নায়কের মুখোমুখি
বাংলাদেশের মানুষই চিরঞ্জিতকে আগে নায়ক বানিয়েছে
আসল নাম দীপক চক্রবর্তী। তবে এপার ও ওপার বাংলার মানুষ তাঁকে একবাক্যে চিরঞ্জিত নামেই চেনেন। একদিকে রাজনীতি, অন্যদিকে অভিনয়, সেই সঙ্গে পরিচালনা সব কিছু মিলিয়ে মহাব্যস্ত টলিউডের এই জনপ্রিয় নায়ক। তার মধ্যেই একদিন ফোন করে সাক্ষাৎকারের জন্য সময় চেয়ে বসলাম। অবশ্য সময় চাইতেই হাসিমুখে সমস্ত ব্যস্ততার মধ্যেই একদিন এনটিভি অনলাইনের জন্য সময় দিলেন জনপ্রিয় নায়ক চিরঞ্জিত। এই অ্যাকশন হিরোর মুখোমুখি হয়েই সর্বপ্রথমে অসংখ্য ধন্যবাদ জানালাম বাংলাদেশবাসীর তরফ থেকে। প্রত্যুত্তরে হাত জোড় করে ধন্যবাদ জানিয়ে চিরঞ্জিত বললেন, ‘বরাবরই আমার বাংলাদেশের প্রতি আলাদা সফট কর্নার কাজ করে। কারণ,সেখানকার দর্শকরাই তো আমায় সবার আগে নায়ক বলে ইন্ডাস্ট্রিকে চিনিয়েছে। তারপর টলিউড। আমি যখন প্রথম ১৯৮০ সালে চাকরি ছেড়ে অভিনয়জগতে আসি, সেই সময় পরপর ছবিগুলোর কথা মনে করুন। অন্তরালে, অমর কণ্টক, মৌনমুখর, প্রতিকার, আঘাত, তুফান...কত নাম বলব! সব, সব ছবি হিট। আর বাংলাদেশের মানুষ আমায় এত ভালোবাসেন যে সেখানে গেলেই তাঁরা বারবার মনে করিয়ে দেন সেই সমস্ত ছবির স্মৃতি। বাংলাদেশের বহু অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সঙ্গে কাজ করেছি। ‘বেদের মেয়ে জোৎস্নার’ রেকর্ড তো বোধহয় এখনো কেউ ভাঙতে পারেনি! সেই সঙ্গে প্রচুর যাত্রাও করেছি।’
বাংলাদেশ নিয়ে স্মৃতিচারণা করতেই প্রশ্ন করলাম, ‘আপনার তো সাম্প্রতিক সময়ে করা ‘চতুষ্কোণ’ ছবিও হিট হয়ে গেল? এবার সোফায় হেলান দিয়ে হেসে ফেললেন চিরঞ্জিত, বললেন, ‘সেটাই তো দেখছি। এখন নয়া ট্রেন্ড। গোয়েন্দা গল্প মানেই হিট।’ পরের প্রশ্ন, ‘এ বছর নতুন কী কী ছবি মুক্তি পাচ্ছে আপনার? জবাবে বললেন, “মনিহারা’ তো আছেই। এ ছাড়া রয়েছে ‘ষড়রিপু’ আর ‘অ্যাবিসেন’।” ছোটপর্দায় অভিনয়ের ইচ্ছা আছে? চিরঞ্জিতের চটজলদি উত্তর, ‘ভালো অফার পেলে তো করতেই পারি। এর আগে টিভিতে রিয়্যালিটি শোয়ের বিচারক হয়েছি। একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের পক্ষ থেকে ‘ডিটেকটিভ ২০১৫’ নামে একটি সিরিজে অভিনয়ের জন্য বলেছে। অবশ্য ফাইনাল কিছু হয়নি। দেখা যাক শেষ অবধি কী হয়।’
বাইরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি নেমেছে। কাচের জানালা দিয়ে বাইরে শুধু ধোঁয়া ধোঁয়া অস্পষ্ট সবকিছু দেখা যাচ্ছে। মনে মনে ভাবলাম ভালোই হলো। নায়কের সঙ্গে বাড়তি সময় পাওয়া যাবে কথা বলার জন্য। ওরই মধ্যে টেবিলে এসে হাজির হলো গরম চায়ের কাপ। সঙ্গে মুচমুচে বিস্কুট। গরম চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বললাম, সারা জীবন তো পারিবারিক আর সিরিয়াস ছবি করে গেলেন। কমেডি ছবিতে অভিনয় করেননি কেন? বাঁ হাতের তর্জনী দিয়ে চোখের চশমাটাকে একটু ওপরে ঠেলে দিয়ে বললেন, “আসলে আমার বাবা ছিলেন বিখ্যাত কার্টুনিস্ট শৈল চক্রবর্তী। ছোট থেকে বাবার কাছে আঁকার শিক্ষা পাই। তখন বুঝিনি যে জীবনটা হলো কমেডি। (এবার বেশ উচ্চ স্বরে হেসে উঠলেন) আমি একটা কমেডি ছবি করেছিলাম। ‘পেন্নাম কলকাতা’ বেশ হিট হয়েছিল কিন্তু। মূলত যখন যে রকম ছবির কাজ পেয়েছি তাতেই অভিনয় করেছি।” মধ্যে অভিনয় থেকে সরে গেলেন কেন? ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে প্রথম চুমুক দিয়ে চিরঞ্জিত বললেন, ‘২০০১ সালে যখন দেখলাম, আমার দুশোর বেশি ছবিতে অভিনয় হয়ে গেছে, তখন নিজেই ঠিক করলাম আর ছবিতে অভিনয় করব না। আসলে একই ধরনের চরিত্রে কাজ করতে করতে আমার মধ্যে একটা একঘেয়েমি এসে গিয়েছিল। তাই অবসর নিয়েছিলাম। এখন আবার অভিনয়জগতে ফিরে এসেছি। বিভিন্ন চরিত্রে কাজের অফার পাচ্ছি। চরিত্রগুলোতেই বিভিন্ন শেডস আছে। তাই আবার কাজ করতে ইচ্ছা করছে।’
প্রচণ্ড জোরে বাজ পড়ল বোধহয় ধারে কোথাও। বিদ্যুতের ঝলকানি খেলে গেল সারা ঘরে। একটু থেমে বললাম, আপনি তো বহুদিন এই ইন্ডাস্ট্রিকে দেখছেন। দুই বাংলার ছবিতে কী পরিবর্তন এসেছে? একটু ভেবে নিয়ে বললেন, ‘আমি ৪০ বছর ধরে বাংলা ছবিতে কাজ করছি। তবু কিন্তু এখনো সুপারস্টার রয়ে গেছি (হেসে উঠলেন)। দুই বাংলায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। গল্পের ধারা, শুটিং এমনকি বিজ্ঞাপন, সিনেমা মার্কেটিং সব সবকিছুতেই।’ বললাম, রাজনীতি, অভিনয়, পরিচালনা একসঙ্গে সামলান কী করে? উত্তরে চিরঞ্জিত মুচকি হেসে বললেন, ‘ভালোই তো, সারা দিন কাজের মধ্যে থাকি। সময় কেটে যায়।’ নতুন প্রজন্ম অভিনয়জগতে এসে কেমন কাজ করছে? চিরঞ্জিত বললেন, ‘দুই বাংলার ইয়ং ছেলেমেয়েদের মধ্যে খুব ডেডিকেশন আছে। দারুণ কাজ করছে। সময় বদলেছে, কাজের ধারাও বদলে গিয়েছে।’
মুষলধারে বৃষ্টিটা অনেকটাই থেমে গিয়েছে, বাইরে ইলশেগুঁড়ি হয়ে ঝরছে। এবার ওঠার পালা। ওঠার আগে আপনাকে ছোট ছোট কটা প্রশ্ন করব। ছোট ছোট উত্তর চাই কিন্তু। গোঁফের তলায় হেসে চিরঞ্জিত বললেন, ‘আগে তো করুন।’
প্রশ্ন: আপনার সবচেয়ে দুর্বলতা?
চিরঞ্জিত : জোতিষী কিছু বললে।
প্রশ্ন : কী খেতে ভালোবাসেন?
চিরিঞ্জিত : বাড়িতে রান্না করা এক্কেবারে বাঙালি খাবার।
প্রশ্ন : দর্শকদের কাছে কী লুকাতে চান?
চিরঞ্জিত : বয়েস।
প্রশ্ন : কোথায় বেড়াতে যেতে পছন্দ করেন?
চিরঞ্জিত : পশ্চিমবঙ্গ কিংবা বাংলাদেশের কোনো নদীর পাড়ে।
প্রশ্ন : কোন রং পছন্দ?
চিরঞ্জিত : কালো আর লাল। (জোতিষী বলেছে সেটাই আমার পক্ষে শুভ)
প্রশ্ন : প্রিয় নায়িকা?
চিরঞ্জিত : মধুবালা।
প্রশ্ন : যে নায়িকাদের সঙ্গে কাজ করেছেন, তাদের মধ্যে পছন্দ?
চিরঞ্জিত : ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, শতাব্দী রায়, অঞ্জু ঘোষ।
প্রশ্ন : যে কাজ এখনো করা হয়ে ওঠেনি?
চিরঞ্জিত : আমার দ্বারা পূজো পাঠ হয় না।
এবার সত্যি সত্যিই নায়কের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার পালা। যাওয়ার আগে হাত জোড় করতেই একগাল হেসে চিরঞ্জিত বললেন, বাংলাদেশের সবাইকে আবারও ধন্যবাদ। সবাই ভীষণ ভালো থাকুন। আর বেশি বেশি করে বাংলা ছবি দেখুন।