আপনারা না গেলে আমরা খামু কী?
কই ভাড়া, ভাড়া নাই—বলার মাঝেই রাস্তায় একজনকে দেখে হাঁক ছাড়লেন, ‘ভাই কই যাবেন?’ তিনি সাড়া দিলেন না। শামীম বলে চলেন, ‘একজন পাইলেই বাজার (সাহেব বাজার) চলে যাচ্ছে। ওই দেখেন, একজন নিয়েই বানেশ্বর যাচ্ছে। আগে ভাড়া মারতাম এক হাজার, এখন ৫০০ টাকা। সাড়ে ৪০০ জমা দিলে থাকে ৫০ টাকা। কোনো কোনো দিন ১০০ টাকা থাকে।’
এ টাকায় আপনার চলে? প্রশ্ন করলে অনেকটা ভারাক্রান্ত মনে চুপ করে রইলেন অটোচালক শামীমুল হাসান। কিছু দিন আগে তিনি সিঙ্গার প্লাস-এ সহকারী ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করতেন। চাকরিটা চলে যাওয়ায় অনার্স পাস করা শামীম নতুন চাকরির সন্ধানও করছেন। চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত অটোরিকশা চালাবেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় বিরূপ প্রভাব পড়েছে নগরবাসীর ওপর। শিক্ষানগরী রাজশাহীর অর্থনীতি অনেকটাই নির্ভরশীল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি), রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট) এবং রাজশাহী মেডিকেল কলেজের (রামেক) ওপর। এর মধ্যে রাবি ৭ মে গ্রীষ্মকালীন ছুটি হয়েছে। খুলবে ৩১ মে। রুয়েট ১৬ মে বন্ধ হয়ে খুলেছে ২৩ মে। শিক্ষার্থীদের এই দীর্ঘ ছুটিতে অনেকটাই ফাঁকা সময় কাটাচ্ছে রাজশাহীর কর্মজীবী মানুষ।
তবে রাবির ৩৪ হাজার শিক্ষার্থীর অনুপস্থিতিই বেশি প্রভাব ফেলেছে এখানকার জনজীবনে। শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির প্রভাবটা কেমন তা দেখতে গিয়েছিলাম বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট কাজলা, বিনোদপুর ও মেহেরচণ্ডী এলাকায়।
‘আপনারা না গেলে আমরা খামু কী? লোক খুঁইজা পাইছি না। ক্যাম্পাসে তো ১০টা লোকও নাই। ইঞ্জিন রিকশা চালাই। জমা দিতে হয় ২৫০ টাকা। তাই ৫০০ টাকা আয় করতেই হবে। সে জন্য আগে কাজ করতাম পাঁচ-ছয় ঘণ্টা, এখন করি ১০ ঘণ্টা।’ বললেন ৬৫ বছর বয়সী কুদ্দুস আলী।
কথা হয় কাজলার ডিম, মুরগি ও কলা বিক্রেতা শরীফের সঙ্গে। অনেকটা হতাশার সঙ্গে বললেন, ‘লেইখাই আর কী করবেন? চার ভাগের একভাগও বেচাকেনা নাই। এখন দোকান বন্ধ কইরা যামু, আসমু ৫টার পরে। আগে দোকান বন্ধ করতাম না, ছেলেরে রাইখা খাইতে যাইতাম। এখন বেচাকেনা নাই, খোলা রাইখাই কী হবে।’
কাজলা থেকে রাজশাহী প্রধান ফটকের সামনে গেলে কয়েকজন কালাই রুটি বিক্রেতাদের দেখা যায়। রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী এই কালাই রুটি সাধারণত ফুটপাতেই বিক্রি হয়। এই অঞ্চলের দরিদ্র নারীরা এ কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। ১০ বছর ধরে কালাই রুটি বিক্রি করে আসা নূরনাহার বলেন, ‘ক্যাম্পাস বন্ধ, সেজন্য বিক্রি হয়, হয় না। কতক্ষণ খালি খালি বসে থাকব। তাই মধ্যে মধ্যে আসি না। ওই যে দেখতেছেন আরেকটা দোকান, ওই মহিলা আসে নাই। বিক্রি কম, আইসা কী করব? গতকাল বিক্রি করছি ২৫০ টাকা। প্রতিদিনই এ রকম। সারা দিন কষ্ট কইরা, খরচ বাদ দিলে আর কয় টাকাই থাকে।’
‘স্টুডেন্ট না থাকলে সমস্যা। কাঁচা বাজারের দোকান করি। আগে পাঁচ-ছয় হাজার তো হইতই। এখন হয় হাজার দুয়েক,’ বললেন বিনোদপুরের সবজি বিক্রেতা রিপন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন মেহেরচণ্ডী এলাকায় গেলে দেখা যায়, বেশির ভাগ দোকানই বন্ধ। একটি হোটেল খোলা দেখতে পেয়ে ভেতরে ঢুকলে দেখা যায়, মালিক খাচ্ছেন। কর্মচারী ছাড়া আর কোনো লোক নেই। খেতে খেতেই হোটেল মালিক খোরশেদ বলেন, ‘বেচাকেনা নাই। ক্যাম্পাস বন্ধ হয়ে গেলে এলাকা একবারে অচল। হোটেল বন্ধ থাকলে পেট চলবে ক্যামনে? তাই হোটেল খোলা রাখি। খোলা হলে আর সমস্যা থাকবে না। এখন বিক্রি হয় গড়ে হাজার দুয়েক, খুললে হবে ১০-১২ হাজার।’