অভিনেত্রী না হলে টিচার হতাম : ঋতুপর্ণা
ভারতীয় অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। টলিউড ও বলিউডে অভিনয় করে তিনি যেমন জনপ্রিয়তা পেয়েছেন তেমনি ঢালিউডের ছবিতেও ছিল তাঁর সাবলীল উপস্থিতি। বাংলাদেশের অসংখ্য ছবিতে অভিনয় করে পেয়েছেন তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়তা। এরমধ্যে তাঁর উল্লেখযোগ্য ছবিগুলো হলো, ‘জুম্মন কসাই’, ‘স্বামী ছিনতাই’, ‘তোমার আমার প্রেম’, ‘সাগরিকা’ ও ‘রাঙা বউ’ ইত্যাদি। সম্প্রতি আলমগীর পরিচালিত ‘একটি সিনেমার গল্প’ ছবির শুটিং করতে ঢাকায় এসেছিলেন ঋতুপর্ণা। সেই সময় অভিনয় জীবনের গল্প ছাড়াও ব্যক্তিগত জীবনের অনেক বিষয় নিয়ে এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে কথা বলেন এই অভিনেত্রী।
এনটিভি অনলাইন : ঢাকায় এফডিসিতে অনেকদিন পর শুটিং করলেন। কেমন লাগল?
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত : খুব ভালো। ঢাকার মানুষ আমায় অনেক ভালোবাসে। এফডিসি আমার কাছে অনেক স্মৃতিবিজরিত জায়গা। বাংলাদেশে শুটিংয়ের জন্য ঢাকায় প্রথম এফডিসিতে এসেছিলাম। এখানে প্রথম কাজ ছিল ‘স্বামী কেন আসামী’ ছবির। ছবিটা অনেক হিট হয়েছিল। ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল ছবিটি। আমার এখানকার বেশির ভাগ ছবি সুপারহিট ছিল।
ফলে প্রত্যেকের ভালোবাসা, আদর ও আন্তরিকতা আমি সবসময় পেয়ে এসেছি। বাংলাদেশের মানুষের অনেক কৌতুহল আছে আমাকে নিয়ে। এটা আমার অনেক ভালো লাগে। বাংলাদেশের মানুষ আমার কাজ দেখতে চায় সেটা এখানকার ছবিতেও দেখতে চায় কিংবা ওখানকার ছবিতেও দেখতে চায়। এফডিসি অনেক সুন্দর হয়ে গেছে। অনেক বদলে গেছে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের যে উন্নতি হচ্ছে সেটা আমার ভালো লাগছে। চলচ্চিত্র তো একটা শিল্প। চলচ্চিত্র অবশ্যই একটা ইন্ড্রাস্ট্রি। এটাকে যদি আমরা বড় জায়গায় নিয়ে যেতে পারি তাহলে প্রচুর মানুষ এখানে কাজ পায়। প্রচুর শিল্পী এখানে বড় হতে পারে। শুনেছি এখানে শিল্পী সমিতিতে অনেক রকম পরিবর্তন এসেছে। অনেকরকম কার্যকলাপ হওয়ার কথা চলছে। এটা ইতিবাচক ব্যাপার।
এনটিভি অনলাইন : বাংলাদেশ-ভারত যৌথ প্রযোজনার অনেক ছবি এখন নির্মাণ করা হচ্ছে। এ বিষয়ে আপনার অভিমত কী?
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত : যৌথ প্রযোজনার নীতিমালা মেনে যদি কাজ হয় তাহলে কেন ছবি নির্মাণ হবে না! এটা হলে আমাদের বাংলা ছবির বাজার বড় হবে। দক্ষিণের ও হিন্দি ছবির বাজার অনেক বিরাট। দুই বাংলায় আমরা যদি ছবি আদান প্রদান করতে পারি তাহলে মার্কেটও বড় হয়। প্রযোজকদেরও লাভ হয়। শিল্পীদের জন্যও এটা ভালো হবে। সবমিলিয়ে ভালো ধরনের একটা প্রভাব পড়বে।
এনটিভি অনলাইন : বাংলাদেশের ছবিতে নায়ক জসিম ও মান্না ছাড়াও অনেকের সঙ্গে আপনি অভিনয় করেছেন। তাঁদের মধ্যে এখন অনেকে বেঁচে নেই। তাঁদের সঙ্গে কাটানো সময়ের কথা মনে পড়ে?
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত : এবার এখানে এসে যেটা উপলব্ধি করলাম সেটা হলো, অনেক দিনের পুরোনো মানুষ হারিয়ে গেছে। এটা আমার জন্য খুব বেদনাদায়ক। কারণ তাঁদের সাথে খুব মিলেমেশে কাজ করেছি। তাঁদের অনেক ভালোবাসা পেয়েছি। যাঁদের সঙ্গে প্রথম কাজ করেছি এর মধ্যে জসিম ভাই তিনি নেই। আকস্মিক মৃত্য হয় তাঁর । এরপর দিলদার সাহেব , রাজিব ভাই, হুমায়ূন ফরিদী। এত মানুষের সঙ্গে কাজ করেছি আজ তাঁরা কেউ নেই। এটা ভেবে অনেক কষ্ট হয়। আর মান্নার কথা আমি জানি না কীভাবে বলব। মান্নার সঙ্গে ‘বংশধর’ থেকে শুরু করে অনেক ছবি করেছি।
এনটিভি অনলাইন : শুনেছি মান্না আপনার অনেক ভালো বন্ধু ছিলেন। তাঁর সঙ্গে আপনার সম্পর্কটা কেমন ছিল?
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত : মান্না আমায় অনেক আদর করত। স্নেহ করত। আমাকে ভালো শিল্পী হিসেবে সবসময় সম্মান করত। মান্না ভাইয়ের স্ত্রী শেলী ভাবির সঙ্গে আমার খুব ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। এখনো আছে। কোনোদিন এমন হয়নি যে ঢাকায় এসেছি কিন্তু তাঁর সাথে খাওয়া-দাওয়া হয়নি। শেলী ভাবি আমাকে এত ভালোবাসে যে সবসময় বলে যে এখানেই থাক। শুটিং করো। অনেক আন্তরিক তিনি। মান্না চলে যাওয়াতে ইন্ড্রাস্ট্রির অনেক ক্ষতি হয়েছে। বড় নায়কের জায়গা যদি খালি হয়ে যায় তাহলে অবশ্যই ইন্ড্রাস্ট্রির একটা বড় জায়গা ফাঁকা হয়ে যায়।
এনটিভি অনলাইন: ‘রাজকাহিনী’ ছবিতে আপনার অভিনীত ‘বেগমজান’ চরিত্রটি খুব প্রশংসিত হয়। ‘দহন’ ছবিরে রবিতা চরিত্রে অভিনয় করে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পেয়েছেন আপনি। যেকোনো ছবির গল্পের চরিত্রে ঢুকতে আপনার প্রস্তুতি কেমন থাকে?
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত : আস্তে আস্তে অভিনয় করতে করতে সেটা আমার হয়ে গেছে। আমি অভিনয় ও চরিত্রে খুব মনোযোগী। চরিত্রে আমি শুধু ফোকাস করি এবং চিন্তা করি এটা কোন লেভেলে আমি নিয়ে যেতে পারি। চিন্তা করি যে আমার চরিত্রটি দর্শককে কোন লেভেলে গিয়ে ধাক্কা দিবে। চরিত্রগুলো সৃষ্টি করাই আমার প্রধান লক্ষ্য থাকে। আমি যেদিন থাকব না সেদিন আমার চরিত্রগুলো সবাই মনে রাখবে।
আমার নাম মনে রাখার দরকার নেই কিন্তু আমি চরিত্রগুলোর নাম যেন সবার মনে থাকে। যেমন পারমিতার একদিনের ‘পারমিতা’, দহনের ‘রবিতা’, মক্তধারার ‘নীহারিকা’, প্রাক্তনের ‘সুদীপা’ ও রাজকাহিনীর ‘বেগমজান’।
এরমধ্যে ‘বেগমজান’ চরিত্রটি বিরাট ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। আমি চাই আমার চরিত্রগুলো যেন মানুষের মনে জ্বলজ্বলে হয়ে থাকে। বাংলা ছবির ইতিহাসে যেন আমি সেরকম ছবি দিয়ে যেতে পারি যে ছবিগুলো আমি চলে যাওয়ার পরও অনেক বছর মানুষ মনে রাখবে এবং ছবিগুলো দেখবে।
এনটিভি অনলাইন : আপনার সর্বশেষ আলোচিত চলচ্চিত্র ‘প্রাক্তন’। ছবিটি দর্শকপ্রিয় হওয়ার পেছনে কোন কারণটি ছিল বলে আপনি মনে করেন?
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত : প্রথমত শিবপ্রসাদ ও নন্দিতা এখন অসাধারণ কাজ করছে। শিবু আমার বন্ধু। আমি ওর পাশে থেকে অনেক সাপোর্ট করেছি। আমি চাই শিবুর মতো আরো ট্যালেন্ট যেন বাংলা সিনেমায় আসে। যে কি না অনেক ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারবে। আজকে শিবুর সব ছবি ইতিহাস সৃষ্টি করছে।
শিবু যে চরিত্রটি সৃষ্টি করে সেটার প্রতি আমার অনেক আত্মবিশ্বাস থাকে। প্রাক্তন ছবির ‘সুদীপা’ চরিত্রটি যেকোনো মেয়ে বুঝতে পারবে। স্বামী-স্ত্রীর কলহ, এই যে বিচ্ছেদ, ভুল বোঝাবুঝি এই বিষয়গুলো মুখোমুখি আমরা প্রতিদিন হয়ে থাকি। আমার প্রথমেই মনে হয়েছিল ‘সুদীপা’ চরিত্রটি চট করে মানুষের মন কাড়বে।
এনটিভি অনলাইন : আপনি কী ধরনের চরিত্রে অভিনয় করতে পছন্দ করেন। আপনাকে নারীপ্রধান চরিত্রে বেশি দেখা যায়। এর কারণ কী?
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত : আমি রোমান্টিক ও ইমোশোনাল চরিত্র করতে ভালোবাসি। এ ছাড়া সংকটপূর্ণ চরিত্র করতে অনেক পছন্দ করি। এ ধরনের চরিত্র পেলে আমি কাজ করে অনেক স্বাচ্ছান্দ্যবোধ করি। আর নারীপ্রধান চরিত্র করতে গেলে দর্শকের সাথে শক্ত যোগাযোগ তৈরী হয়।কারণ যেটা দিয়ে এগুতে পারব, সেটাই আমি দর্শককে দেখাতে চাই। আজকাল নারীপ্রধান ও পুরুষ প্রধান চরিত্র বলে কিছু নেই। মূল ব্যাপার গল্প। ছবিতে নারী বা নারীর চরিত্রের উপস্থিতি যদি পুরুষের থেকে বেশি হয় সেটাতে কোনো যায় আসে না। রেখা অনেক আগেই নারীপ্রধান চরিত্রে অভিনয় করে সফল হয়েছেন। এরপর তাবু, প্রিয়াংকা চোপড়া, বিদ্যা বালান সবাই নারীপ্রধান চরিত্রে অভিনয় করে সুনাম কুঁড়িয়েছেন। ‘ডার্টি পিকচারে’র মতো ছবি কয়জন করতে পারে!
আমি এখন ছবির চরিত্রের ভেদাভেদ রাখতে চাই না। তবে আমি নারীপ্রধান চরিত্রে অভিনয় আরো বেশি বেশি করতে চাই। আরো বেশি চ্যালেঞ্জ নিতে চাই। যেটা এখানো আমি প্রকাশ করিনি সেটা করতে চাই। একটা নারীর সহানুভূতি ও সাহস দিয়ে সবার হৃদয় ছোঁয়া যায়।
এনটিভি অনলাইন : বাংলাদেশের আর কোনো চলচ্চিত্রে কাজ করার কথাবার্তা চূড়ান্ত হয়েছে কি?
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত : প্রস্তাব পেয়েছি অনেক। তবে আপতত করার ইচ্ছে নেই। আগে ‘একটি সিনেমার গল্প’ ভালোভাবে আসুক। আলমগীর ভাই যখন ছবিটির কথা আমাকে বলেছিলেন তখন আমি তাঁকে বলেছিলাম, ‘এই ছবিটি হতেই হবে।’ এটা আমার কাছে একটি বিশেষ ছবি।
এনটিভি অনলাইন : আবার ঢাকায় কবে আসবেন?
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত : ‘একটি সিনেমার গল্প’ ছবিটি মুক্তির আগে আসার ইচ্ছে রয়েছে। ছবির প্রচারণায় অংশ নেব।
এনটিভি অনলাইন : এবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে কথা বলি। অভিনয়ের সঙ্গে আপনি কীভাবে যুক্ত হয়েছেন?
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত : অভিনয় হঠাৎ করে আমার জীবনে এসেছে। অভিনয় করা আমার জীবনের পরিকল্পনার মধ্যে ছিল না। ছোটবেলা থেকে সাংস্কৃতিক অনেক অনুষ্ঠানের সঙ্গে আমি যুক্ত ছিলাম। নাচ শিখতাম। ছবি আঁকা শিখতাম। অভিনয়ের কোনো ফরমাল ট্রের্নিং আমার ছিল না।
এনটিভি অনলাইন : আপনার প্রথম ছবি ‘শ্বেতপাথরের থালা’ মুক্তি পায় ১৯৯৫ সালে। ছবির শুটিংয়ের কথা মনে আছে?
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত : অনেক নার্ভাস ছিলাম। অর্পনা সেন, দীপঙ্কর দে দাদার মতো বড় বড় শিল্পীর সঙ্গে অভিনয় করেছি। তাঁদের সঙ্গে অভিনয় করা খুব চালেঞ্জিং ছিল। আমি সেটা জয় করে নিয়েছিলাম। পরে ছবির প্রতি ধীরে ধীরে আমার ভালোবাসা বাড়ে। আগ্রহ তৈরি হয়। তখন আমি আমার জায়গাটাকে আরো উর্বর করি।
এনটিভি অনলাইন : অভিনেত্রী না হলে কী হতেন?
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত : অভিনেত্রী না হলে আমি টিচার হতাম। ছোটবেলা থেকে টিচার খুব পছন্দ করতাম। বিভিন্ন রচনায় আমি লিখেছি যে আমি টিচার হতে চাই। টিচাররা যখন ব্ল্যাকবোর্ডে পড়াতেন তখন আমার খুব ভালো লাগত।
এনটিভি অনলাইন : প্রিজম এন্টারটেইনমেন্ট নামের একটি প্রযোজনা সংস্থাও আপনার রয়েছে। সেখান থেকে বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ প্রযোজনার কোনো ছবি নির্মাণের ইচ্ছে আপনার আছে কী?
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত : হ্যাঁ, কাজ করার ইচ্ছে আছে। শিগগির হয়তো করব।
এনটিভি অনলাইন : থ্যালাসেমিয়া রোগাক্রান্ত শিশুদের সাহায্যার্থে আপনি সহযোগিতা করে থাকেন। এ ছাড়া বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আপনি জড়িত। এ ধরনের কাজ করার অনুপ্রেরণা কীভাবে পেয়েছেন?
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত : শুধু থ্যালাসেমিয়া রোগীদের নিয়ে নয়। এ ধরনের অনেক কাজ আমি করছি। এটা আমার আনন্দের জায়গা। আমার দায়বদ্ধতা আছে। আমি মানসিকভাবে ভালোবেসে কাজটা করছি। আমি মনে করি প্রত্যেক নাগরিকের সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকা উচিত। এটা আমাদের দায়বদ্ধতা। এটা প্রত্যেকের চেতনা ও কাজের মধ্যে থাকা উচিত।
এনটিভি অনলাইন : আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত : চলচ্চিত্রে অভিনয় করছি। অভিনয় করে যেতে চাই।