ঋতু বদলে শিশুর রোগবালাই
শীত শেষে বসন্ত চলে এসেছে। তবে ঠাণ্ডা বাতাসের প্রভাব কিন্তু এখনো কমেনি। সন্ধ্যার পর হালকা ঠাণ্ডা হাওয়া দেখা যায় নগরীর বুকে। তবে এখনো গ্রাম-গঞ্জে শীতের কুহেলী সন্ধ্যা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এ সময়ের ধুলিময় আবহাওয়ার প্রকোপের সহজ শিকার শিশু আর বৃদ্ধ মানুষ।এলার্জি বা ঠাণ্ডায় ভোগার প্রকোপ যাদের বেশি তারা সহজেই ধুলিময় পরিবেশে এলার্জির কারণে কাশি এবং পারিবারিক ইতিহাস থাকলে হাঁপানির শিকার হয়ে থাকে।
শিশুদের ঠাণ্ডা কাশির প্রথম লক্ষণ নাক দিয়ে পানি পড়া, তারপর সর্দি জ্বর। পরিবারের কেউ একজন ভাইরাসে আক্রান্ত হলে অন্য সদস্যরাও আক্রান্ত হতে পারে। শিশুদের সর্দি-জ্বরের কারণে নাক বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। অনেক সময় ব্রঙ্কলাইটিসের ফলে শিশুর শ্বাসকষ্ট হতে পারে। খুব বেশি শ্বাসকষ্ট হলে বুকের ভেতর দেবেও যেতে পারে।
শিশুর শ্বাসকষ্ট দেখা দিলেই পরিবারের লোকজন অনেক সময় এ অবস্থাকে নিউমোনিয়া মনে করে। ব্রংকলাইটিস রোগীটি নিউমোনিয়ার মতো হলেও এটি নিউমোনিয়ার মতো এত জটিল নয়। ব্রংকলাইটিসের রোগীদের নিউমোনিয়ার মতো উচ্চতাপমাত্রা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় না। রোগীর যথাযথ যত্ন যেমন নাক বন্ধ হলে নাকের ড্রপ (সোডিয়াম ক্লোরাইড দ্রবণ), কফ-কাশির জন্য ছয় মাসের অধিক বয়সী শিশুদের সালবিউটামল সিরাপ, জ্বরের জন্য পেরাসিটামল সিরাপ দিনে চার থেকে পাঁচ বার অথবা শরীর মুছে দিলে শিশুর জ্বর ও কাশের উপশম হয়। ব্রংকলাইটিসে ভোগা শিশুকে বার বার বুকের দুধ খাওয়ালে, পানি বা তরল খাবার বার বার খাওয়ালে চার-পাঁচদিনের মধ্যে আপনা-আপনি ভালো হয়ে যায়। কোনো এন্টিবায়োটিকের প্রয়োজন পড়ে না।
এ সময়ের ধুলিময় পরিবেশে এলার্জিও বেড়ে যায়। সামান্য এলার্জি থেকে ঠাণ্ডা-কাশি, অনেক সময় শ্বাসতন্ত্রের উপরিভাগ তথা নাক-কান-গলা আক্রান্ত হতে পারে। ভাইরাস জ্বরের সাথে ব্যকটেরিয়ার সংক্রমণে টনসিলাইটিস, বড়দের ফ্যারেনজাইটিস এমনকি কান পাকা রোগ দেখা দিতে পারে। এ জন্য সামান্য ঠাণ্ডা কাশি মনে করে রোগবালাইকে ছোট করে দেখার কিছু নেই। এলার্জি জনিত ঠাণ্ডাভাব দেখা দিলে সোডিয়াম ফ্লোরাইড যুক্ত নাকের ড্রপ বা নেসাল স্প্রে দিতে হবে। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শে অক্সিমেটাজলিন নাকের ড্রপ, এলার্জির জন্য এন্টি হিসটামিন সিট্রিজিন সিরাপ বা টেবলেট দিতে হবে। এলার্জিজনিত ঠাণ্ডায় অনেক সময় স্টেরয়েড মোমিটাসন (শিশুদের জন্য অধিক প্রযোজ্য) ফ্লুটিকাসন নেসাল স্প্রে ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে থাকেন চিকিৎসকরা। মনে রাখতে হবে নেসাল স্প্রে কোমোগ্লাইকেট বা স্টেরয়েড কোনো জটিল ধরনের চিকিৎসা নয়।বরং এলার্জি জনিত ঠাণ্ডা দ্রুত উপশমের কার্যকর পদ্ধতি মাত্র। আর যদি একান্তই অসচেতনতার কারণে ঠাণ্ডা-কাশি থেকে ফারেনজাইটিস বা কণ্ঠনালীর প্রদাহ হয়, কানপাকা রোগ, টনসিলাইটিস অথবা নিউমোনিয়ার মতো জটিল রোগ হয় তখন অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে এন্টিবায়োটিক সেবনসহ তদনুযায়ী চিকিৎসা নিতে হবে।
ঠাণ্ডা কাশি ছাড়াও শীতে ডায়রিয়ার প্রকোপ তীব্রতর আকার ধারণ করতে পারে। আর এ ধরনের ডায়রিয়ার প্রধান কারণ হলো ভাইরাস। আর প্রাথমিক স্তরে বায়ুবাহিত বা ভাইরাসজনিত হলেও তা পরবর্তী সময়ে সংক্রমিত হতে পারে জনে জনে। শীতজনিত ডায়রিয়া দেখা দিলে শিশুদের ক্ষেত্রে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা জরুরি। রোগীর পোশাক, খাওয়ার থালা-বাটি সব কিছু ধুয়ে ফেলতে হবে। ডায়রিয়া ভাইরাসজনিত হলে সে ক্ষেত্রে এন্টিবায়োটিক ওষুধের কোনো কার্যকারিতা নেই। রোগীকে খাবার স্যালাইন, প্রয়োজন হলে তরল খাবার শিরায় দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। ভাইরাসজনিত ডায়রিয়ার পাশাপাশি সর্দি-জ্বর থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে নাকের ড্রপ, এন্টি হিসটামনি জাতীয় ওষুধ সেবন করতে হবে।
এ সময় হাঁপানিও রোগীদের দারুণ ভোগায়। বসন্তের প্রারম্ভে বাতাসে ভেসে থাকা পরাগরেণু, ধুলাবালি এ ধরনের শ্বাসকষ্টের জন্য দায়ী। অ্যাজমা ও হাঁপানি রোগীদের এ সময় শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে মুখে কাপড় বা মাস্ক পরে চলা উচিত এবং রোগের জন্য ক্ষতিকর পরিবেশ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে হবে। শ্বাসকষ্ট হলে প্রয়োজনে সালবিউটামল জাতীয় ওষুধ, নেবুলাইজার এবং ইনহেলার দিনে পাঁচ থেকে ছয়বার ব্যবহার করতে হবে। শ্বাসকষ্ট রোগের উপশম না হলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শে স্টেরয়েড ইনহেলার দিনে পাঁচ থেকে ছয় বার ব্যবহার করতে হবে।
এ সময় আরেক উপদ্রব চর্মরোগ। একটু অসতর্ক হলে চর্মরোগ স্কেবিস, একজিমা অথবা ইকথায়োসিস হতে পারে। স্কেবিজ অত্যন্ত ছোঁয়াচে রোগ। এতে পরিধেয় কাপড় চোপড় ধুয়ে ফেলতে হবে। পরিবারের অন্যরা আক্রান্ত হলে তাদের পারমিথ্রিন জাতীয় ক্রিম মুখমণ্ডল ব্যতীত সারা শরীরে মাখতে হবে।ইকথায়োসিস বা ত্বক কেটে গেলে লিকিউড প্যারাথিন অথবা পেট্রলিয়াম জেলি মাখতে হবে। এ সময় শিশুর প্রতি একটু যত্নশীল হলেই তাকে সুস্থ সুন্দর রাখা সম্ভব।
লেখক : জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের শিশু বিভাগের সহকারী অধ্যাপক।