‘বরফভর্তি পুলে লাফ দেওয়াটা সহজ ছিল না’
‘ব্যান্ড বাজা বারাত’ দিয়েই বক্স-অফিসে বাজিমাত করেন রণবীর সিং। কিন্তু বলিউডে নিজের অবস্থান শক্ত করতে পারেননি তখন। অবশেষে সঞ্জয় লীলা বানসালির হাত ধরে তাঁর অভিনয় জীবনে আসে নতুন মোড়। ‘গলিও কি রাসলীলা : রামলীলা’, ‘বাজিরাও মাস্তানি’ এবং সর্বশেষ ‘পদ্মাবত’ দিয়ে ভক্ত-সমালোচকদের মন জয় করে নিয়েছেন তিনি। ‘পদ্মাবত’-এ প্রথমবারের মতো অভিনয় করেছেন নেতিবাচক চরিত্রে। কেমন ছিল ‘পদ্মাবত’-এ তাঁর পথচলা। বলিউড লাইফ ডটকমের সৌজন্যে চলুন উত্তরটা জেনে নিই রণবীরের সিংয়ের কাছ থেকেই।
কোন চরিত্রটি খুব কঠিন, বাজিরাও নাকি আলাউদ্দিন খিলজি?
এই প্রথম কেউ আমাকে এ বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করেছে। কাজ শুরুর পর ‘পদ্মাবত’ নিয়ে গণমাধ্যমে একটি কথাও আমি বলিনি। আমি মনে করি, মানসিক দিক দিয়ে বাজিরাও খুবই কঠিন চরিত্র ছিল এবং আলাউদ্দিন খিলজি শারীরিক দিক দিয়ে কঠিন চরিত্র। আমাদের শুটিং প্রক্রিয়া এ জন্য দায়ী। ‘পদ্মাবত’ নিয়ে নানা ঘটনা এবং দেরির কারণে একটার পর একটা আমার দৃশ্যগুলোরই কাজ চলছিল। অ্যাকশন দৃশ্যগুলোতে ছবির শুটিং করতে করতে আমি দম ফেলার ফুরসতই পাচ্ছিলাম না। ‘খালবালি’ নাচের দৃশ্যের সময় আমার হাঁটু জেলির মতো হয়ে গিয়েছিল। আমি আমার পা অনুভব করতে পারছিলাম না। আমি অজ্ঞান হয়েছি, আবার সুস্থ হয়েছি, দূরে গিয়ে বমি করেছি, আবার শুটিংয়ে ফিরে এসেছি। এ ধরনের কস্টিউমনির্ভর ছবিগুলোতে সবাই একটি সিকোয়েন্সের জন্য ছয় থেকে আট দিন ছুটি পায়, যেটা আমি পাইনি। শুটিংয়ের প্রক্রিয়া অনেক কঠিন ছিল, কিন্তু আমি জানতাম যে আমাকে করতেই হবে। তাই আত্মিক ও মানসিক দিক দিয়ে বাজিরাও কঠিন চরিত্র, কিন্তু খিলজিও বাজিরাওর থেকে কম নয়।
বলিউডপাড়ায় একটি গুঞ্জন ছিল, খিলজি চরিত্রকে আপনার মাথা থেকে মুছে ফেলতে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হয়েছেন। এটা কি সত্য?
না, মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যাইনি। তবে যেতে হতো যদি আমার তথাকথিত প্রাথমিক চিকিৎসা কাজ না করত। আমি আমার পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে কিছু ভালো সময় কাটিয়েছি। আমি আমার হৃদয়ের সঙ্গে কথা বলেছি, যে আমি এখন কেমন অনুভব করেছি। আমি তাঁদের সবার কথা শুনেছি। তাঁরা আমার চিকিৎসক ছিল। ধীরে ধীরে ছবি শুরুর আগে আমি যে অবস্থায় ছিলাম, সে অবস্থায় ফিরে এসেছি। তবে একটা সময়ে আমি অনুভব করছিলাম, আমি নিজেকে চরিত্রের মাঝে হারিয়ে ফেলেছি এবং মনে হয়েছিল আমার চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। কিন্তু আমার প্রাথমিক চিকিৎসা কাজ করেছে।
রণবীর ও খিলজির মধ্যে কোন মিল আছে?
না, কোনো মিল নেই। আমি এমন একজন মানুষের সঙ্গে নিজেকে মেলাতে পারি না, যে একাধারে প্রভাববিস্তারকারী, লোভী ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী। একজন মানুষ যে চোখের পলকে অন্যের ক্ষতি করতে পারে। আমি এ রকম হতে পারি না। আমার প্রস্তুতি ও বাড়ির কাজের অংশ হিসেবে আমি ইতিহাসে এমন কিছু মানুষের চরিত্র পড়েছি, যাদের দৃষ্টিভঙ্গি খিলজির সঙ্গে মিলে যায়। আমি নিজেকে এটাই বুঝিয়েছি, পৃথিবীতে খিলজির মতো লোকেরাও রয়েছে এবং নিজেকে চরিত্রের ভেতরে প্রবেশ করিয়েছি। আমি আমার জীবনের গভীর, কালো গর্তের ভেতর কবর দেওয়া জীবনের কালো স্মৃতিগুলোকে বের করেছি। সেগুলোকে সুন্দর করে পরিষ্কার করে আবার আমার বিবেকের মধ্যে কবর দিয়ে দিয়েছি। আমি আমার জীবনের পৈশাচিক দিকগুলোর মুখোমুখি হয়েছি এবং আমার অভিনয়ে তাঁদের ব্যবহার করেছি। এটা অনেকটা বিশোধনের মতো। তবে এখন আমি অনেক হালকা, সুখী ও ভালো অনুভব করছি। মানুষের প্রতি এখন আমার শুধু ভালো অনুভূতিগুলো প্রাধান্য পায়। এখন দেওয়ার মতো অনেক প্রেম, ভালোবাসা, দয়া জমেছে আমার।
ছবির কোন দৃশ্যটি কঠিন ছিল?
ছবিটার শুটিং যেভাবে গিয়েছে, চরিত্রটা শারীরিক দিক দিয়ে কঠিন ছিল। জটিল ও বিশদ নাচের দৃশ্যের পর আমাকে অ্যাকশন দৃশ্যের শুটিং করতে হয়েছে। প্রতিদিন শুটিং শেষে আমি আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত বরফে ডুবিয়ে রাখতাম শারীরিক ক্লান্তি দূর করে দেহটাকে ফিরে পাওয়ার জন্য। আমি সেখানে তিন থেকে ছয় মিনিট থাকতাম। আমি ধীরে ধীরে নিজেকে তৈরি করেছি। বরফভর্তি পুলে লাফ দেওয়াটা সহজ ছিল না। আমার শরীর ভেঙে যাচ্ছিল, চিৎকার করতে গিয়ে আমার গলা ভেঙে যাচ্ছিল এবং আমি পাশবিক সব অ্যাকশন দৃশ্যে অভিনয় করেছি। আমার ছোট ছোট কিছু ভালোলাগা রয়েছে। বরফ গোসলের পর আমি আমার ভালোলাগাগুলোকে নিয়ে থাকতাম। এভাবে আমি নিজের মধ্যে ফিরে আসতাম এবং আবার শুটিংয়ে যেতাম। আমি নাচের দৃশ্যের পরপরই অ্যাকশন দৃশ্যের শুটিং করেছি। ৩৭তম দিনে আমি সত্যিই পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিলাম।
মালিক কাফুর চরিত্রে জিম সাবরার সঙ্গে আপনার রসায়ন সবাই পছন্দ করেছে।
লোকজন আমার আর জিমের দৃশ্যগুলো অনেক কথা বলছে (হাসি)। এটা দেখে আসলেই ভালো লাগছে। আমি যত সহ-অভিনেতার সঙ্গে অভিনয় করেছি, তাঁদের মধ্যে জিম সবচেয়ে সমৃদ্ধ। এটা আপনাদের সবার জানা উচিত, জিমের পোশাক পরিচ্ছদের পরিকল্পনা আমার করা। ‘নীরজা’য় আমি তাঁর অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়ে যাই। আমিই সঞ্জয় (সঞ্জয় লীলা বানসালি) স্যারকে বলেছিলাম, কাফুর চরিত্রের জন্য তাঁকে নিতে। প্রথম অডিশনেই সে পাস করে যায়। আমি অনেক রোমাঞ্চিত তাঁর অভিনয়ের প্রশংসা দেখে। আপনারা ভালো করেই জানেন, ছবির প্রতি তাঁর অবদান কতটুকু ছিল।
অনেক কমসংখ্যক মূলধারার অভিনেতা উভকামী খলচরিত্রে অভিনয় করার সাহস করে। আপনার কি কোনো আশঙ্কা ছিল যে এটা বুমেরাং সিদ্ধান্ত হতে পারে?
খিলজি এমন একজন মানুষ, যার অনেক খারাপ দিক আছে। ব্যক্তিগত জীবনে আমি খুবই সোজাসাপ্টা। উভকামী খলচরিত্রে অভিনয় করতে অনেক মূলধারার অভিনেতারাই সাহস করে না। চলচ্চিত্র কল্পনাপ্রধান। একজন আমাকে একবার বলেছিলেন, আমি যে চরিত্রই পাব না কেন, তাতেই মানিয়ে নিতে পারব। তাই এমন কিছু যেটা আগে কেউ কখনো করেনি, সে রকম চরিত্রে অভিনয়ের চ্যালেঞ্জটা আমাকে বরাবরই আকর্ষণ করেছে। ভীতি প্রদর্শনের জন্যই উভলিঙ্গের বিষয়টা চরিত্রের সঙ্গে যোগ করা হয়েছে, এটা আমার জন্য সম্পূর্ণ বিকৃতি বলা যায়। ভিন্ন মূল্যবোধের মানুষ পর্দায় কীভাবে একজন রক্ষণশীল ও প্রাচীন মূল্যবোধে বিশ্বাসী মানুষের চরিত্রে অভিনয় করবে। তাই আমি এই চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে কিছুটা শঙ্কায় ছিলাম। আমি উদ্বিগ্ন ছিলাম, কিন্তু সঞ্জয় স্যার আমাকে প্রভাবিত করেছেন। তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন যে আমি অভিনয় করতে পেরেছি, আবার নিজের মাঝে ফিরেও আসতে পেরেছি। আমি জানি আমাকে একজন অভিনেতা ও শিল্পী হিসেবে গড়ে তুলতে তিনি কতটা অবদান রেখেছেন। আমি তাঁর বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছি। তিনি আমাকেই জোর করেছিলেন যে আমার এই চরিত্রে অভিনয় করতে হবে। আমরা একসঙ্গে যতগুলো কাজ করেছি, সেগুলোর সবকটি নিয়েই আমি বেশ রোমাঞ্চিত।