যুক্তি দিয়ে শিল্প হয় না: অনিন্দ্য ব্যানার্জী
‘চলচ্চিত্র নির্মাণ যাত্রা’ শিরোনামে দুই দিনব্যাপী কর্মশালার আয়োজন করেছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী এবং মুভিয়ানা ফিল্ম সোসাইটি। কর্মশালা পরিচালনা করছেন তিনজন। পরিচালকদের মধ্যে রয়েছেন ভারতের অভিনেতা ও পরিচালক অনিন্দ্য ব্যানার্জী। এবার ঢাকায় আসার অনুভূতি ও তাঁর পরিচালনায় নতুন চলচ্চিত্র ‘ওয়াচমেকার’ নিয়ে কথা বলেছেন তিনি।
এনটিভি অনলাইন : ১৯৯৬ সালে শেষবার ঢাকায় এসেছিলেন। এবার চলচ্চিত্র বিষয়ক কর্মশালায় একজন প্রশিক্ষক হিসেবে আসার পর কেমন লাগছে?
অনিন্দ্য ব্যানার্জী : থিয়েটারের দলের সঙ্গে ১৯৯৬ সালে ঢাকায় এসেছিলাম। মঞ্চ নাটক করার জন্য আসা হয়েছিল। এবার আমি এসেছি ভিন্ন কারণে। ‘ওয়াচমেকার’ ছবিটা এখানকার স্টুডেন্টদের দেখাতে চাই। আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে যুক্তি বিশ্বাস করি না। সারা বিশ্বের ছবি যুক্তিনির্ভর হয়। আমার কাছে মনে হয়, যুক্তিবিদ্যা দিয়ে ছবি নির্মাণ করা ইউরোপিয়ান সভ্যতার ফসল। সে কারণে লজিক, রিজনিং ও সায়েন্সের কারণে ইউরোপিয়ানরা তাঁদের মূল্য বাড়িয়েছে। আমি এশিয়ান হিসেবে এটাকে নেগলেট করছি। আমি বাঙালির কাছে তুলে দিতে চাই, লজিকের বাইরেও একটা ওয়ার্ল্ড রয়েছে। লজিক দিয়ে সামান্য জিনিস ব্যাখা করা যায়। কিন্তু লজিক দিয়ে পৃথিবীর অধিকাংশ ব্যাখা করা যায় না। সেই ভাবনাগুলো বাঙালির কাছে পৌঁছে দিতে চাই বলে আমি এখানে এবার এসেছি।
এনটিভি অনলাইন : এখানকার চলচ্চিত্র শিক্ষার্থীদের দেখে আপনার কেমন মনে হলো?
অনিন্দ্য ব্যানার্জী : প্রতিষ্ঠানের বাইরে আমার ভাবনা চিন্তা স্টুডেস্টদের সাথে শেয়ার করতে চেয়েছি বলেই এখানে এসেছি। কর্মশালায় প্রচুর ছেলেমেয়ে এসেছেন। এখনো সিনেমা নিয়ে শেখার বা জানার উৎসাহ শুধুমাত্র সীমিত সংখ্যকের নয়। একটু ভিন্ন কিছু নির্মাণের জন্য এখনো অনেক ছেলেমেয়ে অপেক্ষা করে আছে। সবার আগ্রহ দেখে আমি অভিভূত।
এনটিভি অনলাইন : শিক্ষার্থীদের প্রতি আপনার পরামর্শ কী থাকবে?
অনিন্দ্য ব্যানার্জী : তাঁদের জন্য একটাই উপদেশ, লজিকের বাইরে গিয়ে ভাবো। কারণ লজিকটা আমাদের অভ্যাসের মতো। ছোটবেলা থেকে আমাদের লজিক্যাল হতে শেখানো হয়। তাই আমরা লজিক্যাল হই। সেই ছাপ আমাদের শিল্পে পড়ে। শিল্প কিন্তু লজিকের মধ্যে পড়ে না। বাস্তবে দুই আর দুই মিলে চার হয়। শিল্পে সেটা হয় না। শিল্পে দুই আর দুই মিলে ৯৮ হয়। এটা একটা বোধের ব্যাপার। হুবহু বাস্তবে যা ঘটছে সেটা নিয়ে সিনেমা বানানো আমার পছন্দ নয়। নাচগানের বাইরেও আরও জগত আছে। তথাকথিত বিনোদনমূলক ছবির বাইরে জগতটাকে নতুন ভাবে দেখা। আমি যেটা ৩০ বছর ধরে শিখেছি সেটা আমি আমার ছোট ভাইবোনদের শেখাতে চাইছি এখন।
এনটিভি অনলাইন : আপনার পরিচালনায় ‘ওয়াচমেকার’ ছবিটি সম্পর্কে জানতে চাই।
অনিন্দ্য ব্যানার্জী : যেটাকে সারা পৃথিবী এখন সভ্যতা বলছে, সেটাকে আমি সভ্যতা বলি না।আসলে সভ্যতা পেছনের দিকে যাচ্ছে। একটা উত্তপ্ত জায়গায় সারা পৃথিবী দাঁড়িয়ে আছে। এত অনাহার, এত অনাচার চারদিকে। এসব কিছু সভ্যতার নিদর্শন নয়। অনেক বড় বড় হাসপাতাল হয়েছে। কিন্তু গরিবরা সেগুলোর কাছে পৌঁছাতে পারে না।
আমার এই ছবি সভ্যতার বিপক্ষে কথা বলেছে। আমি সভ্যতা বিশ্বাস করি না। ছবিতে তিনটি চরিত্র আছে। একজন ওয়াচম্যাকার যে ঘড়ি বানায়, তার কাটা উল্টো দিকে ঘোরে। এটা রূপক অর্থে বুঝিয়েছি। আমি বলতে চাই, সভ্যতা বলতে আমরা বুঝি মানুষ এগুচ্ছে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে , মানুষ পেছনের দিকেই যাচ্ছে।
এনটিভি অনলাইন : ‘ওয়াচমেকার’ ছবিটি বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শনী হয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে ছবিটি মুক্তি পাবে কবে?
অনিন্দ্য ব্যানার্জী : ছবিটা অফিসিয়ালি রিলিজ করব না। আমার উদ্দেশ্য হলো, আমার দেশ, বাংলাদেশ এবং সারা পৃথিবীর বাঙালীদের মধ্যে আমার বোধটাকে ছড়িয়ে দেয়া। ছবি মুক্তি দিয়ে পয়সা আয় করতে চাই না। এছাড়া ছবিটি দেখার জন্য আমাদের দেশের দর্শক প্রস্তুত নয় বলে আমি মনে করি। আমি টাকা নেইনি ছবিটি বানাতে। প্রযোজকের টাকা আমি ডিজিটাল প্লাটফর্ম থেকে তুলে দিব। এটাই আমার পরিকল্পনা।
এনটিভি অনলাইন : টলিউড ও বলিউডের ছবিতে নিয়মিত অভিনয় করেছেন। সিরিয়ালে অভিনয় করছেন। হঠাৎ পরিচালনায় কেন?
অনিন্দ্য ব্যানার্জী : আমি যেরকম চরিত্রে অভিনয় করতে চাই সেরকম চরিত্র আমি বাংলাতেও পাই না এমনকি হিন্দিতেও পাই না। আমি একটা মেধা ক্রাইসিসে ভুগছিলাম। আমি আমার কথা বলার জন্য ছবি বানিয়েছি।
এনটিভি অনলাইন : আপনি তো ‘কাহানি’ ছবিতে অভিনয় করেছেন। ছবির গল্প তো অনেক প্রশংসা পেয়েছে...
অনিন্দ্য ব্যানার্জী : এই ছবির গল্প সুন্দর। কিন্তু বলিউড পর্যন্ত সবসময় রিচ করা সম্ভব হয় না। আমি সামান্য একজন অভিনেতা। ভারতবর্ষে আমাকে সবাই চিনে। এমনকি বাংলাদেশেও আমার পরিচিতি অনেক।
এনটিভি অনলাইন : এবার বাংলাদেশি ভক্তদের সঙ্গে কোন স্মৃতি...
অনিন্দ্য ব্যানার্জী : ট্রেনে করে ঢাকা আসার পথে সবাই বলেছিল, ‘আপনি আমার বাড়িতে থাকবেন। চলেন যাই’। ট্রেনে আমার মোবাইল ফোনে একজন রিচার্জ করে দিয়েছিলেন। সবাই সাহায্য করেছেন। সবার ভালোবাসা পেয়ে আমি মুগ্ধ।
এনটিভি অনলাইন : মুক্তির অপেক্ষায় আছে আপনার ‘আমি রাজনীতি চাই না’ ও ‘কুয়াশা যখন’ দুটি চলচ্চিত্র। ছবি দুটির আপনার চরিত্র সম্পর্কে বলুন।
অনিন্দ্য ব্যানার্জী : দুটো ছবিতে নেতিবাচক চরিত্রে আমি অভিনয় করেছি।
এনটিভি অনলাইন : আপনি সবসময় নেতিবাচক চরিত্রে কেন অভিনয় করেন?
অনিন্দ্য ব্যানার্জী : আমি দেখতে খারাপ বলে ভিলেন চরিত্রে অভিনয় করি (হাসি)। আসলে আমি এক ধরণের চরিত্রের প্রতি বিশেষজ্ঞ হতে চাই। এজন্য নেতিবাচক চরিত্র বারবার করছি। আমাকে লেখার পেছনে সময় দিতে হয়। সবধরণের চরিত্র নিয়ে আমি ভাবতে চাই না। সময় নেই।
এনটিভি অনলাইন : আপনি তো একসময় গানও গাইতেন। গান আপনার ক্যারিয়ারে প্রধান সাবজেক্ট হলো না কেন?
অনিন্দ্য ব্যানার্জী : একসময় তারা টিভিতে গান গাইতাম। বাবা রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন। তাই ছোটবেলায় রবীন্দ্রসংগীত শিখেছিলাম। আমি মনে করি, গান নিজস্ব আর্ট। এটা আমার প্রধান জায়গা ছিল না।
এনটিভি অনলাইন : শেষ প্রশ্ন, ২৫ বছর পর কী ধরণের চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে চান?
অনিন্দ্য ব্যানার্জী : আমি ৩০ বছর ধরে থিয়াটার করছি। মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের জায়গা আমি বুঝতে চাই। ২৫ বছর পর, আমি এমন একটা সিনেমা বানাবো যেটা আমি নিজেও বুঝব না। এমনকি ছবির জন্য এমন একটা চিত্রনাট্য লিখব সেটা আমি নিজেও বুঝব না। প্রথমত এটা বানাতে কেউ রাজি হবে না। আমি একগুয়ে স্বভাবের। যা চারপাশে ঘটে সেটা দেখানোতে আমি বিশ্বাস করি না। বাস্তবের ঘটনা সরাসরি কপি করতে আমি চাই না। আমি বিশ্বাস করি, যুক্তি দিয়ে শিল্প হয় না। যুক্তি দিয়ে সিনেমা হয় না।