসএমই ফাউন্ডেশন তাঁকে দিয়েছে ‘জাতীয় এসএমই উদ্যোক্তা পুরস্কার ২০১৬’। তরুণ এই উদ্যোক্তা তাঁর ব্যবসায় সংগ্রাম ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেছেন এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে।
সাক্ষাৎকারটি সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো :
প্রশ্ন : কাগজের কাপ, প্লেটের ব্যবসা শুরুর উৎসাহ পেলেন কোথায়?
সাজিদ : ২০১০ সালে সৌদি আরবে হজে যাই। ওই সময় একদিন পবিত্র মসজিদের প্রথম সারিতে বসে ইফতার পেয়েছিলাম। ইফতারের আইটেমগুলোর মধ্যে ছিল বড় এক কাপ খেজুর। নামাজ শুরুর আগে পানি ও কয়েকটি খেজুর দিয়ে ইফতার করি। তবে বাকি খেজুরগুলো কাগজের এই কাপে মুড়িয়ে পকেটে রাখি। সেখান থেকে রাতে হোটেলে আসার পর অনেক ক্ষুধা লাগে। হঠাৎ মনে পড়ে কাগজের কাপে মোড়ানো খেজুরের কথা। পকেট থেকে বের করে দেখি খেজুরগুলো তেমনিই আছে। আর ওই কাগজের কাপটাও ভাঁজ খুলে ব্যবহার করতে পারি। মূলত তখনই কাগজের কাপের ব্যবসার পরিকল্পনা মাথায় আসে।
প্রশ্ন : কাগজের কাপ-প্লেটের ব্যবসা শুরুর জন্য কোনো প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন কি?
সাজিদ : হজ করে ফিরে মালয়েশিয়া যাই। সেখান থেকে কাগজের কাপ উৎপাদন যন্ত্র ও এর উপকরণ বিষয়ে জানার চেষ্টা করি। ইন্টারনেটেও অনেক বিষয়ে অনেক পড়াশোনা করেছি। কাজ করতে করতে কারিগরি দক্ষতাও রপ্ত করতে পেরেছি।
প্রশ্ন : শুরুতে মূলধন কেমন ছিল?
সাজিদ : ওই সময় আমার কাছে তেমন টাকা-পয়সা ছিল না। ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকার মতো ছিল। মূলধন স্বল্পতা দূর করতে ইসলামি ব্যাংকের সঙ্গে কথা বললাম। তারা আমাকে অর্থায়ন করল। তবে তার পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অল্প। আমার মূলধন ছিল ৩৩ লাখ আর ব্যাংক দিল ৪০ লাখ। এখন মূলধন দুই কোটি টাকার ওপরে।
প্রশ্ন : প্রথম দিকে ব্যবসায় কৌশলটা কেমন ছিল?
সাজিদ : আমি সব সময় ছোট দিয়ে শুরু করি। এ ক্ষেত্রে সেটি করলাম। শুরু থেকে এখানে আছি (২২৩, গুলশান লিংক রোড, তেজগাঁও শিল্প এলাকা)। তখন কর্মী ছিল চারজন। এখন ২৬ জন। আমি ছোট-বড় সবার সঙ্গে সহজভাবে মিশতে পারি। এটি অনেক কাজে দেয়।
প্রশ্ন : ব্যবসায়িক চ্যালেঞ্জ কেমন ছিল?
সাজিদ : ব্যবসা মানেই চ্যালেঞ্জ। এটিও তেমনই। আমি সফল হয়েছি। দেশে এই ধরনের উদ্যোগ অনেকেই নিয়েছেন। আমার জানা মতে, দেশে এখন পর্যন্ত আমারটি ছাড়া এ ধরনের ছয়টি প্রতিষ্ঠান হয়েছে। এর মধ্যে চারটি এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। বাকি দুটি কোনোমতে চলছে। ওগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার পথে। অনেকের ধারণা নেই এ ব্যবসায় কী ধরনের ও কতটা পরিশ্রম করতে হয়।
প্রশ্ন : ব্যবসায়িক কোনো ভুল ছিল?
সাজিদ : দ্রুত কিছু একটা করে ফেলতে হবে, এমনটা ভাবিনি কখনো। আমি মূলত স্লো প্রকৃতির মানুষ। এ কারণে দেরি হলেও যাতে কোনো ভুল না হয়, সে জন্য সতর্ক ছিলাম।
প্রশ্ন : কী কী পণ্য রয়েছে আপনার প্রতিষ্ঠানের?
সাজিদ : কাগজের কাপ, প্লেট, খাবার সরবরাহের বক্স, শপিং ব্যাগ ইত্যাদি। তবে মূল পণ্য হলো কাগজের কাপ। বাকিগুলোর উৎপাদন ও বিপণন তুলনামূলক কম।
প্রশ্ন : পণ্যের গুণগত মান কতটা রক্ষা হয় বলে মনে করেন?
সাজিদ : আমি নিজে ফুড সেফটি ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমস (এফএসএমএস) কোর্স করেছি। আমার কারখানাতে এইচএসিসিপি বা হেসাপ (হ্যাজারড অ্যানালাইসিস অ্যান্ড ক্রিটিক্যাল কন্ট্রোল পয়েন্টস) প্র্যাকটিস করা হয়। আমার নিজস্ব ল্যাব রয়েছে। এখানে পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ ও পরীক্ষা করা হয়। আমরা যে কোয়ালিটির পণ্য উৎপাদন করছি, তা বিদেশের অনেক কোম্পানিও করতে পারছে না। তাদের পণ্যের গুণগত মানও আমাদের মতো নয়। কাগজের গায়ে আমরা যে আস্তর বা প্রলেপটা ব্যবহার করছি, তা শত ভাগ পরিবেশবান্ধব। কাগজের ওপর পলিইথিলিন নামক পদার্থের একটি প্রলেপ বা আস্তরণ রয়েছে। এটি শত ভাগ পচনশীল পদার্থ। এটি মাটির সংস্পর্শে যাওয়ার ২১ দিনের মধ্যে মাটির সঙ্গে মিশে যায়। এটি ওপেন চ্যালেঞ্জ।
প্রশ্ন : কোন কোন প্রতিষ্ঠানে আপনাদের পণ্য বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে?
সাজিদ : পেপসি, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, ইউনিলিভার, ওয়েস্টিন হোটেল, নেসলে, কাজী অ্যান্ড কাজী টি, ব্রিটিশ হাইকমিশন, ব্রিটিশ কাউন্সিল, প্রাণ, আকিজ গ্রুপ, অ্যাপোলো হাসপাতাল, ইউনাইটেড হাসপাতাল, আনোয়ার ইস্পাত, প্যান প্যাসিফিক হোটেল সোনারগাঁও, ইগলু, ডানো, সেভরন, আজিনোমোটো, নেউজিল্যান্ড ডেইরি, ইস্পাহানি গ্রুপসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আমাদের পণ্য সরবরাহ করা হয়। আমরা পণ্যের আন্তর্জাতিক মানের নিশ্চয়তা দিয়ে থাকি। এ কারণে দেশের বড় বড় কোম্পানি আমাদের সঙ্গে নির্দ্বিধায় কাজ করছে।
প্রশ্ন : বাজারে আপনাদের পণ্যের প্রতিযোগী কারা?
সাজিদ : আমাদের পণ্যের মান ভালো ও স্বাস্থ্যসম্মত হওয়ায় বড় বড় প্রতিষ্ঠানে এর চাহিদা বাড়ছে। বলতে পারেন আমাদের পণ্যের চাহিদা একচেটিয়া। অন্য যারা আছে তাদের মান ভালো না হওয়ায় প্রতিযোগিতায় দাঁড়াতে পারে না।
প্রশ্ন : একজন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে আপনার প্রধান অসুবিধা কী কী?
সাজিদ : আমাদের মতো উদ্যোক্তাদের জন্য কোনো শিল্পপ্লট বরাদ্দ নেই। তেজগাঁওয়ের মতো ব্যয়বহুল জায়গায় বেশি ভাড়া দিয়ে ব্যবসা চালিয়ে লাভ করা বা ব্যবসা চালানো ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য অসম্ভব। আমরা যে ধরনের পণ্য উৎপাদন করি তা পরিবেশবান্ধব হওয়ায় বিশ্বের সব দেশে এ পণ্যের কোনো ডিউটি (শুল্ক) দিতে হয় না। কিন্তু আমাদের দেশে ২৫ শতাংশ আয়করসহ কাঁচামাল আমদানি করতে মোট ৬১ শতাংশ ডিউটি দিতে হয়। এটি এখন মূল বাধা। কারণ আমার একটি পণ্যের (কাপ) দাম দেড় টাকা। আর প্লাস্টিকের গ্লাসের দাম ৯০ পয়সা। দেড় টাকা থেকে ডিউটি বাদ দিলে এর দাম পড়বে ৯০ পয়সা। অর্থাৎ প্লাস্টিকের সমান দাম। ডিউটিটাই এখন এ ব্যবসার মূল বাধা। মাসে প্লাস্টিকের পণ্যের বাজার পাঁচ থেকে সাত কোটি টাকা, যা কাগজের বাজারের তুলনায় ১০ ভাগের এক ভাগ মাত্র। তবে একই দামে প্লাস্টিক ও কাগজের কাপ পাওয়া গেলে যে কেউ কাগজেরটাই পছন্দ করবে। এর চাহিদা বাড়বে। পরিবেশ রক্ষা পাবে।
প্রশ্ন : পরিবেশ নিয়ে আপনি সোচ্চার। এর পেছনে কোনো কারণ আছে কি?
সাজিদ : আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তাঁর কাছ থেকে প্রায়ই যুদ্ধের গল্প শুনি। এখন তো আর মুক্তিযুদ্ধ করতে পারব না। দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমাদের চিন্তা করতে হবে। দেশের জন্য সবচেয়ে বড় যুদ্ধ হলো জলবায়ু ভালো রাখার যুদ্ধ। পরিবেশ দূষণের বিরুদ্ধে যে যেখান থেকে পারা যায় চেষ্টা করতে হবে। পরিবেশবাদীদের অনেকে পরিবেশ বাঁচানোর নামে অনেক কথা বলে। অনেক বক্তব্য দেয়। কিন্তু পণ্য দেয় না। আমি ব্যবসা করি। আমি এ ক্ষেত্র থেকে পরিবেশ রক্ষার যুদ্ধ করছি। আমি কারখানা ও উৎপাদিত পণ্যগুলো পরিবেশবান্ধব রাখতে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকি।
প্রশ্ন : ব্যবসার ক্ষেত্রে যে বিষয়ে আপনি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন, সেটি কী?
সাজিদ : আমি সব সময় মনে করি প্রতিষ্ঠানের কর্মীরাই আসল শক্তি। তাঁরাই একটি প্রতিষ্ঠানকে উপরে ওঠায়। আমি নিজে কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেই। আমি সব সময় তাদের সুবিধা-অসুবিধার দিকে নজর রাখি। ফলে কোনো কর্মীই আমার প্রতিষ্ঠান ছেড়ে যান না। এটা আমার ব্যবসার বড় সফলতা বলে মনে করি। আমি যখন বর্ষসেরা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার পুরস্কার আনতে গেলাম, সেই অনুষ্ঠানেও আমার সব কর্মীকে নিয়ে হাজির হই। কারণ এই পুরস্কার তো তাদেরই প্রাপ্য।
প্রশ্ন : আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
সাজিদ : আমি যে ধরনের ব্যবসা করছি তা দেশের ও মানুষের জন্য কল্যাণকর। এ কারণে এ শিল্পকে আমি দেশের মধ্যে একটি বড় শিল্প খাত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাই। আর বিদেশের মাটিতে দেশের পরিচয়ে এ পণ্য পৌঁছাতে চাই।
প্রশ্ন : তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
সাজিদ : যেখানেই বিনিয়োগ করুন, সততা নিয়ে লেগে থাকুন। আর শিল্পপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পরিবেশের কথা মাথায় রাখুন।
প্রশ্ন : আপনার নতুন নতুন উদ্যোগ ও পণ্য সম্পর্কে গ্রাহক কীভাবে জানবে?
সাজিদ : আমার প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট (www.kpcindustry.com) আছে। সেখান থেকে সব পণ্য সম্পর্কে জানা যাবে।