হয়তো কোনোদিন বাংলাদেশ থেকে প্রস্তাব পাব : দেবলীনা
টেলিভিশনে অভিনয় করাই তাঁর প্রথম প্রেম। মাঝেমধ্যে ভালো চরিত্র পেলে তবেই বড়পর্দায় অভিনয় করতে চান টলিউড অভিনেত্রী দেবলীনা দত্ত। বাংলাদেশের সাহিত্যিক আল মাহমুদের লেখা গল্প অবলম্বনে ‘টান’ ছবিতে এক পানিবেশ্যার চরিত্রে অভিনয় করে বহুদিন বাদে আবার আলোচনায় উঠে এসেছেন। তা ছাড়া পরিচালক পার্থ সেনের ছবি ‘অনুব্রত ভালো আছো’-তে নীতা চরিত্রে অভিনয় করেও সবাইকে মুগ্ধ করেছেন দেবলীনা। টলিপাড়ায় কাজের ফুসরত গলে একদিন ধরা গেল এই মিষ্টি নায়িকাকে। বাংলাদেশের এনটিভি অনলাইনের কথা বলতেই এককথায় রাজি হয়ে গেলেন সাক্ষাৎকার দিতে। হাতে সময় খুব কম। যে কোনো সময়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন তিনি। তাই দেরি না করে চটপট প্রশ্ন করা শুরু করলাম তাঁকে।
প্রশ্ন : বাংলাদেশের দর্শকদের কাছে আপনি কিন্তু বেশ পরিচিত মুখ, জানেন সেটা?
দেবলীনা : হ্যাঁ, জানি তো। (এবারে হেসে ফেলে) কিন্তু শুনেছি, আমাকে নাকি কেউ সহ্য করতে পারেন না। আসলে আমি নেগেটিভ চরিত্রে বেশি অভিনয় করি তো, তাই দেখবেন আমাকে দেখলেই সবাই ইট-পাটকেল ছুড়বেন।
প্রশ্ন : সেটা তো একজন অভিনেতা কিংবা অভিনেত্রীর কাছে আশীর্বাদ? আপনার কী মত?
দেবলীনা : সেটা তো ঠিকই। তবে যখনই কোনো পার্টিতে যাই, বা পরিচিত কারোর সঙ্গে দেখা হয়, তখন তারাই বলে, এত নেগেটিভ রোল করিস কেন? কিন্তু জানেন তো, আমার আবার এই রকম চরিত্রে অভিনয় করতে ভালোই লাগে। এসব ক্ষেত্রে অভিনয়ের বিশাল সুযোগ থাকে। একজন অভিনেতা কিংবা অভিনেত্রী হিসেবে তো সেটাই দরকার।
প্রশ্ন : ‘অনুব্রত ভালো আছো’ ছবিতে নীতার চরিত্রে তো দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন। একজন মৃত্যুপথযাত্রী, ক্যানসার রোগী। অসাধারণ অভিনয় করেছেন কিন্তু!
দেবলীনা : সবার ভালো লাগলে, ভালো লাগে আমারও। এই ছবিটি আপনাদের বাংলাদেশেও দেখতে পাবেন। বাংলাদেশের দর্শকরা ছবিটি দেখার পর আশা করছি আরো বেশি ফিডব্যাক পাব।
প্রশ্ন : বাংলাদেশ নিয়ে কোনো স্মৃতি আছে?
দেবলীনা : (হাসতে হাসতে) না না, তেমন কোনো স্মৃতি নেই। মধ্যে কিছুদিন এখানকার ‘স্বপ্নসন্ধানী’নাট্যদলের সঙ্গে কাজ করেছিলাম। তাদের কিছু কল শো-তে বাংলাদেশ যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওই সময় আর যাওয়া হয়নি। তবে আশা করছি, বাংলাদেশ থেকে হয়তো কোনোদিন কাজের প্রস্তাব পাব।
প্রশ্ন : আপনি তো বহু বছর ধরেই টিভিতে নানা ধারাবাহিক ও টেলিফিল্মে অভিনয় করছেন। বড়পর্দায় আসতে এত দেরি হলো কেন?
দেবলীনা : এটা ঠিক নয়। আমি বড় পর্দায় এসেছিলাম আজ থেকে প্রায় ১৫ বছর আগে। চিরঞ্জিতদার পরিচালনায় ‘মানুষ-অমানুষ’ ছবিতে। ছবিটিতে চিরঞ্জিতদা ও ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত ছিলেন। ছবিটি খুব ভালো ব্যবসাও করে। আমার কাজও অনেকের পছন্দ হয়। কিন্তু সেভাবে তারপর আর ভালো চরিত্রের অফার পাইনি। তাই বড়পর্দায় কাজ করিনি। আর একটা ব্যাপার হলো, আমি যে রকম কাজ করতে চাইছি, সেই ধরনের কাজ না পেলে অভিনয় করতে চাই না। মাঝে বহুদিন নাটক করলাম। অভিনেতা কৌশিক সেনের নাট্যদল ‘স্বপ্নসন্ধানীর’ সঙ্গে ‘ভয়’ বলে একটা নাটক করলাম। মঞ্চে অভিনয় করলে কী হয় জানেন তো, অভিনয়ের মাত্রাটা আরো জোরালো হয়।
প্রশ্ন : আপনার কি নেগেটিভ চরিত্রে অভিনয় করতে বেশি ভালো লাগে?
দেবলীনা : ভালো লাগে মানে, দেখুন, এসব চরিত্রে অভিনয় করার একটা বিরাট সুযোগ থাকে। ‘একলা আকাশ’ ছবিতে আমার চরিত্রকে যদি শুধু নেগেটিভ চরিত্র বলেন, তাহলে হয়তো কম বলা হবে। ওই চরিত্রটা একটা ‘বিচ’। আবার দেখুন ‘টান’ ছবিতে আমার চরিত্রটা একেবারে থার্ড গ্রেড একজন ‘পানিবেশ্যার’। অভিনয় দিয়ে সেই চরিত্রটা ফুটিয়ে তোলার জন্য আমাকে বহুদিন নাট্যশিল্পী সোহাগ সেনের কাছে ওয়ার্কশপ করতে হয়েছে। আবার ‘অনুব্রত ভালো আছো’ ছবিতে আমার চরিত্র একজন মৃত্যুপথযাত্রী ক্যানসার পেশেন্টের। আমাকে অভিনয়ের আগে দেখতে হয়েছে, তাদের অবস্থা কী রকম। কেমো নেওয়ার পর তাদের শরীরের অবস্থা কেমন হয়। অর্থাৎ বলতে চাইছি, এই চরিত্রগুলোতে কাজ করার, অভিনয় করার সুযোগ থাকলেই সেই চরিত্রে আমি কাজ করব।
প্রশ্ন : ‘টান’ ছবির দৌলতে তো আপনি বিশেষ পুরস্কার পেয়েছেন?
দেবলীনা : আমার ব্যক্তিগত মত শুনবেন? শুধুমাত্র একটা পুরস্কারের ফলক অভিনয়ের স্বীকৃতি হতে পারে না। এই যে আপনি বাংলাদেশের মিডিয়ার জন্য আমার সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন, আবার এটাও তো বলছেন, সেখানে আমার ভালোবাসার দর্শকও প্রচুর। বলুন তো, সেটা কি ওই একটা দুটো পুরস্কারের জন্য? অবশ্যই নয়। আমার কাজের জন্য। আর স্বীকৃতি পেতে কার না ভালো লাগে? তবে স্বীকৃতি না পেলে মনমরা হয়ে পড়ে থাকার কোনো কারণ নেই।
প্রশ্ন : অভিনয়জগতে আসার পেছনে বিশেষ কোনো কারণ আছে?
দেবলীনা : আমি উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর একটা সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় নাম দিয়েছিলাম। সেখান থেকেই আমার বহুক্ষেত্রে মডেলিং করার সুযোগ আসে। আর সেই সূত্রেই আমার কাছে ধারাবাহিকে অভিনয় করার অফার আসে। এরপর কাজ করতে করতে অভিনয়টা আমার বেশ ভালো লেগে যায়। তাই ভাবলাম, এটাই পেশা হিসেবে নিলে কেমন হয়?
প্রশ্ন : এখনো পর্যন্ত যা কাজ করেছেন তাতে আপনার অভিনয়ের সঠিক মূল্যায়ন হচ্ছে বলে আপনি মনে করেন?
দেবলীনা : দেখুন টিভিতে প্রথম থেকেই হয়েছে। তবে আমার সাম্প্রতিক ছবিগুলো দেখুন। মনে হয়, সবেমাত্র আমি আমার মনের মতো অভিনয় করার সুযোগ পাচ্ছি। এরপরেই তো আসবে মূল্যায়নের বিষয়।
প্রশ্ন : আপনার কেরিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট কোনটি?
দেবলীনা : আমার মতে, ‘এক আকাশের নিচে’ ধারাবাহিকটি আমার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। অবশ্য এর আগেও বহু কাজ করেছি। সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদারের কাহিনী অবলম্বনে ‘সাতকাহন’-এও কাজ করেছি। কিন্তু ‘এক আকাশের নিচে’ আমায় যে মাইলেজ দিয়েছে, তা অন্য কোনো সিরিয়াল দেয়নি।
প্রশ্ন : শোনা যায়, আপনি নাকি খুব ভালো মেকআপ করেন? এমনকি শুটিং সেটে নাকি অন্যদেরও মেকআপ করে দেন! মেকআপ করা শিখেছেন?
দেবলীনা : ঠিক শিখিনি। তবে এত বছর কাজ করতে করতে বলতে পারেন শিখে গেছি (হেসে ফেললেন)। আর এই প্রসঙ্গে বলতেই হয়, আমাদের টালিগঞ্জে খুব ভালো একজন মেকআপ আর্টিস্ট আছেন, তিনি প্রবীর দে। তাঁর কাছে বেশ কিছু মেকআপের কাজ শিখেছি। অবশ্য একজন অভিনেত্রীর যেটুকু জানা দরকার। আর আমার মনে হয়, মুখের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল জায়গা হলো চোখ। তাই মেকআপ করার সময় আমি চোখের মেকআপের ওপর জোর দেই।
প্রশ্ন : অবসরে কী করেন?
দেবলীনা : আমার বই পড়তে খুব ভালো লাগে। বিশেষ করে গোয়েন্দা গল্প পড়তে ভালোবাসি। আর অ্যাজ এ পারসন খুবই ইমোশনাল আমি। তাই মন খারাপ হলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পড়ি। ওনার লেখা আমায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে সাহায্য করে।
প্রশ্ন : ইন্ডাস্ট্রিতে সবচেয়ে কাছের বন্ধু কে আপনার?
দেবলীনা : দেখুন সেটা এককথায় যদি বলতে হয়, তাহলে বলব অভিনেতা তথাগত মুখোপাধ্যায়। খুব রিসেন্টলি আমরা বিয়ে করেছি। ওর সঙ্গে আমার রিলেশন- তা প্রায় সাত থেকে আট বছরের। আর আমার প্রিয় বন্ধু, আমার মা। আমি সবকিছু শেয়ার করি আমার মায়ের সঙ্গে।
প্রশ্ন : কোনো অবসেন?
দেবলীনা : একটা আছে। সেটা হলো আমার একটা পুতুল আছে। আমার জন্মদিনে আমার মা আমায় দিয়েছিলেন। ওটা আমার কাছে লাকি চার্ম। যে কোনো কাজে গেলে আমি ওটাকে সঙ্গে নিয়ে যাই। তবে এটা কোনো কুসংস্কার নয়। কিন্তু আমার মনে হয়, ওটা সঙ্গে থাকলে আমি খুব ভালোভাবে কাজটা করতে পারব।
প্রশ্ন : আগামী পাঁচ বছর পর আপনি নিজেকে কোথায় দেখতে চান?
দেবলীনা : মনে হয়, আমি আর তথাগত (স্বামী তথাগত মুখোপাধ্যায়) একটা ছোটখাটো প্রোডাকশন হাউস খুলতে পারব। আর আমি ব্যক্তিগতভাবে ভীষণভাবে গুছিয়ে সংসার করব।
এবার বিদায় নেওয়ার পালা। সবশেষে বাংলাদেশের সমস্ত দর্শকদের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাতেই দেবলীনা পালটা ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন, সবাই খুব ভালো থাকুন, সবার খুব ভালো সময় কাটুক। আর অবশ্যই খুব করে বাংলা ছবি দেখুন। এরপরই ফের মিষ্টি করে হেসে ফেললেন দেবলীনা।