জাবির মাঠে জমজমাট ইফতার
সৌন্দর্যের দিক থেকেই শুধু নয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) পারস্পরিক সৌহার্দ্যের দিক থেকেও অতুলনীয়। বছরের বিভিন্ন সময়ের নানা আয়োজনকে কেন্দ্র করে আনন্দে মেতে ওঠেন ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীরা। বিশেষ করে রমজানকে কেন্দ্র করে সবাই মিলে ইফতারির আয়োজন যেমনি উপভোগ্য, তেমনি একটি দেখার মতো বিষয়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশাল এলাকাজুড়ে রয়েছে খেলার মাঠ। যাকে বিশ্ববিদ্যালয়বাসী বলে থাকেন ‘কেন্দ্রীয় মাঠ’ বা ‘central field’। এখানেই আয়োজন করা হয় জমজমাট আনন্দপূর্ণ ইফতারির। না, সবাই একসঙ্গে নয়, বরং ছোট-বড় অনেক দলের সমাগম ঘটে এই মাঠে ইফতারির পূর্ববর্তী সময়ে। কেউ বন্ধু-বান্ধব, কেউ বড় ও ছোট ভাইবোনদের নিয়ে মাঠে বসেই বড় গামলা বা কাগজ বিছিয়ে আয়োজন করে দিনের শেষে ইফতারির।
যখন মাঠের মধ্যে অনেক ছোট ছোট গোল হয়ে বসা আড্ডার সমাগম হয়, তখন দূর থেকে মনে হয় বিশাল সবুজ বাগানে অজস্র ছোট ছোট ফুল ফুটে আছে। ক্যাম্পাসের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে এই সৌন্দর্য যেন বিনা দ্বিধায় মিতালী গড়ে তোলে। শুধু মাঠেই নয়, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ক্যাফেটেরিয়ার বারান্দা, পরিবহন চত্বর, শহীদ মিনারের পাদদেশ, অডিটোরিয়ামের বারান্দা, নিজ নিজ বিভাগ, টারজান পয়েন্ট, ইত্যাদি জায়গায় ইফতারির জন্য মিলিত হলেও সবচেয়ে বেশি লোকসমাগম ঘটে কেন্দ্রীয় মাঠেই। ব্যক্তিগত উদ্যোগে, সামষ্টিক উদ্যোগে, এমনকি সাংগঠনিক উদ্যোগেও এই আয়োজন পরিচালিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো, যেমন : জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটার, আনন্দন, জলসিঁড়ি, ধ্বনি ইত্যাদি ছাড়াও সাহিত্য সংগঠন চিরকুট, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন তরী, বাঁধন, লিও ক্লাব নিজ সাংগঠনিক উদ্যোগে কখনো ঘরোয়াভাবে, কখনো বড় আকারে ইফতারের আয়োজন করে থাকে। মজার বিষয় হলো, সংগঠনগুলো যখন এই আয়োজন করে তখন সেখানে কেবল তাদের সদস্যরাই উপস্থিত থাকে না, অন্যান্য সংগঠনের সদস্যকেও তাঁরা আমন্ত্রণ জানিয়ে থাকেন। ফলে একে অপরের সঙ্গে সৌহার্দ্য আর সম্প্রীতির বন্ধন যেমন দৃঢ় হয়, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ সবার জন্য হয়ে ওঠে বন্ধুত্বপূর্ণ। সবার সঙ্গে সবার গভীর হৃদ্য সম্পর্কের একটি নতুন জায়গা তৈরি করে এই আয়োজন।
এ বছর গ্রীষ্মের ছুটির সঙ্গে ঈদের ছুটি হওয়ায় প্রায় দুই মাসের জন্য ছুটি হয়ে যায় ক্যাম্পাস। কিন্তু তার পরও কেন্দ্রীয় মাঠে ইফতারের বর্ণাঢ্য আয়োজন একটুও স্তিমিত হয়নি। বন্ধ হয়ে যায়নি সবার সঙ্গে ইফতার করার রীতি। জমজমাটভাবে সেখানে চলছে চমকপ্রদ, আনন্দদায়ক ইফতার পার্টি। বন্ধু-বান্ধব মিলে একসঙ্গে খোলা মাঠে একই পাত্রে মাখানো ইফতার খাওয়ার মজা যে কী, তা এই মাঠের আসরে না এলে বোঝা যাবে না। আসরের আজানের পরপরই বিভিন্ন ছাত্র ও ছাত্রী হল থেকে আসা তরুণ-তরুণীর পদচারণায় মুখরিত হয় সেন্ট্রাল মাঠ। আলুর চপ, ছোলা, জিলাপি, বুরিন্দা, পেঁয়াজু, মাংসের চপ, বেগুনি, খেজুর, ডিম চপ, বড়া, আম, আনারস, পেয়ারা, আপেলসহ হরেক রকম ফল, খাবার আর বড় বড় বোতলে পানি নিয়ে গোল হয়ে বসে যান ছাত্রছাত্রীরা। কোথাও তিন-চারজন, কোথাও ৮-১০ জন, আবার কোথাও ১৫-২০ জনের দলও চোখে পড়বে এই ইফতারির আসরে।
শিক্ষার্থীরা এখানে সবাই সমান। বন্ধুত্ব আর ভ্রাতৃত্ববোধে উজ্জীবিত তাঁদের প্রতিটি প্রাণ। তাই পবিত্র রমজানকে কেন্দ্র করে কেবল মুসলিম বন্ধুরাই নয়—হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান বন্ধু-বান্ধবীরাও আনন্দের সঙ্গে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইফতারে শামিল হন। অসাম্প্রদায়িক জাবি ক্যাম্পাসের এই অপূর্ব মিলনমেলার দৃশ্য দেখলে বিস্মিত ও আনন্দিত না হয়ে পারা যায় না। সব সম্প্রদায়ের এমন সৌহার্দ্যপূর্ণ বিচরণ ও পারস্পরিক বন্ধন আমাদের অনেক কিছুই শেখায়। আমাদের দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাঁদের মতো করে ইফতারের আয়োজন করলেও জাবির মাঠের জমজমাট ইফতার সম্পূর্ণই ব্যতিক্রমী একটি আয়োজন। এভাবে নানা ধরনের আনন্দদায়ক ও ব্যতিক্রমী আয়োজন নিয়েই এগিয়ে চলেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় নামে দেশের একমাত্র আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়টি।