চারুকলায় বৈশাখ উৎসবের আমেজ
২৬ বছর আগে শুরু হয়েছিল বৈশাখী শোভাযাত্রা, কয়েকজন উদ্যমী তরুণ আর শিক্ষকের হাত ধরে। সেই শোভাযাত্রাই আজ দেশের আনাচে-কানাচে মানুষের প্রধানতম উৎসবে পরিণত হয়েছে। রমনার বটমূলে ছায়ানটের গানের আসরেই শেষ নয়, সেখানে আরো বড় কিছুই যোগ করেছে চারুকলা অনুষদের এই উদ্যোগ।
বাংলার লোকজ প্রতীক হিসেবে বিশাল কোনো কিছুর কাঠামো ছাড়াও বাহারি নকশার সরা, মাটির পুতুল, বিভিন্ন রকম কারুপণ্য, কাগজের বানানো পাখি, বিভিন্ন দেশি মোটিভে বানানো মুখোশ-এসব কিছু মিলিয়ে আমাদের দেশীয় লোকজ সংস্কৃতির এক সমৃদ্ধ প্রদর্শনী হয়ে ওঠে এই শোভাযাত্রা।
১৯৮৯ থেকে ২০১৫, সময়ের পালে হাওয়া কিছু কম বদলায়নি। এ বছর বৈশাখ আয়োজনের দায়িত্বে রয়েছে বর্তমানে চারুকলার সবচেয়ে সিনিয়র ১৬তম ব্যাচ। তাঁদের সাথে বরাবরই একই উদ্যমে কাজ করে যাচ্ছেন প্রথম আর দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা। নাহ, শুধু বৈশাখ নয়, এই আয়োজনটি একই সাথে চারুকলার নতুন-পুরোনো সবার পুনর্মিলনী বটে। সবাই ছুটে আসছেন কাজের তালে। অফিস শেষে বাড়ি না ফিরে তাঁদের ঠিকানা হয় চারুকলা।
পহেলা বৈশাখের এই শোভাযাত্রা এখন সব মানুষের আগ্রহের মূল কেন্দ্রবিন্দু। চারুকলার শিক্ষার্থীরা এই শোভাযাত্রার পাশাপাশি চৈত্রসংক্রান্তির দিনে নিজেদের আয়োজনে সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা আর বৈশাখের পরদিন যাত্রাপালার আয়োজন করে থাকে। এবার মঞ্চস্থ হবে সামাজিক নাটক ‘মমতাময়ী মা’।
পহেলা বৈশাখের মূল প্রস্তুতি পর্ব শুরু হয় প্রায় মাস খানেক আগে। অন্য কারো অনুদান নয়, কাজের অর্থের জোগানের ব্যবস্থা করে শিক্ষার্থীরা নিজেই। প্রথম ধাপে তাই বড় বড় কাঠামো নয়, সামনের স্টলে বিক্রি শুরু হয় সরা। চারুকলার এই নানা নকশায় রাঙানো সরাগুলো বদলে দিয়েছে গ্রাম-বাংলায় শুধু পূজার কাজে এর ব্যবহারের চলনকে। চারুকলায় ঢুকতেই চোখে পড়বে সরার স্টল। ডান পাশে চলছে সরা অঙ্কনের কাজ। সেখানের দায়িত্বে আছেন হ্যাপি ও তানিয়া। তাঁরা মূলত সেখানে সবার কাজের তত্ত্বাবধান করছেন। কারো নকশার পরিপূর্ণতা আনতে অথবা সঠিক রং প্রয়োগ করতে। তার পাশেই ঘেরাও করে চলছে জলরঙে ছবি আঁকার কাজ। সিনিয়রদের আনাগোনা এখানে বেশি। কাজের মান অনুযায়ী ছবিগুলো বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে ১০ হাজার টাকায়।
মৃৎশিল্প বিভাগের শিক্ষার্থী শাহাবুদ্দীন জানান, অনেক নামি শিল্পী ও শিক্ষকদের কাজের আলাদা পরিবেশের তাগিদে অন্যবারের চেয়ে ব্যতিক্রম আয়োজন হিসেবে রয়েছে আর্ট ক্যাম্প। ২ নম্বর জয়নুল গ্যালারিতে চলমান এই ক্যাম্পে এরই মাঝে কাজ করে গেছেন শিল্পী হামিদুজ্জামান খান, তরুণ শিক্ষক বিশ্বজিৎ গোস্বামী, অভিনেত্রী বিপাশা হায়াত।
পেপার-ম্যাশে করা বিশালাকার মুখোশের মোটিফগুলোতে রয়েছে বৈচিত্র্য; রাজা-রানি, রাক্ষস, হাতি, টেপা পুতুলের মুখ। কাগজের মুখোশের কাজ করছিলেন এশা, তিনি জানান, আপাতত বাঘ, পেঁচা আর খরগোশের মুখোশের কাজ চললেও পরে নতুন কিছু যোগ হতে পারে। শোভাযাত্রার মূল আকর্ষণ থাকে নতুন আঙ্গিকে বানানো কাঠামোগুলো। কাঠামো নির্মাণের মূল নেতৃত্বে আছেন ভাস্কর্য বিভাগের রনি।
এ বছরের মূল প্রতিপাদ্য তৈরিতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে সাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা। অনেক আলো জ্বালতে হবে মনের অন্ধকারে, অন্ধকারের মানুষকে আলোর পথ দেখাতে এবারের মূল কাঠামোটি নির্মিত হচ্ছে। এর পাশাপাশি থাকছে মাছ, জোড়া পায়রা, শিশুসহ ছাগল, কাকাতুয়া, বাঘ, ঘোড়া আর টেপা পুতুলসহ মোট ১০টি কাঠামো। শিল্পী যামিনী রায়ের অঙ্কিত হাতির আদলে নির্মিত হচ্ছে হাতি। এখনো কাঠামোগুলো আদলের রূপ পায়নি। সরাসরি রাজা-রানির আদলে টেরাকোটা নির্মাণ চলছে শিল্পী মিথুনের নির্দেশনায়। মূল্য ২৫০-৪০০ টাকার মাঝে।
ছুটির দিনগুলোতে স্বাভাবিকভাবেই এই প্রস্তুতি পর্ব দেখতে মানুষের ঢল নামছে। সামনের কয়েকদিনে আরো দ্বিগুণ উদ্যমে কাজ চলবে। তুলির শেষ আঁচড় পড়বে চৈত্রসংক্রান্তির রাতে। তারপরই কাঙ্ক্ষিত শোভাযাত্রা।