প্রতিবন্ধী শিশুদের মা-বাবার মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় করণীয়
প্রতিবন্ধী শিশুদের মা-বাবার মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি এখনো অবহেলিত। অনেক সময় প্রতিবন্ধী শিশুর মা-বাবারা উদ্বেগ, বিষণ্ণতার মতো মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগেন।
প্রতিবন্ধী শিশুদের মা-বাবার মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার বিষয়ে এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২৯৩১তম পর্বে কথা বলেছেন মোহাম্মদ সেলিম চৌধুরী। বর্তমানে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল ও কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগে পিএইচডি গবেষণা করছেন।
প্রশ্ন : প্রতিবন্ধী শিশুদের মা-বাবার মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে কোন জিনিসটি দেখা উচিত?
উত্তর : আমাদের দেশে প্রায় ১০ ভাগ শিশু প্রতিবন্ধী। গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ হয়েছে যে তাদের যদি মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক থাকে, তারা শিশুদের ভালো সেবা দিতে পারে। আমাদের দেশে যেসব শিশুরা প্রতিবন্ধী রয়েছে, তাদের বাবা-মায়ের মানসিক বিষয়টি এখনো অবহেলিত বলে আমি মনে করি।
যখনই একটি শিশু জন্মগ্রহণ করে, মা-বাবার একটি প্রত্যাশা থাকে যে সুস্থ-সবল শিশু জন্ম হবে। যখনই এই শিশুটা একটু ব্যতিক্রম হয়, তখনই পরিবার থেকে শুরু করে কর্মক্ষেত্রে সব মা-বাবারা বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন, সামাজিক বিভিন্ন কুসংস্কার, সেগুলো মা-বাবার ওপর চলে আসে। মা-বাবার মধ্যে পারিবারিকভাবে দোষারোপের একটি বিষয় চলে আসে। অনেক ধরনের কুসংস্কার পরিবারের ওপর, মা-বাবার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়।
প্রশ্ন : এসব বিষয়ের কিন্তু অনেক বেশি শিকার মায়েরা, যেহেতু শিশুর জন্মটা হয় মায়ের গর্ভে। আপনি কী মনে করেন?
উত্তর : প্রায় সকল দোষারোপটা মায়ের ওপর চলে আসে। আমি এরকম অনেক পেয়েছি যে মা-বাবার বিচ্ছেদ পর্যন্ত হয়েছে, সেই এ ধরনের সন্তানের জন্য। তখন মা একটি বিষণ্ণতায় পড়ে যান। বাবাও অনেক সময় মাকে দোষারোপ করেন। দেখা যায় পরে তাঁরা সন্তান নিতে ভয় পান। পরের সন্তানটি আবার প্রতিবন্ধী হবেন কি না সেই ভয়ের মধ্যে তাঁরা থাকেন। সামাজিক চাপ অনুভব করেন। আরেকটি হলো সহযোগিতার অভাব। পারিবারিক সামাজিক একটি সহযোগিতার অভাব দেখা যায়। এই ক্ষেত্রে তারা হতাশ হয়ে যান। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, যেসব ছেলেমেয়েরা প্রতিবন্ধী, তাদের মা-বাবার মধ্যে বিষণ্ণতা, উদ্বেগের মতো মানসিক অসুস্থতা দেখা দেয়। এ ছাড়া অনেক ধরনের মানসিক অসুস্থতার লক্ষণ তাদের মধ্যে দেখা যায়। এগুলোর প্রভাব ওই শিশুটির ওপর পড়ে। শিশু যেভাবে সেবা পাওয়ার কথা মা-বাবার মানসিক সমস্যাগুলোর কারণে শিশুটি যথাযথভাবে সেবা পায় না। শিশুর বিকাশ বা উন্নতি যেভাবে হওয়ার কথা, সেটি সেভাবে হয় না। এটি দীর্ঘমেয়াদি হলে মা আবারও বিষণ্ণতায় পড়ে যান। এই চক্রের মধ্যেই থাকে। একটি স্বাভাবিক বা সাধারণ শিশুর জন্য যেই চাপগুলো দেওয়া হয়, একটি প্রতিবন্ধী শিশুর জন্য একটু তো বেশি লাগেই। সেই বেশি পরিমাণের জন্য মা-বাবাকে যেই কর্মশক্তি প্রয়োগ করার কথা, সেটা তো তারা পারেনই না, তারপরও তাদের ওপর মানসিক স্বাস্থ্যের চাপ এসে পড়ে। এভাবে শিশুটির উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। শেষ পর্যন্ত পুরো পরিবারটা সামাজিক বা মানসিক চাপের মধ্যে থাকে। শিশুর প্রতিবন্ধী হওয়ার তীব্রতাটাও এই ক্ষেত্রে নির্ভর করে। প্রতিবন্ধী শিশুদের সমস্যাটা বিভিন্ন মাত্রার হয়ে থাকে। কারো কারো সমস্যাটা একটু মৃদু, কারো কারো মধ্যম, কারো কারো অনেক তীব্র। সুতরাং যেসব শিশুদের প্রতিবন্ধী হওয়ার মাত্রা অনেক তীব্র, সেই সব মা-বাবা আরো অনেক বেশি মানসিক সমস্যার ভেতর দিয়ে যায়। কোনো প্রতিবন্ধী মা-বাবা প্রথমেই বলেন আমার মৃত্যুর পর এই সন্তানকে কে দেখবে? এই যে দুশ্চিন্তা। এটি তাদের আরো বেশি মানসিকভাবে দুর্বল করে দেয়। অনেক মা-বাবা এরকম দোয়া করেন যে আমার আগে যেন সন্তানের মৃত্যু হয়। এতটাই আশাহত অবস্থায় থাকেন। আশার কথা হলো সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের যে মেডিকেল সিস্টেম রয়েছে, সেখানে শিশুদের প্রতিবন্ধী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই তার মা-বাবার মানসিক সমস্যার কথা পরিমাপ করার জন্য বলছেন। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান সেই কাজটি শুরু করেছে। এতে তারা মনে করছে শিশুর যে মানসিক সেবা, শিশুর যে শারীরিক মানসিক চিকিৎসাসেবা, তার সঙ্গে সঙ্গেমা-বাবার মানসিক স্বাস্থ্যসেবাকে নিশ্চিত করার পরামর্শ দিতে হবে।
প্রশ্ন : প্রতিবন্ধী মা-বাবার ক্ষেত্রে কোন কোন স্বাস্থ্যসেবার বিষয়গুলোতে জোর দেওয়া প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?
উত্তর : আমি যেটি বলতে চাই যে যখন শিশুটি তীব্র প্রতিবন্ধী হয়, তখন মা-বাবা যদি কোথাও ঘুরতে যেতে চান, বেড়াতে যেতে চান, সেই সুযোগটাও কিন্তু তাদের হয় না। কারণ, ওই সন্তানকে তিনি কোথায় নিরাপদে রাখবেন, সে রকম সামাজিক, রাষ্ট্রীয় কাঠামো নেই। ওই সন্তানকে কিছু সময়ের জন্য যদি নিরাপদভাবে রাখা যেত, উন্নত বিশ্ব যেগুলো অনুসরণ করে, তাহলেও কিন্তু তাঁরা তাঁদের নিজেদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা করতে পারতেন, তাহলে তাঁদের চাপ নিরসন করা যেত। এটি একটি বিষয়। যদিও সরকার এ বিষয়ে যথেষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। এরপর যেটি হচ্ছে সেটি হলো এরকম বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান আমাদের দেশে নেই যেখানে মা-বাবা তাঁদের সন্তানকে একটু রেখে নিজেদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তা করবেন।
প্রশ্ন : এই বিভাগ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আপনার কী মনে হয়েছে, মা-বাবার মানসিক স্বাস্থ্যটা ঠিক রাখতে আশপাশের মানুষেরও কিছু ভূমিকা রাখা উচিত বলে মনে করেন?
উত্তর : আমরা যখন এই ধরনের প্রতিবন্ধী শিশুদের দেখি, মা-বাবা এসে বলেন তাঁরা কোথাও থেকে কোনো ধরনের সহযোগিতা পান না। এমনকি তাঁরা তাঁদের নিজেদের আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকেও কোনো সহযোগিতা পান না। আমরা যদি একে নিশ্চিত করতে পারতাম, তার পরিবার এবং সামাজিক যে সম্পর্কগুলো রয়েছে, রাষ্ট্রীয় যে কাঠামো রয়েছে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর যে কাঠামো রয়েছে, এইখানে যদি কিছু পরিবর্তন আনা যেত, তাহলে দেখা যেত ওই শিশুর মা-বাবা শিশুর পাশাপাশি নিজেদেরও একটু যত্ন নিতে পারতেন।
আমি যদি বলি যে আমাদের সরকারের যে শিশু বিকাশ কেন্দ্রগুলো রয়েছে, সেখানে যদি এই শিশুগুলো থাকার ব্যবস্থা করা যায় সেভাবে তাঁরা একটু মানসিকভাবে শান্তিতে থাকতে পারবেন। এ ছাড়াও যদি সরকারি ব্যবস্থাপনায় প্রতিবন্ধী শিশুদের মায়েদের বিভিন্ন ধরনের সাইকোথেরাপি, কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করা যায় বা একে নিশ্চিত করা যায়, তাহলে তাঁরা মানসিকভাবে সুস্থ থাকবেন। এ ছাড়া যদি আমাদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় আইনের মাধ্যমে, তাঁদের প্রতি যে ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণ হয়, অথবা তাদের প্রতি যে স্টিগমা, সেগুলো থেকে সুরক্ষা দেওয়া যায় তাহলে ভালো। এ ছাড়া সামাজিক যে সচেতনতা, সেগুলোকে যদি আরেকটু বাড়ানো যেত, তাহলে মা-বাবার মানসিক স্বাস্থ্যও ভালো থাকত।