সাক্ষাৎকার
আমি ফালতু হিপোক্রেসিতে ভুগি না : ঋত্বিক চক্রবর্তী
মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভের চাকরি ছেড়ে অভিনয়জগতে আসেন তিনি। প্রথমে নাটকে অভিনয়, তারপর স্ক্রিপ্ট লেখা, ধারাবাহিকের এক্সট্রা হিসেবে কাজ করা। জীবনে দীর্ঘ চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে অবশেষে সাফল্যের আঙিনায় পা রেখেছেন টলিউড অভিনেতা ঋত্বিক চক্রবর্তী। এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে খোলামেলা আড্ডায় মনের জানালা খুলে দেন তিনি।
প্রশ্ন : প্রথমেই আপনাকে জানাই বাংলাদেশের দর্শকদের পক্ষ থেকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ।
ঋত্বিক : আপনাদেরও শুভেচ্ছা। আপনাদের ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা না থাকলে আমি এই পথটুকু আসতে পারতাম না। কাজের সূত্রে খুব সম্প্রতি আমার সঙ্গে পরিচয় হলো জয়া’দির (অভিনেত্রী জয়া আহসান) সঙ্গে। দিদির কাছেই শুনলাম, আমাদের বাংলা ছবির নাকি ওখানে খুব কদর। আমার খুব ইচ্ছা আছে, সরাসরি দর্শকদের কাছ থেকে আমার কাজের ফিডব্যাক জানি। তবেই না নিজের কাজে আরো উন্নতি করতে পারব।
প্রশ্ন : আপনার অভিনয়ের প্রশংসা বাড়ছে, জাতীয় পুরস্কার, বিদেশি পুরস্কার, প্রতিযোগিতা আছে, প্রতিদ্বন্দ্বিতাও আছে-সব মিলিয়ে কেমন লাগছে?
ঋত্বিক : দেখুন, সব কাজেই প্রতিযোগিতা থাকে। আমি নিজে যেমন একটা ট্র্যাকে দৌড়াচ্ছি, তেমন অন্য অনেকেই সেই ট্র্যাকে দৌড়াচ্ছেন। তাঁরা আমার সঙ্গেই দৌড়াচ্ছেন। কিন্তু মাথায় একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে যে, দৌড়টা আমাকেই শেষ করতে হবে এবং জিততেই হবে। এই ভাবনাটাই ঘুম কেড়ে নিতে পারার জন্য যথেষ্ট।
প্রশ্ন : নিজের অভিনয় প্রমাণ করার জন্য পরিচালক পার্থ সেনের ছবি ‘অনুব্রত ভালো আছো’তে প্রায় পঞ্চাশোর্ধ এক ব্যক্তির ভূমিকায় অসাধারণ অভিনয় করলেন। সঙ্গে পেলেন বিদেশি পুরস্কারও। কী বলবেন?
ঋত্বিক : আলাদা করে আমার অভিনয় প্রমাণ করার কিছু নেই। তবে হ্যাঁ, আসল বয়সের তুলনায় বেশি বয়সের চরিত্রে অভিনয় করা একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ। আর কোনোদিন এই রকম চরিত্র পাব কি না জানি না। তাই সুযোগটা কাজে লাগালাম। আর পুরস্কার! ওটা তো বাড়তি এনার্জি জোগায়।
প্রশ্ন : আপনি তো একসময় মেগা ধারাবাহিকের জন্য স্ক্রিপ্ট লিখতেন।
ঋত্বিক : হ্যাঁ, আসলে তখন শুধুই অভিনয় বলতে, নাটকে অভিনয় করতাম। পেট চালাতে হবে তো।
প্রশ্ন : এখনো স্ক্রিপ্ট লেখেন নাকি ভবিষ্যতে ছবি পরিচালনার কথা ভাবছেন?
ঋত্বিক : দেখুন, ওইভাবে কিছু ভাবিনি। অভিনয়ে আসার আগে আমি একজন মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ ছিলাম। চাকরিটা ভালো না লাগায় ছেড়ে দিয়ে অভিনয়ে এসেছি। তখন টাকার প্রয়োজনে বহু রকমের কাজ করেছি। যেমন স্ক্রিপ্ট লিখেছি, তেমনি বহু মেগা ধারাবাহিকে এক্সট্রা হিসেবেও কাজ করেছি। মানে যখন যেমন সুযোগ পেয়েছি কাজে লাগিয়েছি।
প্রশ্ন : সেই মেগা ধারাবাহিকে এক্সট্রা হিসেবে অভিনয় শুরু করে আজ অভিনেতা ঋত্বিক চক্রবর্তী। জার্নিটা কেমন?
ঋত্বিক : মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভের চাকরি ছাড়ার পর নাট্যকার শেখর সমাদ্দারের ‘আভাস’ নাট্যদলের সঙ্গে যুক্ত হই। সেখানে অভিনয় করতে করতে টুকটাক সিরিয়ালেও কাজ করতাম। কখনো সংলাপ থাকত, কখনো থাকত না। এরপরেই প্রথম ব্রেক পাই, মনোজ মিত্রের ‘নিশি কুটুম্ব’ সিরিয়ালে। ওখানেই কাজ করার পরে ‘রাতভর বৃষ্টি’ সিরিয়ালে কাজ পাই। চরিত্রটা অবশ্য দিন কুড়ি বাদে মরে যায়। কিন্তু আমায় অনেকটাই জনপ্রিয় করে দিয়ে গিয়েছিল। তারপর একটু একটু করে কাজ বাড়তে লাগল।
প্রশ্ন : তারপর তো ‘শব্দ’, ‘কলকাতা কলিং’, ‘ফড়িং’, ‘একফালি রোদ’, ‘এবার শবর’ আর ‘অনুব্রত ভালো আছো’-এর মতো অসাধারণ সব প্যারালাল মুভি। কমার্শিয়াল ছবিতে তো আপনাকে দেখাই যায় না।
ঋত্বিক : আমি কমার্শিয়াল ছবিতেও অভিনয় করতে চাই। সুযোগ পেলে অবশ্যই অভিনয় করব। ইনফ্যাক্ট দেখুন, আমায় হিরো টাইপ দেখতেও নয়, আর আমার দ্বারা সেই ঝিন-চ্যাক নাচা গানাও হবে না। তবে ভালো চরিত্র পেলে অবশ্যই কাজ করব। পরিচালক সুদেষ্ণা রায় ও অভিজিৎ গুহর ‘বিটনুন’ ছবিটা দেখুন। ওই ছবিটা কমার্শিয়াল। আমার কাজও প্রশংসা পেয়েছে। আমি সেই ধরনের কাজই করতে চাই, যেখানে নিজের অভিনয়টা দেখাতে পারব।
প্রশ্ন : আজ অভিনয়ের বহু দিক আপনার জীবনে খুলে গেছে। বিশেষ করে ‘অনুব্রত ভালো আছো’ ছবির পর একথা বলতেই হচ্ছে। সেখানে দাঁড়িয়ে আপনার পেশাদার জীবনের প্রভাব কি ব্যক্তি জীবনেও পড়ছে?
ঋত্বিক : আমি এখন অনেক বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন হয়েছি। আগেই বলেছি, আমি মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভের চাকরি ছেড়ে অভিনয়ে এসেছি। প্রায় সবারই অমত ছিল। কারণ এই পেশা আজকের দিনে খুবই রিস্কের। আমি জানতাম, আমি অভিনয়টা পারব। আজকে আপনি যার সঙ্গে কথা বলছেন, সে বহু স্ট্রাগল করেই আজ এখানে এসেছে। ফলে কেউ আমায় অযথা তোষামোদ করলে আমি বুঝতে পারি। আমি ফালতু হিপোক্রেসিতে ভুগি না।
প্রশ্ন : আপনার স্ত্রী অপরাজিতা তো একজন বিখ্যাত অভিনেত্রী। একই পেশায় রয়েছেন দুজনে। ইগো ক্ল্যাশ করে না?
ঋত্বিক : না, ওসব আমাদের মধ্যে নেই। বিয়ের বহু আগে থেকে আমরা একে অপরকে চিনি। আমরা দুজনেই একে অপরকে বোঝার চেষ্টা করি। আর কোনো ম্যাচিওর পারসনদের মধ্যে এসব হয় বলে তো জানা নেই। বরং আমাদের দুজনের পেশা এক বলে আমরা একে অন্যের কাজ নিয়ে আলোচনা করতে পারি। সমস্যা হলে তা নিয়ে মন খুলে কথা বলি। ইগো এখানে আসবে কেন? উই আর হ্যাপি কাপল।
প্রশ্ন : আপনার স্ত্রী অপরাজিতা তো মেগা ধারাবাহিক ‘কোজাগরী’তে অভিনয় করছেন। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই ব্যস্ত। আপনাদের ছেলে ‘উপমন্যু’র বয়স তো দেড় বছর। তাকে সময় দেন কখন?
ঋত্বিক : দেখুন ও বেসিক্যালি দিদিমার কাছেই মানুষ হচ্ছে। আমরা আমাদের মতো করে সময় বের করে নেই ওর জন্য।
প্রশ্ন : অবসর বা ছুটি পেলে কী করেন?
ঋত্বিক : আমি উত্তর ২৪ পরগনা জেলার ব্যারাকপুরের ছেলে। বাবা-মা এখনো ওখানেই থাকেন। ছুটি পেলে ওঁদের সঙ্গে আমরা সবাই সময় কাটাই। পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে ভালোই লাগে।
প্রশ্ন : বলিউডে কাজ করার কথা ভেবেছেন কখনো?
ঋত্বিক : মুম্বাইতে কাজ করতে হলে ওখানে গিয়ে থেকে কাজ করতে হবে। এখন আমার হাতে যে রকম ছবি আছে, তাতে মুম্বাইয়ে থাকা সম্ভব নয়। তা ছাড়া আমি খুব ভালো হিন্দি বলতে পারি না। তবে অভিনয় নিয়ে আমার আত্মবিশ্বাস আছে। ভালো কাজের কদর আছে মুম্বাইতে। এখন তো অনেক বাঙালি পরিচালক সেখানে কাজ করছেন। দেখা যাক ভবিষ্যতে কাজ পেতে পারি কি না। তবে এখনই কোমর বেঁধে ওখানে গিয়ে পড়ে থেকে কাজ জোগাড় করতে পারব না।
প্রশ্ন: ইন্ডাস্ট্রিতে আপনার খুব কাছের বন্ধু কে কে?
ঋত্বিক : অবশ্যই শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, যিশু সেনগুপ্ত, আবীর চট্টোপাধ্যায়। আর গাইড বা ফিলোসফার বলতে অবশ্যই পরিচালক কৌশিক গাঙ্গুলীর কথা বলতেই হয়। উনি আমার মধ্যের শিল্পীসত্তাকে বের করে আনতে পেরেছেন।
সবশেষে ফের আরেকবার ধন্যবাদ জানাতেই হেসে ফেললেন ঋত্বিক চক্রবর্তী। বললেন, ধন্যবাদ আপনাদেরও, সবাই ভালো থাকুন। আর অনেক অনেক বাংলা ছবি দেখুন।