গ্রুপ থিয়েটার কনসেপ্ট থাকবে না : শামীমা
শেষ হয়ে এলো উৎসবের ক্ষণ। ‘রাঢ়াঙ’-এর ১৫০তম প্রদর্শনীকে সঙ্গে নিয়ে আরণ্যক নাট্যদলের নাট্যোৎসবের পরদিন বৃষ্টিভেজা মুহূর্তে কথা হয়ে গেল তাঁর সঙ্গে—তিনি শামীমা শওকত লাভলী। ‘রাঢ়াঙ’ নাটকের প্রথম প্রদর্শনী থেকে আজ অবধি যিনি প্রতিবাদী তরুণ আলফ্রেড সরেনের মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করে আসছেন।
প্রশ্ন : ‘রাঢ়াঙ’ উৎসব তো শেষ হয়ে এলো। কেমন লাগছে সব মিলিয়ে?
উত্তর : প্রচণ্ড উৎকণ্ঠা, ব্যস্ততা, ভালোলাগার পরে বেশ ভালো। বৃষ্টির কারণে শিল্পকলার বাইরের প্রাঙ্গণটি ব্যবহার করতে পারিনি সাজসজ্জার ক্ষেত্রে, লবিতেই আটকে যেতে হলো। তবু দর্শককে কাছে পেয়েছি, এতে ভালো লাগছে।
প্রশ্ন : ‘রাঢ়াঙ’-এ অভিনয় বা চরিত্রে চিত্রায়ণ সম্পর্কে বলুন।
উত্তর : আলফ্রেড সরেনের মায়ের চরিত্র নিঃসন্দেহে চ্যালেঞ্জিং একটি চরিত্র ছিল। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সেই জীবনে আলফ্রেডের সংগ্রামী হয়ে ওঠা, যা সে তাঁর মায়ের কাছ থেকে শিখতে থাকে। তাঁর বাবাও বিদ্রোহী ছিলেন। স্বামীর সেই আদর্শ ছেলের মধ্যে সঞ্চারিত করেন মা। এসব বোঝাপড়া ফুটিয়ে তোলার দিকে খেয়াল রাখতে হয়েছে। এই তো।
প্রশ্ন : বাংলাদেশের থিয়েটার প্রসঙ্গে আসি। কী মনে করেন, বিশ্ব নাট্যাঙ্গন বিবেচনায় বাংলাদেশের থিয়েটার কোথায় দাঁড়িয়ে?
উত্তর : ভালো জায়গায় দাঁড়িয়ে। আমরা একসময় ভাবতে পারিনি, মঞ্চনাটক নিয়ে দেশের বাইরে যাবো। আজ যাচ্ছি। কিছু প্রযোজনা অবশ্যই আন্তর্জাতিক মানের। কিন্তু কারিগরি দিক থেকে আমরা পিছিয়ে এখনো অনেক। আরো পড়াশোনা করে আসবে ছেলেমেয়েরা, তখন এসব উতরে ওঠা সম্ভব হবে হয়তো। যেমন দেখো ‘টার্গেট প্লাটুন’ করার সময় আমরা জামিল আহমেদের কাছ থেকে জানতে পেরেছিলাম, শিল্পকলায় ৩০০ রকমের লাইট আছে আর ব্যবহৃত হয় মাত্র ২০-২৫টি। ভাবো তবে।
প্রশ্ন : দেখুন, থিয়েটারে পেশাদারিত্ব নিয়ে এখনো এ কথা কেউ কেউ বলেন যে, অর্থের দিক বিবেচ্য হলে মান কমে যাবে।
উত্তর : না, আসলে আমার তেমন মনে হয় না। এই যে দেখো, দেরি করা বা রিহার্সেলে না আসা, এগুলোর পেছনে অর্থের একটা ব্যাপার থাকে। কই, শুটিংয়ে তো এমন করছে না, যারা রিহার্সেলে করছে। আবার এই যে মামুন ভাই (মামুনুর রশীদ) বলেন প্রায়ই, কষ্ট করে চাকরি করে দিন শেষে ছেলেমেয়েগুলো আসে, মনের তাগিদেই তো আসে।
এটাও একটা বিষয়। রোজার দিন আমরা যে রিহার্সেল করলাম, বাড়ি ফিরতে ফিরতে দশটা-বারোটা বাজে কারো কারো। সেই ছেলেমেয়েগুলোর পরিবার হয়তো সারা সন্ধ্যা বসে রইল, ওদের নিয়ে ঈদের শপিংয়ে যাবে বলে। অর্থ এলে একজন শুধু থিয়েটার করে চলার মতো জোর পেত।
প্রশ্ন : এই যে শুধু থিয়েটার করে চলার জোর আজো পাওয়া যায় না, এর মূল কারণ কী?
উত্তর : বিদেশে তো চুক্তিবদ্ধ থাকতে হচ্ছে থিয়েটারকর্মীদের, এ কাজের বাইরে তারা অন্য কাজ করতেই পারবে না। ভারতে কানহাই লাল, রতন থিয়াম উনারা তো নাটকই করছেন শুধু। এতে মনোযোগও পূর্ণভাবে দেওয়া সম্ভব। না হওয়ার পেছনে কারণ হিসেবে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার অভাব তো আছেই। কর্মশালার মাধ্যমে এখন টাকা পাওয়া যাচ্ছে তবু। এ রকম হয়তো ভবিষ্যতে হবে যে, গ্রামীণফোন বা এ রকম কোম্পানি একটা নাটকের দায়িত্ব নিল, প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করল। ব্যানারে, টিকেটে, ব্রুশিয়ারে ওদের লোগো থাকল।
প্রশ্ন : এনজিওভিত্তিক কাজগুলোতে তো অর্থ উপার্জন করা যায়, তবু।
উত্তর : তা যায়, কিন্তু এ ক্ষেত্রে সমস্যা আছে। এনজিও নাটক করে মূলত একটা মেসেজ দেওয়ার জন্য, তারা যে মেসেজটা দিতে চাইছে। সেখানে শিল্পীর, নির্দেশকের বাধা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রচুর। নয়তো এনজিওভিত্তিক পথনাটক তো অনেক হচ্ছে। তার প্রভাব সামগ্রিকভাবে পড়ছে বলে তো মনে হয় না।
প্রশ্ন : থিয়েটারে রাজনীতি, এটা নিয়ে কিছু বলবেন। এই যে সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব, দলে কর্তৃত্ব ধরে রাখার রাজনীতি, কোন্দল-অন্তর্দ্বন্দ্ব। অনেক ছেলেমেয়ে বাধ্য হয় দল ছেড়ে দিতে।
উত্তর : আমরা যদি সংসারটা দেখি, দেখতে পাবো ভাবি-ননদ, স্বামী-স্ত্রী, মা-বাবা কোন্দল হচ্ছে প্রায়ই, তাই না? আর দলে একেক মানুষ একেক পরিবারের, মতের অমিল থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। যখন চাকরি করছ, তখনো তোমাকে দলাদলির মধ্যে পড়তে হতে পারে, থিয়েটারও তো কাজের ক্ষেত্র। কে কীভাবে ডিল করবে, সেটা তার ওপর নির্ভর করে। কিন্তু কোনো কিছুই চরম পর্যায়ে করা ঠিক নয়। ধরো, দলে একজনকেই শুধু ভালোবাসা আর স্নেহ করা হয়, এখন শুধু সেই ছেলে বা মেয়েটিকে যদি প্রাধান্য দেওয়া হয় আর অন্যরা বঞ্চিত হয়, এটা নিঃসন্দেহে মানা যায় না। এ ক্ষেত্রে দলে আত্মসমালোচনার জায়গা খোলা রাখতে হবে। অভিমান করে দল ছেড়ে দেওয়া বা নিজের জায়গাটুকু ছেড়ে চলে যাওয়া সমাধান নয়। জুনিয়রদের নিয়েও যেমন দলকে ভাবতে হবে, তেমনি প্রতিটি ছেলেমেয়েরও উচিত দল নিয়ে ভাবা। গ্রুপ থিয়েটার কনসেপ্ট একসময় আর থাকবে না।
প্রশ্ন : বাংলাদেশে রেপারেটরি থিয়েটার আদতেও কি চালু আছে? যা হচ্ছে তা কি রেপারেটরি থিয়েটার?
উত্তর : না, একদমই নয়। একটা চুক্তিবদ্ধ সিস্টেমের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, তবেই তা রেপারেটরি থিয়েটার। বাইরে তাই হয়। আবার সেই মামুন ভাই, মামুনুর রশীদের কথাই বলতে হবে। উনিই কিন্তু ‘বাংলা থিয়েটার’ চালু করেছিলেন, ৫০০ টাকা প্রতি শো দিতেন। মানুষ বিষয়টি আস্তে আস্তে জানবে, বুঝবে।
প্রশ্ন : শিল্পকলা একাডেমির ইতিবাচক আর নেতিবাচক দিকগুলো কী?
উত্তর : এটা অনেক আনন্দের যে, আমাদের এত বড় একটি শিল্পকলা একাডেমি আছে। এশিয়ার মধ্যে অনেক দেশেই কিন্তু এত বড় শিল্পকলা একাডেমি নেই। কিন্তু নেতিবাচক দিকগুলো হলো, মহড়াকক্ষ মাত্র পাঁচ থেকে ছয়টি। অথচ স্টাফরুমগুলো দেখো, কত বড় বড়। তাঁরা তো পারেন এক রুমে কয়েকজন বসতে, রিহার্সেলের রুম তাতেই বেড়ে যায়। তার পর ডিজাইনগত সমস্যার কারণে অনেক জায়গাকে ব্যবহারই করা যাচ্ছে না। রক্ষণাবেক্ষণের নামে শুধু চুনকাম করলে তো হবে না, তাই না? এই জিনিসগুলোর দিকে লক্ষ রাখা উচিত।
প্রশ্ন : দেখুন, এখন তো নৃত্য ও সংগীত ভবন, চলচ্চিত্রশালা আছে। কিন্তু ফিল্ম ফেস্টিভাল হচ্ছে দেখা যায়, মঞ্চকর্মীরা জানেন না, এক ক্ষেত্রের সঙ্গে অন্য ক্ষেত্রের যোগাযোগ খুব কম।
উত্তর : হ্যাঁ, আসলে শিল্পকলা ব্যানার ঝুলিয়ে দেয়, কিন্তু অনেকেই লক্ষ করে না। আবার ধরো, এই যে তুমি ভাবলে এ রকম, দশজন ভাবলে হয়তো দলে কথা হলো। এ রকমভাবে যোগাযোগ বৃদ্ধি করা সম্ভব।
প্রশ্ন : এখনো থিয়েটার থেকে অনেক মানুষ বিচ্ছিন্ন। এর দায়ভার কার?
উত্তর : কী আর বলি, সব দায়ভার তো শিল্পীদের ওপরই বর্তায়। কিন্তু এই শিল্পীরাই আবার আন্দোলনও করেছে এটার জন্য। এই যে এখন বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজগুলোতে নাট্যকলার ওপর পড়ানো হচ্ছে, এটাও দীর্ঘ আন্দোলনেরই ফসল। এ রকমভাবে এখনো মামুন ভাইরা এটা নিয়ে কাজ করেই চলেছেন, স্কুল-কলেজে বাধ্যতামূলকভাবে নাটকের বিষয়গুলো পড়ানো হচ্ছে, বাংলা কিংবা ইংলিশ যে মিডিয়ামই হোক। এভাবে শিশু-কিশোররা যখন বড় হবে, তখন তারা জানবে-বুঝবে নাটককে, মঞ্চনাটক দেখতে আসার আগ্রহ জন্মাবে। আমরা হয়তো দেখে যেতে পারব না, তোমরা দেখবে হয়তো যে অধিকাংশ মানুষ এই বাংলাদেশে নাটক দেখতে আসছে।
প্রশ্ন : নিজে আপনি একাডেমিক শিক্ষা নিয়েছেন নাটকের ওপর, একাডেমিক ও নন-একাডেমিক দ্বন্দ্বও কিন্তু কম নয়, এটাকে কীভাবে দেখেন?
উত্তর : নাটক জানা-বোঝার ব্যাপার। কে কীভাবে জানল বা বুঝল, সেটা ব্যাপার না। দেখো শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্ত, মামুন ভাই, বাচ্চু ভাই উনারা কি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন নাটক নিয়ে। কিন্তু উনাদের জানার পরিধি দেখো। উনারা নিজেরাই একেকটা ইনস্টিটিউট। এখন যেভাবে অনেক নাট্যকলার ছেলেমেয়ে ভাবছে, আমি কেন কোন দলে গিয়ে বসে বসে শিখব—এটা যেমন ঠিক নয়, তেমনি অনেকে যখন ভাবেন, এদের কাছ থেকে আর কী নেওয়ার আছে আমাদের, আমরা তো বহু বছর ধরে দল করি—এটাও ঠিক নয়। আদান-প্রদান হলে তবেই না ক্ষেত্রটা সমৃদ্ধ হবে।
প্রশ্ন : যাঁরা নাটক করতে আসেন, আসছেন ইদানীং তাঁদের পড়াশোনা কেমন? আপনি তো তরুণদের নিয়েই কাজ করেন সাধারণত।
উত্তর : এটা বলতেই হবে, যদিও দুঃখজনক, নাটকের অঙ্গনের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা খুব কম। এরা বই পড়েই না। আরেকটা জিনিস, কোনো নাটক হচ্ছে, দেখা গেল কয়েকজন সাংবাদিক এলো, ছবি তুলল তার পর চলে গেল। এর পর দেখি সেই নাটকের রিভিউ লিখেছেন, অথচ নাটক তিনি দেখেনইনি। এখন তুমি ধরো মামুনুর রশীদের সাক্ষাৎকার নেবে, না পড়ে কি যাবে বলো? যাওয়া কি উচিত? তবু ভালো ইদানীং কিছু কিছু ছেলেমেয়ে ভালো লিখছে, জেনেবুঝে কাজ করছে। পড়াশোনাটা খুব জরুরি, একজন চাষি-মুচি-ডাক্তারের জীবন না জানলে তাঁর চরিত্র কী করে ধারণ করবে তুমি? স্টিফেন হকিং না পড়ে কি তাঁকে নিয়ে নাটক লেখা বা করা সম্ভব?
প্রশ্ন : কী নিয়ে ব্যস্ততা ইদানীং আর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী নাটক নিয়ে?
উত্তর : আমি তো বটতলার ‘দ্য ট্রায়াল অব মাল্লাম ইলিয়া’তে কাজ করলাম। এ ছাড়া ‘প্রথম পার্থ’র কস্টিউম ডিজাইন করেছি। ‘বঙ্গলোক’ থেকে নতুন একটা নাটক ধরবে, ওটার নির্দেশনা দেব সামনে। এ ছাড়া দলে নিয়মিতভাবে কাজ তো করেই যাচ্ছি। আমি আজ যেখানে এসেছি, সমস্তই ‘আরণ্যক’-এর জন্য সম্ভব হয়েছে। এই যে এত মানুষের সঙ্গে পরিচয়, এত দেশ ঘোরা সব আমাকে আরণ্যকই দিয়েছে, কৃতজ্ঞ আমি আমার দলের প্রতি। ভবিষ্যতে আমৃত্যু মঞ্চকর্মী হয়ে কাজ করে যেতে চাই। অভিনয় করতে চাই। ইদানীং ডিরেকশনের প্রতিও ঝোঁকটা বাড়ছে।
প্রশ্ন : অনেকক্ষণ আড্ডা হলো। ভালো লাগল।
উত্তর : আমারও ভালো লাগল। ভালো থেকো সব সময়।