সালমানকে দেখতে ইচ্ছে করে, গলার আওয়াজ শুনতে ইচ্ছে করে : সামিরা
শত তরুণীর ‘স্বপ্নের নায়ক’ হয়ে ওঠার আগেই সামিরার প্রেমিক থেকে স্বামী হয়েছিলেন ঢাকাই সিনেমার তুমুল জনপ্রিয় নায়ক সালমান শাহ। তবে সালমান শাহর এ প্রিয় মানুষটি তাঁর মৃত্যুর পরই ভক্তদের একাংশের কাছে হয়ে উঠেছেন ভিলেন। কিন্তু এমনটা কেন হলো? সালমান শাহ চলে যাওয়ার ২৪ বছরের দিন সামিরা হক দীর্ঘ আলাপচারিতায় অংশ নিয়েছেন এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে। কথা বলেছেন সালমান শাহকে মিস করা, তদন্ত প্রতিবেদনসহ নানা বিষয়ে।
এনটিভি অনলাইন : সালমান শাহ নেই ২৪ বছর হয়ে গেল। দেশের অগণিত ভক্ত তাঁকে এখনো ভালোবাসে, মিস করে। নিশ্চয়ই ভক্তদের চেয়ে আপনার তাঁকে মিস করার পরিধিটা বেশি। আপনি এখনো তাঁকে কীভাবে মিস করেন?
সামিরা হক : আমার জন্য নতুন কোনো অনুভূতি নেই। এই ২৪ বছরের মধ্যে অনুভূতির কোনো পরিবর্তন নেই। কারণ, আমার কাছে সবচেয়ে বড় কথা, ৬ তারিখ কেন আমার কাছে প্রতিদিনই একই। যেদিন থেকে ইমন মারা গেছে, ও তো নেই, ইমন তো চলে গেল, ইমন চলে যাওয়া আমার জন্য যা, ওটাকে মিস করা বলবেন না। কষ্ট পাওয়া বলবেন বা কীভাবে আমি নিজে বুঝব ব্যাপারটা আমার মধ্যে নেই। ইমন প্রথমত আমার জন্য সালমান শাহই না। ইমন আমার জন্য ইমন। আমার হাজবেন্ড ছিল, আমি কিন্তু ওর ডিভোর্সড ওয়াইফ না। অনেকে প্রশ্ন করে, সামিরা এখন অন্যের ওয়াইফ। আমি অবশ্যই এখন অন্যের ওয়াইফ। কিন্তু সালমানের সঙ্গে থাকা অবস্থায় সালমানের একটাই ওয়াইফ ছিল এবং সেটা আমি ছিলাম। সালমানের স্ত্রী বলতে গেলে অবশ্যই আমি। এবং আমার স্বামী বলতে গেলে হয়তো বলবেন সালমান নেই বলে এখন আরেকটা হাজবেন্ড আছে। সালমান থাকলে তো হতো না। অনেকে বলতে পারে, কেন হলো, ধরে রাখতে পারতেন উনি। বাচ্চাকাচ্চা থাকলে হয়তো আমি কোনোদিন করতাম না। সেটারও কোনো উপায় ছিল না। এবং যেভাবে ওনারা আমাকে দোষ দিচ্ছেন, তখন আমাকে রেহাই পাওয়ার মতো, আমাকে নিজে বাঁচার জন্য, নিজেকে সুযোগ দেওয়ার জন্য আমাকে তখন শক্ত হয়ে দাঁড়াতে হলো। আমি যদি নিজের ফাইটটা নিজে না করি, আমার জন্য কেউ ফাইট করতে পারছে না এখানে। আমারও তো একটা ফ্যামিলি আছে, বাবা-মা আছে, আমি তো একটা মেয়ে। আমার কাছে ৬ তারিখ কোনো বিশেষ কিছু মনে হয় না। আমি প্রতিদিনই মনে করি এবং প্রতিদিনই আমার কাছে সমান দুঃখ-কষ্ট। এখন আমি বিয়ে করেছি, আমার বাচ্চা আছে। কিন্তু ওরা এটা জানে যে আমি সালমানকে বা ইমনকে ভালোবাসি। এবং ইমনের জন্য আমার ভালোবাসা কোনোদিন শেষ হবে না। এবং ইমনের কথা বললে আমার চোখে এখনো পানি আসবে এবং হাজবেন্ড মারা গেলে ওয়াইফের একটা ভেতরের যে জায়গাটা খালি হয়ে যায়, যেভাবে মায়ের বুক খালি হয়ে যায়, সেভাবে ওয়াইফেরও মন ভেঙে গেছে। এটা আমার জন্য কোনো নতুন কিছু নয়। মিস সব সময় করি, ইমনকে দেখতে ইচ্ছে করে, তার গলার আওয়াজ শুনতে ইচ্ছে করে। ইমন বাসায় যে পাগলামিগুলো করত, ওগুলো মনে পড়ে, ভালো কথাগুলো মনে পড়লে কান্না পায়, ইমনের দুঃখ মনে পড়লে আরো কান্না পায়। এভাবেই মিস করি।
এনটিভি অনলাইন : দীর্ঘ তদন্ত শেষে সিআইডি সালমান শাহর মৃত্যুর দায় থেকে আপনাকে মুক্তি দিয়েছে। কিন্তু আপনার কি মনে হয়, সাধারণ মানুষ কিংবা সালমান-ভক্তদের কাছ থেকে দায়মুক্তি পেয়েছেন? সালমান শাহর মৃত্যুর পেছনে আপনার হাত রয়েছে বলে মনে করেন ভক্ত ও সাধারণ মানুষের একটি অংশ। আবার ২৪ বছরে এর কোনো প্রমাণও নেই। এটাকে আপনি কীভাবে দেখেন?
সামিরা হক : প্রথম থেকেই আমি বলে আসছি, এটা আত্মহত্যা ছিল। সালমানের বাবা নিজে ম্যাজিস্ট্রেট থাকা সত্ত্বেও উনি নিজে গিয়ে আত্মহত্যার মামলা রমনা থানায় লিখে এসেছেন। ওনারা নিজেরা পোস্টমর্টেম করেছেন, তার পরে আবার পোস্টমর্টেম করেছেন সিলেটের ওসমানী মেডিকেলে এবং প্রথম দিন করা হলো ঢাকা মেডিকেলে। সবকিছু ওনাদের নিয়ন্ত্রণে হয়েছে, আমার নিয়ন্ত্রণে হয়নি। রিপোর্ট ওনাদের হাতেই আসছে, আমার হাতে না। আমি বারবার ২৪ বছর ধরে একই কথা বলছি। ভক্তরা যারা এখানে বিশ্বাস করছে বা করছে না, তাদের মধ্যে বয়স হচ্ছে ১৬ থেকে ৩৫ বছর পর্যন্ত ছেলেমেয়েরা। এরা বড় হয়েছে শুনে, কেউ হয়তো মাকে কাঁদতে দেখেছে, কেউ বড় বোনকে কাঁদতে দেখেছে ইমনের জন্য। ওরা যখন এই স্মৃতি নিয়ে বড় হয়, ওরা বিশ্বাস করতে থাকে যে সালমানকে হত্যা করা হয়েছে। এটা ওদের দোষ না। ওরা জানে না, ওরা তো তখন ছিল না। ওরা ইমনকে নিজের চোখে দেখেছে, আমাকে দেখেছে, ওরা কিছুই দেখেনি। ওরা কিছু না দেখে কীভাবে ওরা একটা জাজমেন্ট পাচ্ছে। এটা উচিত হবে না। একজনকে নিয়ে কথা বলার আগে আমাদের জানা উচিত যে আমরা আসলে কতটুকু সত্যি জানি। আমি অনুরোধ করব, যারা সালমানভক্ত, যারা না বুঝে বলছে, আমি কিন্তু ওদের দোষ দিই না। তাদের ওপর আমার কোনো কষ্ট নেই। আমার এটা খুব ভালো লাগে যে তার এখনো এত ভক্ত আছে, এটা আমার একটা গর্বের জায়গা। কিন্তু আমি চাইব, ওরা এটা বুঝুক যে ইমন কাকে বেশি ভালোবাসত, ইমনের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা কী ছিল। ওটাকে তারা পছন্দ করুক বা অপছন্দ করুক, তাদের মানতেই হবে সেটা আমিই ছিলাম।
এনটিভি অনলাইন : পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) প্রতিবেদন দিয়েছে যে সালমান শাহ আত্মহত্যা করেছেন। এ প্রতিবেদন তো প্রত্যাখ্যান করেছে সালমান শাহর পরিবার। আপনি এটাকে কীভাবে দেখেন?
সামিরা হক : শুরু থেকেই প্রতিটি তদন্ত বিভাগকে আমি চ্যালেঞ্জ করেছিলাম। আমার ওপর যে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর একটাও সত্য, আমাকে শুধু একটা দেখান। সর্বশেষ পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) প্রতিবেদনের পর ভক্তদের অনেক চেঞ্জ আসছে। প্রায় ৭০% ভক্তের চেঞ্জ আসছে। আমি কথা বলছি, যোগাযোগ করছি, ওদের রেসপন্স দেখছি, আমার সঙ্গে দেখা করতে চায়, আমার খুব ভালো লাগছে। আর সালমান শাহর পরিবারের প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান, আমি এটাকে কোনো নতুনভাবে দেখছি না। ওনাদের যেহেতু অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে সরকারের অ্যাগেইনেস্টে যাওয়া। ওনারা বারবার বলেন যে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাই, আইনের প্রতি আস্থা আছে বলেন। কিন্তু যতবার আইন ওনাদের একটা রেজাল্ট দিচ্ছে, ততবার ওনারা আবার এটাকে প্রত্যাখ্যান করেন। তখন ওনারা বলেন, এটাকে মেতে নিতে পারছেন না। আমি যদি ভুল করে থাকতাম, সেটা অবশ্যই প্রমাণিত হতো। এবং আমি মাথা পেতে নিতাম। কিন্তু আমি আপনাদের অনেক আগে বলেছি, আমি চ্যালেঞ্জ করছি এটা আত্মহত্যা।
এনটিভি অনলাইন : সালমান শাহর মৃত্যুর পর আপনি এবং আপনার সাবেক শাশুড়ির মধ্যে যে তিক্ততা বা দোষারোপের সম্পর্ক, সেটি থেকে আপনারা বের হতে পারছেন না কেন?
সামিরা হক : আমার শাশুড়ির সঙ্গে এই ২৪ বছরে কখনো দেখা হয়নি। কারণ, আমার শাশুড়ির সঙ্গে আমার হাজবেন্ডের সম্পর্ক ঠিক ছিল না। যে দুই-আড়াই মাস আমি বাসায় ছিলাম না, আমার শাশুড়ি একবারও ছেলেকে দেখতে যাননি। আমি বউ হয়ে না হয় খারাপ, কিন্তু উনি মা হয়ে কেন একবারও ছেলেকে দেখতে যান নাই? আর ওনার সঙ্গে আমি কেন সম্পর্ক ঠিক রাখব! আজকে আমার জায়গায় যেকোনো মেয়েকে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করেন, সে মেয়েটাকে যদি দোষ দেওয়া হয় যে তার ছেলেকে সে মারতে সাহায্য করেছে বা সে কিছু একটা জানে বা সে খুনি বা সে আসামি, সে সম্পর্ক রাখবে কি না। কেন? আমি তো ওনার সঙ্গে সম্পর্ক রাখবই না। কী কারণে রাখব, উনি তো আমাকে গালাগালি করেন, আমি তো করি না।
এনটিভি অনলাইন : আপনার কি মনে হয়, এ ঘটনার দীর্ঘ সময় পর এসে সম্প্রতি মিডিয়ায় আপনি আপনার যে বক্তব্য তুলে ধরেছেন, সেটি সালমানভক্তদের মধ্যে কোনো প্রভাব ফেলেছে?
সামিরা হক : অনেকে বুঝতে ভুল করে যে সামিরা আগে মুখ খুলল না কেন। সামিরা আগে মুখ খুলবে কীভাবে, সে তো সারাক্ষণ আন্ডার ইনভেস্টিগেশন। আপনি যখন একটা ইনভেস্টিগেশনের মধ্যে থাকবেন, ওই মুহূর্তে আপনি কোনোভাবে কোনোরকম বক্তব্য বাইরে দিতে পারবেন না। কারণ, আপনি আইনকে কোনোভাবে ডিফেট করতে পারবেন না, যেটা ওনারা করেছেন। ওনারা ওয়ান সাইড বলে গেছেন এবং মানুষ ওয়ান সাইড বিশ্বাস করেছে। কিন্তু নিয়ম হচ্ছে, দুই পক্ষের চুপ থাকা। আমি তো বলেছি, ৭০% একদম পজিটিভ। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া। অনেক ছেলেমেয়ে আমাকে মেসেজ করে, যারা গালাগালি করেছিল তারা সরি বলে, অনেকে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করে এবং আমার জবাব দিতে ভালোই লাগে। আমি মনে করি, আমার কথা আরো আগে বলা উচিত ছিল। আমার শাশুড়ি আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারবেন না। কারণ, ওনার সব মিথ্যা অভিযোগ। এবং ওনার প্রতিটি কথার জবাব আমার কাছে আছে।
এনটিভি অনলাইন : সালমান শাহর মৃত্যুর পর আপনি তাঁর স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে গিয়ে কী করেছেন?
সামিরা হক : আমার ইচ্ছের শেষ নেই। আমি সুযোগটা পেলাম কোথায়। সব সময় ইনভেস্টিগেশনের মধ্যে ছিলাম। সেখানে আমি কীভাবে সুযোগ পাব ইমনের জন্য কিছু করার। অবশ্যই আমার ইচ্ছা আছে, ইমনের জন্য অনেক কিছু করতে চাই। এবং ইনশাআল্লাহ সময় ভালো হলে ভক্তরা নিজেই দেখতে পারবে এবং ভক্তদের সাহায্যসহ কিছু একটা করব ইমনের জন্য। আমি জানি না, ওনারা কেন কিছু করলেন না ছেলের জন্য। একটা মসজিদ, একটা মাদ্রাসা, একটা স্কুল, একটা হাসপাতাল, একটা সিনেমা হল বা কিছু ইমনের জন্য করতে পারল না!
এনটিভি অনলাইন : যদি বলা হয়, আপনি আপনার জীবনের কোন সময়গুলো সালমানকে নিয়ে আবার ফেরত চাইবেন। তাহলে কী বলবেন…
সামিরা হক : আমি ৫ তারিখটা ফেরত পেতে চাই, যেন ৬ তারিখ তাকে ওভাবে না দেখি। ওর যদি মৃত্যুটা না হতো। অনেকেই ভাববে, আমি ধর্মের বাইরে কথা বলছি। এটা আমার মনের আশা। ৬ তারিখ যদি আমার জীবনে না আসত, ইমন যদি বেঁচে থাকত। এটাই আমার সবচেয়ে বড় আশা।