বিশ্ব যোগব্যায়াম দিবস
আত্মশক্তি বাড়ায় যোগব্যায়াম
আজ ২১ জুন, বিশ্ব যোগব্যায়াম দিবস। যোগ বা ইয়োগা শব্দের অর্থ দেহ ও মনের প্রগাঢ় সংযোগ বা ঐকান্তিক মিলন। ইয়োগা এসেছে সংস্কৃত শব্দ যোগ থেকে। এটার উৎপত্তি কত বছর আগে তা ঠিকভাবে বলা মুশকিল। খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দের কাছাকাছি সময়ে এই ব্যায়ামের প্রচলন হয়। আজও এর অনেক কদর।
যোগব্যায়ামে মানুষের অশান্ত মন শান্ত হয় ও তার আত্মশক্তি বৃদ্ধি লাভ করে গঠনপথে অগ্রসর হয়। যোগাসনে শরীরে দৃঢ়তা আসে, শরীর নিরোগ ও লঘুভার হয়। একটা স্থির ও সুখকর ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ অবস্থান করলে মানসিক ভারসাম্য সৃষ্টি হয়। মন ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হতে পারে না। আসনে শরীরে ও মনে সমন্বয় ঘটে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বহু দেশে যোগাসন এখন রোগ আরোগ্যের প্রকৃষ্ট উপায় হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। বিকল্প ওষুধ বলে একটা কথা আজকাল প্রায়ই শোনা যায়। যোগাসন আর প্রাণায়াম সেই বিকল্প ওষুধ হিসেবে কাজ করে।
স্বাস্থ্য সম্বন্ধে মানুষ এখন আগের চেয়ে অনেক সচেতন হয়েছে। সুস্বাস্থ্য বলতে কেবল রোগব্যাধি আর শারীরিক দুর্বলতা থেকে মুক্তি বোঝায় না। পূর্ণ শারীরিক মানসিক ও সামাজিক হিতও বোঝায়। আর সেই সুস্বাস্থ্য লাভ করা যায় ব্যায়ামের মাধ্যমে।
ইয়োগায় সমস্ত শরীরের ব্যায়াম হয়। ফলে শারীরিকভাবে যেমন উপকার হয়, তেমনি এটি মানসিক স্থিরতা ও মনোযোগ বাড়াতে সাহায্য করে। এটি ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। মানসিক উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও চঞ্চলতা প্রশমন করতে এর ভূমিকা অপরিসীম।
এই ব্যায়াম শরীরের অক্সিজেনের পরিমাণের বৃদ্ধি হয়। ফলে শরীর-মন বেশ তাজা থাকে, মন স্থির হয়। যাঁরা মনমরা হয়ে থাকেন, শরীরে ও মনে শক্তি পান না, তাঁরা যদি নিয়মিত যোগব্যায়াম করেন তাহলে প্রাণ প্রাচুর্যে ভরে উঠবেন। দেহে ও মনে সুখ পাবেন। আত্মবিশ্বাসে উজ্জীবিত হবেন। শরীরে নতুন প্রাণের সঞ্চার হবে। মনে শান্তি আসবে, জীবনের আনন্দ তারা ফিরে পাবেন।
পাশাপাশি যোগব্যায়াম শারীরিক শক্তি বাড়াতে ও শরীরকে একটি সঠিক গঠনে আনতে সাহায্য করে। শরীরের অভ্যন্তরে তাপ উৎপন্ন করে। আর এই উপায়ে শরীরের ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করে। এটি শরীর ও মনের সবচেয়ে গভীরতম স্তরে সংযোগ সাধন করতে সাহায্য করে। যোগাসনে বিভিন্ন শারীরিক জড়তা দূর হয়। হজমশক্তি বৃদ্ধি করে। অনিদ্রা দূর করে। যোগাসন যেমন রোগ আরোগ্যের জন্য, তেমনি রোগ প্রতিরোধের জন্য। যোগাসনে রোগ প্রতিরোধ করে সুস্থ মানুষ সারা জীবন সুস্থ থাকতে পারেন।
একজন মানুষ সারা জীবন সুস্থ থাকতে চাইলে তার বেশি আসন করার দরকার হয় না। শারীরিক ক্ষমতা ও ব্যক্তিগত অভিরুচি অনুযায়ী সাত-আটটি ব্যায়াম করলেই চলে। আসনে একটি-দুটি মুদ্রা আর একটি প্রাণায়াম করলেই যথেষ্ট হয়। আসন নির্বাচনের সময় শুধু লক্ষ রাখতে হবে যেন সর্বাঙ্গের ব্যায়াম হয়। শরীরের একদিকের ব্যায়াম হলো আর একদিকের হলো না, এমন যেন না হয়।
নির্বাচনে উপযুক্ত শিক্ষকের পরামর্শ নিতে পারলে ভালো হয়। আমাদের শরীরের ভেতর এমন সব যন্ত্র ও অন্ত্র আছে, যার কর্মক্ষমতা কমে গেলে শরীরে বড় রকমের গোলযোগ দেখা দিতে পারে। সেই যন্ত্রগুলোর মধ্যে প্রধান হৃৎপিণ্ড ও ফুসফুস, যকৃৎ, কিডনি, পাকস্থলী ইত্যাদি। কেবল যোগাসনের সাহায্যেই এসব যন্ত্র আর অন্ত্রকে সুস্থ ও সক্রিয় রাখা যেতে পারে। রোগপ্রতিরোধে ও রোগ নিরাময়ে যোগাসনের ভূমিকা আজ বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় প্রমাণিত। তবে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, যাঁরা নিয়মিত যোগাসন করেন, তাঁদের শরীরে রোগজীবাণু প্রবেশ করলেও সহজে তাঁদের কাবু করতে পারে না। যোগাসনে শরীর সবল ও সতেজ হয় বলে অনেক রোগজীবাণুর আক্রমণ প্রতিরোধ করতে পারে। স্বাস্থ্যবিধি না জানা বা না মানার জন্য যেসব রোগ হয়, তার মধ্যে অনেক রোগই যোগাসনে নিরাময় করা যায়। ইয়োগার বৈশিষ্ট্য এই যে, তা যেমন রোগ আরোগ্য করতে পারে, তেমনি ভবিষ্যতে রোগের আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য দেহে শক্তি সঞ্চয়ও করতে পারে। শরীরে পেশীয় পুষ্টিসাধনের জন্য নানা রকম আসন করা যেতে পারে।
যোগাসনে দেহের ভেতরকার স্নায়ু, গ্রন্থি আর অন্যান্য যন্ত্রকে যে রকম পুষ্ট ও সবল করতে পারে, সে রকম অন্য কোনো ব্যায়াম পারে না। যোগব্যায়ামের মাধ্যমেই মস্তিষ্কের ভেতরে প্রচুর রক্ত প্রবাহিত করে একে সবল ও কর্মক্ষম করতে পারে। এই যোগাসনের ফলে মস্তিষ্কে প্রচুর রক্ত প্রবাহিত হয় এবং তার ফলে মস্তিষ্ক অতি দ্রুত অনেক বেশি সতেজ হয়ে ওঠে।
সবার কথা মাথায় রেখে কিছু আসনের বর্ণনা দেওয়া হলো, যা আপনি সহজে ঘরে বসে করতে পারেন।
জানুশিরাসন
দুই পা সোজা করে সামনে ছড়িয়ে বসুন। তারপর বাম পায়ের হাঁটু ভেঙে হাঁটু বাম দিকে নিয়ে যান। বাম থাই বাইরের দিকে আর বা পায়ের গোড়ালি মাটিতে লেগে থাকবে। এবার বা পায়ের গোড়ালি ডান কুচকিতে ঠেকান। বাম পায়ের পাতা ডান থাইয়ে লেগে থাকবে। এবার দুই হাত সামনের দিকে ছড়িয়ে দিন। তারপর দুই হাত দিয়ে ডান পায়ের বুড়ো আঙলটা ধরুন। ডান হাঁটু শক্ত করে ডান পা সর্বক্ষণ সোজা রাখুন।
এবার নিশ্বাস ফেলতে ফেলতে কনুই দুটো ভেঙে দুই পাশে যতখানি দরকার ছড়িয়ে দিয়ে মাথা সামনের দিকে নিয়ে যান। মাথা নিচু করে কপালটা ডান হাঁটুতে ঠেকান। শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক রেখে এভাবে হাঁটুতে কপাল ঠেকিয়ে ৩০ সেকেন্ড বসে থাকুন। তারপর নিশ্বাস নিয়ে মাথা ওপরে তুলে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসুন।
এবার বাম পা সোজা রেখে ডান পা হাঁটুর কাছে ভেঙে পুরো ব্যাপারটা আবার করুন। এই হলো একবার, এভাবে দু-তিনবার করবেন। এই আসনের ফলে সায়াটিক নার্ভের নমনীয়তা বাড়ে। হজমশক্তি বাড়ে। কিডনি মজবুত হয়। বহুমূত্র রোগ থেকে রেহাই পাওয়া যায়। উদ্যমহীনতা, স্নায়বিক দুর্বলতা, আলস্য, পেটে বায়ু ইত্যাদিতে উপকার পাবেন। মনঃসংযোগ ও ধৈর্য বাড়ে। যাঁদের হাই ব্লাডপ্রেসার আছে, তাঁরা মাথা নিচু করবেন না।
বজ্রাসন
হাঁটু গেড়ে বসুন, হাঁটু জোড়া থাকবে। হিপ থাকবে দুই গোড়ালির ওপর। পায়ের তলা ওপরের দিকে ঘোরানো। মেরুদণ্ড, ঘাড়, মাথা সব সোজা থাকবে। ডান হাত থাকবে ডান হাঁটুর ওপর পাতা। হাতের কনুই ভাঙবে না। শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক রেখে এভাবে ৩০ সেকেন্ড বসে থাকুন। এভাবে দু-তিনবার করুন। হাঁটুতে বা গোড়ালিতে ব্যথার কারণে এভাবে বসতে কষ্ট হলে পায়ের নিচে বা হিপের নিচে একটা চাদর বা মোটা তোয়ালে ভাঁজ করে দিয়ে নিতে পারেন। পাতলা বালিশ যদি থাকে তাও দিতে পারেন। এই আসনে হাঁটুর ও গোড়ালির বাতজনিত ব্যথা দূর হয়। ক্ষুধামান্দ্য ও অনিন্দ্রা দূর হয়। হজমশক্তি ভালো হয়। ঘুম ভালো হয়।
ভ্যারিকোস ভেইন বা পেশির মোটা হওয়ার অসুখে এই আসন খুবই উপকারী। আবার যেসব শিশুর ফ্লাট ফুট অর্থাৎ চেটাল পা তারা যদি বছর চারেক বয়স থেকে নিয়মিত এই আসন করে, তাহলে তাদের পায়ের সমস্যা দূর হতে পারে।
লেখক : ফারজানা খানম শিমুল, চিফ ইনস্ট্রাকটর, পারসোনা হেলথ