আপনার কি খুব ভূতের ভয়? তাড়ানোর উপায় জেনে নিন
ঘটনা ১
সোমার মাঝ রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। আর ঘুম আসছে না। হঠাৎ খোলা জানালার দিকে চোখ গেলো। ওপাশে যেন একটা সাদা ছায়া নড়ে উঠতে দেখল সে। সঙ্গে সঙ্গেই মনে হলো, ওটা ভূত নাতো? আজ সে একা ঘুমাচ্ছে। তাই ভয়ে গলা শুকিয়ে এলো তার। মনে হলো ,এই বুঝি ভূতটা জানালা দিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে যাবে।
তার মনে হচ্ছে, বাইরে কেমন যেন একটা খসখস শব্দ হচ্ছে। কেউ যেন হেঁটে হেঁটে তার কাছেই আসছে। সে চোখ বন্ধ করে সমানে দোয়া পড়া শুরু করল। এভাবেই সারাটা রাত প্রচণ্ড ভয়ে না ঘুমিয়ে কাটল সোমার।
ঘটনা ২
রুবিনা কোনোভাবেই রাতে একা ঘরে থাকতে পারে না। সে সারা রাত ঘরের আলো জ্বালিয়ে রাখে। ঘুমের মধ্যে কাউকে না কাউকে নিয়ে ঘুমায়। রাতে টয়লেটে যেতে হলে ঘরে যে রয়েছে তাকে জাগিয়ে তুলে টয়লেটের সামনে দাঁড় করিয়ে সে বাথরুমে যায় এবং তার সঙ্গে কথা বলতে থাকে। ঘুমের সময় কোনো শব্দ হলেই সে চিৎকার করে ওঠে। তার মনে হয়, কোনো অশরীরী কিছু বা ভূত এমন শব্দ করছে এবং এটি তার আশপাশেই রয়েছে।
গল্প দুটোর মতোই আমাদের চারপাশে অনেকেই রয়েছেন যারা এমন ভয় পান। ভূতের গল্প বা ভূতের ভয় মানব সমাজে হাজার বছর ধরে প্রচলিত। সাধারণত ধারণা করা হয়, ভূত হলো এমন অতৃপ্ত আত্মা যারা মৃত্যুর পরও পরলোকে না গিয়ে আমাদের চারপাশের রয়েছে, বা আমাদের প্রিয় যারা মারা গেছে তাদের আত্মা যারা আমাদের মায়া ত্যাগ করতে পারেনি।
যদিও ভূতের অস্তিত্ব বিষয়ে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কিন্তু যারা ভূতের ভয় পান তাদের জন্য ভূতের ভয়টা অমূলক নয়। বাস্তবে আমরা দেখতে পাই খুব কম মানুষই ভূত রয়েছে এটি বিশ্বাস করে। কিন্তু আবার ভূতে ভয় পান এমন মানুষের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। ভূতের ভয় পেলেও অনেকে খুব আগ্রহ নিয়ে ভূতের গল্প পড়ে, সিনেমা দেখে। কারণ, এটা তাদের জন্য এক ধরনের রোমাঞ্চকর অনুভূতি সৃষ্টি করে এবং ভূতের ভয় পেলেও ভয়টা তাদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকে। তবে ভয়টা যখন ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, স্বাভাবিক ভয়ের মাত্রাকে অতিক্রম করে, স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যহত করে তখন তা থেকে বেড়িয়ে আসা জরুরি হয়ে পড়ে। অহেতুক ভূতের ভয় থেকে মুক্তি লাভ করার সঠিক কৌশল জানা থাকলে ভূতের ভয় থেকে বেড়িয়ে আসা সম্ভব।
ভূতের ভয় থেকে মুক্তি পাওয়ার কিছু প্রয়োজনীয় পরামর্শ :
- যখন ভয়ের অনুভূতি প্রথম টের পাচ্ছেন, মনে হচ্ছে বুক ধড়ফড় বেড়ে গেছে, অস্থির লাগছে, বমি বমি ভাব হচ্ছে, মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে, দেরি না করে দ্রুত ব্রিদিং রিলাক্সেশন করুন। নাক দিয়ে ধীরে ধীরে গভীর শ্বাস নিন, বুকের ভেতর সমস্ত খালি জায়গা বাতাসে ভরে ফেলুন, দমটা অল্পক্ষণ আটকে রাখুন, তারপর মুখ দিয়ে ধীরে ধীরে শ্বাস ছাড়ুন। এভাবে পর পর তিনবার করুন।
- ভূতের ভয় থেকে বেড়িয়ে আসতে ভূত এবং ভয় নিয়ে চিন্তা করা বন্ধ করুন। নিজেকে প্রশ্ন করুন, সত্যি ভূত বলে কিছু রয়েছে কি না? না কি আপনি অজানা কোনো কারণে ভয় পাচ্ছেন? আপনি বা আপনার পরিচিত কেউ কখনো ভূত দেখেছে কি না? ক্ষতি হলে তার কী ধরনের ক্ষতি হয়েছে? উত্তরগুলো খুঁজে নিয়ে ভাবুন আদৌ ভয় পাওয়ার কোনো কারণ রয়েছে কি না।
- সিনেমায় ভূত, আত্মা এই বিষয়গুলোকে অতিরঞ্জিত করে উপস্থাপন করা হয়। ভয়ের সিনেমা, নাটক আমাদের মধ্যে ভূত ও আত্মা সম্পর্কে ভয় তৈরির সাহায্য করে। তাই যদি এ ধরনের সিনেমা, নাটক দেখে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারেন তবে এই ধরনের নাটক, সিনেমা, গল্পের বই এড়িয়ে চলুন।
- ভয়কে জয় করতে ভয়ের বিষয়টি সরাসরি মোকাবিলা করতে হয়। আপনি হয়তো ভূতের ভয়ে রাতে একা থাকতে ভয় পান, ঘরে আলো জ্বালিয়ে রাখেন- এ পরিস্থিতি থেকে বের হতে রাতে একা থাকা শুরু করুন। ভাবুন, পৃথিবীতে কত মানুষ একা থাকে। ভূত তাদের আক্রমণ না করলে আপনাকে করবে কেন? আপনার সঙ্গে তো ভূতের বিশেষ কোনো শত্রুতা নেই। প্রথমে আলো জ্বালিয়ে একা ঘরে থাকার অভ্যাস করুন। প্রথমে কষ্ট হবে তারপরও চেষ্টা করুন। প্রথমদিন পারলে নিজেকে নিজে ধন্যবাদ দিন, ছোট পুরস্কার দিন। এভাবে একা থাকায় অভ্যস্ত হলে একা ঘরে আলো নিভিয়ে থাকার পদক্ষেপ নিন। এভাবে ধীরে ধীরে ভয় কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করুন।
- ভয় থেকে মনটাকে অন্য দিকে সরিয়ে দিতে গান শোনা, টিভি দেখা, গল্পের বই পড়ার মতো নিজের ভালোলাগার কাজগুলো করুন।
- জানালার দিকে তাকালে ভয় হলে জানালা খুলে রাখুন। জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে বাইরে দেখুন। জানালার দিকে চোখ পড়লে চোখ বন্ধ না করে তাকান। কিন্তু বার বার তাকিয়ে কিছু রয়েছে কি না সেটি চেক করা থেকে বিরত থাকুন।
- নিজেকে বলুন যতবার শব্দ শুনে বা আওয়াজে ভয় পেয়েছি, বা বাইরে যা দেখেছি তাকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করেছি।
- ভূত নিয়ে নানা আশঙ্কার কথা মনে হলে ভাবুন যা ভাবছেন তা যদি সত্যি হয় তবে কি হবে? সবচেয়ে খারাপ কী হতে পারে? এমন হবার আশঙ্কা কতটুকু?
- যখন ভয় পাচ্ছেন তখন যা ভেবে ভয় পাচ্ছেন তা কাগজে লিখে ফেলুন, লেখা শেষে কাগজ কুটিকুটি করে ছিঁড়ে ফেলুন বা পুড়িয়ে ফেলুন।
- ভাবুন ভূত বা আত্মা আপনার মতোই। তাদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কোনো প্রমাণ নেই যে ভূত কারো কখনো ক্ষতি করেছে।
- অনেক সময় ছোটবেলা থেকে ভূত সম্পর্কে শোনা গল্প আমাদের মনে ভূত সম্পর্কে একটি ভয়ঙ্কর ছবি তৈরি করে। এতে আমাদের মাঝে ভয় তৈরি হয়। অনেক সময় বড় হওয়ার পরও তা থেকে যায়। তাই বাচ্চাদের সঙ্গে এ ধরনের গল্প না করার চেষ্টা করুন।
- ভয় থেকে বেড়িয়ে আসার জন্য নিজেকে যথেষ্ট সময় দিন।
- নিজের আগের সফলতার কথা চিন্তা করুন। মনে করুন আগে কঠিন সমস্যার মুখোমুখি হওয়ার পর কী কী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, কীভাবে বের হয়ে এসেছিলেন। এটা আপনার মনোবল বাড়াতে সাহায্য করবে।
- নিজেকে বলুন, ‘ভয়ের কাছে পরাজিত হবো না। ভয় আসতেই পারে। এটা স্বাভাবিক। আমি জানি ভয়টা অমূলক। তাই ভয় পাবার কিছু নেই। বরং ভয় দূর করতে যা যা করা দরকার করব।’
- ভূত নিয়ে যেসব কমেডি সিনেমা রয়েছে সেগুলো দেখুন। ভয়ের সময় মনে করার চেষ্টা করুন ভয়ের সিনেমাগুলোতে ভূত কী কী করার চেষ্টা করে এবং প্রাণ খুলে হাসুন।
- কোনো বিষয় নিয়ে মজা করলে সে বিষয়ে ভয় দূর করা সম্ভব। ভূত বিষয়ে অন্যের সঙ্গে বেশি বেশি গল্প বলুন, মজা করুন।
- অনেক সময় ভূতের ভয়ের সঙ্গে মানসিক অসুস্থতাও যুক্ত থাকতে পারে। সেখানে ছোটখাট পরামর্শ মেনে চললেই তা দূর করা সম্ভব হবে না। তাই নিজে নিজে ভূতের ভয় দূর করতে না পারলে মনো-চিকিৎসক, চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানীর সাহায্য নিন।
- ভূতের ভয়টা যেহেতু রাতেই হয়, তাই ঘুমাতে যাওয়ার আগে শিথিল থাকতে পারেন এমন কিছু করুন। ঘুমের সময় অল্প আলো জ্বালিয়ে ঘুমান।
- সিলিং বা জানালায় ঝুলন্ত কিছু থাকলে তা সরিয়ে ফেলুন, যাতে রাতের বেলা এগুলো থেকে ভয় না তৈরি হয়।
- ‘ভূত আসলে কী হবে?’- এ ধরনের ভাবনা ব্যক্তির মধ্যে মানসিক অস্থিরতা তৈরি করে। তাই ভবিষ্যতে যা ঘটার আশঙ্কা সম্পর্কে আপনি নিশ্চিত নন তা ভাবা থেকে বিরত থাকুন।
ভূতের ভয়কে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা আমাদের মধ্যেই লুকায়িত রয়েছে। তাই ভূতের ভয়কে জয় করুন।
লেখক : ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, ন্যাশনাল ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টার