বিজনেস আইকন
বাংলাদেশ এখনো তৈরি পোশাকশিল্পে আকর্ষণীয় : আসিফ ইব্রাহীম
যুক্তরাষ্ট্রে যখন পড়ালেখা শেষ করলাম, আমি কিন্তু একদিনের জন্য সেখানে থাকিনি। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, বাংলাদেশে ফেরত আসব। আমাদের একটা পারিবারিক ব্যবসা ছিল। আমার ইচ্ছা ছিল, এটাকে আরো অনেক বড় করা। তখন তৈরি পোশাকশিল্প বাংলাদেশে শুরু হয়েছে।’ কথাগুলো বলেন আসিফ ইব্রাহীম। তিনি কিলক নিউএজ (এইচকে) লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও নিউএজ গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান।
এনটিভির নিয়মিত আয়োজন বিজনেস আইকনের এবারের পর্বে এসেছে এই স্বপ্নচারী মানুষটির গল্প। তিনি বলেছেন, জীবন-সংগ্রামের নানা কথা। urgentPhoto
আসিফ ইব্রাহীম সময় পেলেই জীবনীশক্তির খোঁজে বের হন। খানিকটা অবসর মিললে বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে একান্তে সময় কাটান। সে ক্ষেত্রে তাঁর সবচেয়ে পছন্দের জায়গা এই গলফ মাঠ। আড্ডাও দেন সমানতালে।
আসিফ ইব্রাহীম বলেন, ‘খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠা হয়। সাড়ে ৬টার দিকেই উঠে যাই। মেয়েকে স্কুলে দিয়ে আসতে হয়। ও স্কুলে যায় বাসে করে। বাসস্ট্যান্ডে নামিয়ে দিয়ে আসার কাজ আমি করি। এটা আমি এনজয় করি।’
প্রিয় খাবারের তালিকায় দেশি খাবারই আছে ওপরের দিকে। বৃষ্টি হলেই আরো অনেকের মতো তাঁরও ইলিশ মাছ আর খিচুড়ি খেতে মন চায়। আর দেশের বাইরে গেলে পাতে তোলেন বিভিন্ন ধরনের খাবার। স্বাদটা মিলিয়ে দেখতে চান কোনটা কেমন! তবে জাপানি কিছু খাবারের প্রতি আছে বিশেষ দুর্বলতা।
বিয়ে করেছেন দুই দশকের বেশি আগে, ১৯৯৪ সালে। স্ত্রী পড়ালেখা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে। এখন দুই মেয়েকে নিয়ে সুখে-দুঃখেই কেটে যায় তাঁদের নিত্যদিনের ঘর-সংসার। বড় মেয়ে বিদেশে পড়ছেন; ছোট মেয়ে ক্লাস ফোরে পড়ে।
আসিফের বাবা ১৯৬৩ সালে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ওপর পড়াশোনা শেষ করেন। প্রকৌশলী বাবা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছেন। পরে শুরু করেছিলেন নিজের ব্যবসা। তিনি বলেন, মা সাদামাটা মানুষ। ঘরদোর সামলেছেন আর তাঁদের দেখাশোনা করেছেন। এখন কিছু সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত আছেন।
আসিফ ইব্রাহীমের জন্ম ঢাকায় ১৯৬৫ সালে। বেড়ে ওঠা, স্কুল-কলেজ সব ঢাকাতেই। পরে উচ্চশিক্ষার জন্য গিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে। কিন্তু পড়াশোনা শেষ করার পর আর এক মুহূর্তও মন টেকেনি। দেশে ফিরেছেন। হাল ধরেছেন নিজেদের ব্যবসার।
আসিফ ইব্রাহীম বলেন, ‘১৯৯০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে যখন পড়ালেখা শেষ করলাম, আমি কিন্তু একদিনের জন্য সেখানে থাকিনি। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, বাংলাদেশে ফেরত আসব। আমাদের একটা পারিবারিক ব্যবসা ছিল। আমার ইচ্ছা ছিল, এটাকে আরো অনেক বড় করা। তখন তৈরি পোশাকশিল্প বাংলাদেশে শুরু হয়েছে। আমি মনে করেছি, যদি দেশে ফেরত আসি, তাহলে দেশে শিল্পায়নে কন্ট্রিবিউট করতে পারব।’
ব্যবসায়ী হিসেবে নিজেকে আলাদা করে চিনিয়েছেন আসিফ। সফলতার পথে পথে পরিচয় হয়েছে কতজনের সঙ্গে। কারও কারও সঙ্গে সম্পর্কটা হয়েছে আরো নিবিড়। বন্ধু হয়ে বিপদে-আপদে পাশে পাশে আছেন তাঁরা।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফিরে নিজেদের ব্যবসায় মন দেন। আজ বলতেই পারেন, সে লক্ষ্যে এগিয়েছেন ভালোভাবেই।
ব্যবসায়ীদের সংগঠনগুলোর শীর্ষ পদেও ছিলেন অনেকটা সময়। চেষ্টা করেছেন ব্যবসায়ীদের জন্য ভালো কিছু করার। নতুন কিছু, যেখান থেকে সরকারের নীতিনির্ধারকদেরও নানা পরামর্শ দেওয়া যায়। সে উদ্যোগটাও ভালোই এগিয়েছে। ছিলেন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি। দায়িত্ব পালন করছেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন দ্য ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক হিসেবে।
আসিফ বলেন, ‘২০১১-১২ সালে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। তখন আমরা দেখেছি, আমাদের প্রাইভেট সেক্টর নিয়ে সরকারি যেসব পলিসি আছে, তার বেশির ভাগই ব্যবসাবান্ধব নয়। সেগুলো চিন্তাভাবনা করে আমরা একটা সিদ্ধান্ত নিলাম, ব্যবসায়ীদের একটা গবেষণামূলক সংস্থা তৈরি করা প্রয়োজন। সে জন্য আমরা ঢাকা চেম্বার, মেট্রোপলিটন চেম্বার ও চট্টগ্রাম চেম্বার মিলে বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট (বিল্ড) নামে সংস্থা গঠন করি। বিল্ড থেকে আমরা সরকারকে পলিসি দিয়ে থাকি।’
তরুণদের হাত ধরেই বাংলাদেশ সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাবে বলে তাঁর বিশ্বাস। তাই তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য মাঝেমধ্যেই নানা কর্মসূচি হাতে নেন তাঁরা। নতুন নতুন ভাবনা নিয়ে, লক্ষ্যটা ঠিক করে এগোলে তরুণরাও ভালো করবে বলে মনে করেন। তবে যা করতে চান, তা ভালোভাবে জেনে-বুঝে তার পর মাঠে নামার পরামর্শ তাঁর।
নিউএজ গ্রুপের শুরু ১৯৮৩ সালে। ফার্মগেটের ইন্দিরা রোডে। তৈরি পোশাক কারখানা শুরু হয় ৬০টি মেশিন দিয়ে। শুরুতে কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলিয়ে ছিল দেড়শর মতো। তার পর নানা ঘাত-প্রতিঘাতে একটু একটু করে এগিয়েছেন। ধীরে ধীরে সেই ব্যবসার প্রসার ঘটেছে। অনেক কারখানা বেড়েছে। নিউএজ ফ্যাশন ওয়্যার, নিউএজ অ্যাপারেল, নিউএজ এক্সেসরিজ, নিউএজ প্লাস্টিক লিমিটেড গড়ে তোলেন। পরে তৈরি পোশাকশিল্পের বাইরে তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে কাজ করেছেন। প্রথমে ইন্দিরা রোডে থাকলেও পরে উত্তরার দিকে, আশুলিয়ায় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়েন। পরে কালিয়াকৈরে ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তুলেছেন।
তাঁদের বেশির ভাগ পণ্যই দেশের বাইরে রপ্তানি হয়; ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতে। সে দেশের সংখ্যা আরো বাড়ানোর চেষ্টা থাকে সব সময়ই।
আসিফ ইব্রাহীম বলেন, যেসব আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের রেটিং দিয়ে থাকে, যেমন—মুডিস, স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওরস আমাদের সম্পর্কে ইতিবাচক কথা বলে। এসব দেখে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আমাদের প্রতি আগ্রহ দেখায়। সাম্প্রতিক সময়ে এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, চীনের পর এখনো বাংলাদেশ তৈরি পোশাকশিল্পে আকর্ষণীয় গন্তব্য। এ ক্ষেত্রে বিদেশি ক্রেতারা এখনো চীনের পরে বাংলাদেশকে দেখে। চীনে তৈরি পোশাকের পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। তাদের শ্রমিকদের জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ৫০ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে বিজিএমই, তা সম্ভব হবে বলে মনে করেন আসিফ।
তাঁর প্রতিষ্ঠানে পণ্যের মান নিয়ে যেমন কোনো ছাড় নেই, তেমনি কারখানার পরিবেশটাও ঠিকঠাক রেখেছেন সব সময়। দেশের কারখানাগুলো পরিবেশবান্ধব হলে, ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও ভিন্ন মাত্রা আসবে বলে বিশ্বাস করেন আসিফ ইব্রাহীম।
আসিফ পরিবেশবান্ধব করে কারখানা গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। এখন তাঁদের প্রতিষ্ঠানে প্রায় হাজার দশেক কর্মী আছে।
আর কর্মীরাই একটি প্রতিষ্ঠানের প্রাণ বলে বিশ্বোস তাঁর। তাই তাঁদের সুযোগ-সুবিধার কথাটা মাথায় রাখেন সব সময়। দেশের আইন মেনে সব সুযোগ-সুবিধাই দেওয়ার চেষ্টা করেন তাঁদের। তাঁদের সুখে-দুঃখে পাশে থাকতে চান আসিফ।