বিষণ্ণতা রোগের প্রতিকার কী?
বিষণ্ণতা একটি মানসিক রোগ। রোগ জটিল হয়ে গেলে অনেক সময় রোগীর মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা চলে আসতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান বিশ্বে এই রোগ দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। আজ ৩০ আগস্ট, এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২১৩৬তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. শামসুল আহসান মাকসুদ।
প্রশ্ন : বিষণ্ণতা বা ডিপ্রেশন কী?urgentPhoto
উত্তর : আসলে বিষণ্ণতা বা ডিপ্রেশন বলতে আমরা যেটা বুঝি, একজন মানুষ তাঁর স্বাভাবিক কাজকর্ম যদি করতে না পারেন, তাঁর মধ্যে এতটাই মন খারাপ থাকে যে, কোনো জায়গায় মনোযোগ দিতে পারছেন না, পাশাপাশি ঘুমের অসুবিধা হচ্ছে, খাবার-দাবারের অসুবিধা হচ্ছে—এটা যদি দুই সপ্তাহের বেশি থাকে, তাহলে আমরা একে বিষণ্ণতা রোগ বলি। বিষণ্ণতা মানে কোনো একদিন সকালে বা বিকেলে আপনার মন খারাপকে বোঝায় না। যদি নির্দিষ্ট কিছু লক্ষণ একজন ব্যক্তির মধ্যে থাকে এবং নির্দিষ্ট কিছু সময় ধরে থাকে, তখনই আমরা তাকে বিষণ্ণতা বলি।
প্রশ্ন : কী কী ধরনের লক্ষণ এবং কত দিন ধরে আসলে বিষয়টি থাকলে একে আমরা রোগ হিসেবে দেখতে পারি?
উত্তর : যখন একজন ব্যক্তি কমপক্ষে দুই সপ্তাহ এ রকম একটি পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন যে তাঁর ঘুমের অসুবিধা হচ্ছে অথবা তাঁর খাবার গ্রহণে অসুবিধা হচ্ছে অথবা যদি এ রকম হয়, তাঁর মনটা এতটাই বিষাদগ্রস্ত থাকে, এতটাই হতাশাগ্রস্ত থাকে যে তার স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারছেন না। এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়ে মনোযোগ দিতে পারছেন না। কোনো একটা কাজে মনোনিবেশ করতে পারছেন না। এটা যদি দুই সপ্তাহ বা তার বেশি সময় ধরে থাকে, একে বিষণ্ণতা বলব।
প্রশ্ন : একজন মানুষ, যিনি বিষণ্ণতা রোগে ভুগছেন বা এটা তাঁর রোগ হয়ে গেছে, তিনি নিজে কি কোনোভাবে সেটি বুঝতে পারবেন? নাকি তাঁর আশপাশের যাঁরা আছেন, তাঁদের বুঝে নিতে হবে যে তাঁকে একজন চিকিৎসকের কাছে নেওয়া উচিত?
উত্তর : অবশ্যই ব্যক্তি বুঝতে পারবেন। হঠাৎ করে কোনো একজন মানুষ শারীরিক কোনো বৈকল্য ছাড়া, কাজে কোনো ধরনের উদ্যোগ পাচ্ছেন না বা কাজের কোনো স্পৃহা পাচ্ছেন না। উনি দেখছেন, তাঁর সবকিছু বোঝার ক্ষমতা থাকার পরও মনোনিবেশ করতে পারছেন না। তাঁর মধ্যে এতটাই ক্লান্তি বা এতটাই মন খারাপ লাগছে যে স্বাভাবিক সহজ অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে পারছেন না।
এটা আপাতদৃষ্টিতে অন্যরা যদিও বোঝেন যে তাঁর কোনো রোগ নেই, কারণ তাঁরা তাঁর শারীরিক কোনো সমস্যা দেখছেন না। তবে তাঁর ভেতর একটি সমস্যা হচ্ছে।
প্রশ্ন : আসলে যাঁর সমস্যা হয়েছে, তাঁরই আগে বিষয়টি বুঝে যাওয়া জরুরি। সে ক্ষেত্রে একজন যখন বুঝতে পারবেন তাঁর এ ধরনের সমস্যা হচ্ছে, কী করণীয়? আপনাদের কাছে যখন যাবেন, কী করেন আপনারা প্রথমে?
উত্তর : বিষণ্ণতা এমন একটি রোগ, যেখানে নির্দিষ্ট সময়ের পর যদি ওষুধ না সেবন করেন বা উপযুক্ত কাউন্সেলিং বা সাইকোথেরাপি না নেন, তা-ও একসময় এটা চলে যাওয়ার কথা। এমনি ভালো হয়ে যাওয়ার কথা। একটা সময় শুরু হয়ে আরেকটি সময় এমনি শেষ হয়ে যাওয়ার কথা।
বিষণ্ণতা কেন এত সমস্যা? কারণ বিষণ্ণ ব্যক্তির অনেক সময় মনে হয়, জীবিত থেকে লাভ নেই, বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াটাই শ্রেয়। অনেক সময় আত্মহত্যার মতো প্রবণতাও চলে আসে। বিনা চিকিৎসায় থাকলে বিষণ্ণতা কখনো ছয় মাস, এক বছরও থাকে। আত্মহত্যা করার মতো বা নিজের জীবনকে নাশ করে দেওয়ার মতো প্রবণতা চলে আসে। এর জন্য এটা এত ভয়ংকর একটা রোগ। বাহ্যিকভাবে তাঁর মনে হয় না যে কোনো শারীরিক সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু তার মনের ভেতর এতটাই খারাপ অবস্থা হয়ে যায় যে তাঁর বেঁচে থাকার কোনো আগ্রহ খুঁজে পান না। সে ক্ষেত্রে আমরা দেখি বিষণ্ণতা রোগের প্রকোপ কী স্তরের, কতটা তীব্র। যদি অল্প স্তরের হয়, তাহলে তাকে কিছু কাউন্সেলিং করে বা সাইকোথেরাপির মাধ্যমে উনি ভালো বোধ করতে পারেন।
প্রশ্ন : সেটি আপনারা কীভাবে বোঝেন যে তাঁর কোন অবস্থায় আছে এই বিষণ্ণতা?
উত্তর : আমরা তাঁদের ক্লিনিক্যাল ইন্টারভিউ করে বুঝতে পারি। অনেক সময় বিভিন্ন রকম স্কেলের মাধ্যমে পরীক্ষা করে থাকি। এখানে তো কোনো রক্ত পরীক্ষা বা অন্য কোনো পরীক্ষার মাধ্যমে বোঝা সম্ভব নয়। এটা রোগীর লক্ষণ এবং তাঁর প্রকাশভঙ্গি দেখে বুঝে নিতে হয়। যদি দেখি এটা মাইল্ড ডিপ্রেশন, সে ক্ষেত্রে কাউন্সেলিং বা সাইকোথেরাপির কথা বলি। অথবা ওষুধ ছাড়া অন্যান্য চিকিৎসাপদ্ধতি, যেটা কথা বলার মাধ্যমে আমরা দিয়ে থাকি, সেটা দিই। আর এটা যদি খুব তীব্র মাত্রায় হয় যে সাইকোথেরাপিতে সে মনোনিবেশ করবে, এই পরিমাণ মনের আগ্রহই তার থাকে না, সে ক্ষেত্রে তাঁকে ওষুধ দিতে হয়। এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে ওষুধ ও সাইকোথেরাপি যদি একত্রে করা হয়, তাহলে রোগীর চিকিৎসার মাধ্যমে উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। এর পরও যদি কারো আত্মহত্যার প্রব্ণতা থাকে এবং এটা যদি তীব্র মাত্রায় থাকে, এটা একটা জটিল অবস্থা, যেটাকে খুব দ্রুত এবং শক্তভাবে এর চিকিৎসা করা দরকার। এবং রোগীর আত্মীয়স্বজনকেও এতে জড়াতে হয়। প্রয়োজনে হাসপাতালে ভর্তিরও দরকার হতে পারে।
প্রশ্ন : সমাজের ওপর বিষণ্ণতা রোগটি কতখানি প্রভাব ফেলে?
উত্তর : দেখুন, আমাদের সমাজ খুব দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। বলা হচ্ছে, আমরা মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হচ্ছি। যত বেশি শহরায়ণ হবে, যত বেশি মানুষের মধ্যে নাগরিক সভ্যতায় অভ্যস্ততা চলে আসবে, তাতে তাঁদের সামাজিক বিভিন্ন ধরনের চাপ, উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা এগুলো বেড়ে যাবে। এবং বিষণ্ণতার মাত্রাও বেড়ে যাচ্ছে। আর বলা হচ্ছে, সমগ্র বিশ্বে ধীরে ধীরে এক নম্বর রোগ হয়ে যাচ্ছে বিষণ্ণতা। এখন সংক্রামক রোগ যেগুলো ছিল, প্রায় বিলীন হওয়ার পথে। আর অন্যান্য রোগেরও প্রকোপ কমে যাচ্ছে। তবে অন্যান্য মনোরোগের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। যত বেশি শহরায়ণ হবে, মনোরোগের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তত বেশি। সে ক্ষেত্রে এটা সারা বিশ্বের সমস্যা। আর আমরা যেটা দেখছি, আমাদের দেশের প্রান্তিক সীমায় যাঁরা বসবাস করেন, যেমন শহরের নিম্ন মধ্যবিত্ত যাঁরা এবং যাঁরা গ্রামে বসবাস করেন, তাঁদের মধ্যে শারীরিক সমস্যা বেশি দেখা যায় মানসিকের তুলনায়। মাথাব্যথা, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে ব্যথা, জয়েন্টে ব্যথা—এ রকম লক্ষণ বেশি প্রকাশ করেন তাঁরা। আমরা তখন ক্লিনিক্যালই বুঝি, এটা তাঁর বিষণ্ণতা। ডিপ্রেশনের চিকিৎসা করলে ওষুধ দিলে, সাইকোথেরাপি করলে সেই এলাকার রোগী হয়তো ভালো হয়ে যায়। তবে যাঁরা শহরে থাকেন, তাঁরা সরাসরি বলেন, আমার মন খারাপ লাগছে, ভালো লাগছে না, মনোযোগ দিতে পারছি না, হতাশ হয়ে যাচ্ছি, কান্নাকাটি করছি। বিষণ্ণতা আসলে সমাজের বিভিন্ন স্তরে রয়েছে।
প্রশ্ন : ব্যক্তি তো কোনোভাবেই তাঁর স্বাভাবিক জীবনে মনোনিবেশ করতে পারছে না। এতে করে তার পরিবার, সমাজ এবং দেশের অনেক বড় ক্ষতি হচ্ছে। কারণ, একজন কর্মক্ষম লোক পুরোপুরি মনোযোগ যদি তাঁর কাজের ওপর দিতে না পারেন, তাহলে সেটির প্রভাব পুরো দেশের ওপর, জাতির ওপর পড়বে। আরেকটি জিনিস জানতে চাইব, যখন বিষণ্ণতা মারাত্মক পর্যায়ে চলে যায়, তখন পরিবারের লোকজনকে এতে জড়ানোর জন্য কী পরামর্শ দেন?
উত্তর : সাধারণত আত্মহত্যার যে ঝুঁকিগুলো থাকে, সেটা রোগীর লোকদের বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করি। রোগী যদি হাসপাতালে না থেকে বাসায় থাকে, তাঁর ওষুধগুলো যেন অভিভাবকের তত্ত্বাবধায়নে খান, সেটা নিশ্চিত করা। তাহলে দুটো জিনিস বোঝা যাচ্ছে, একটা হচ্ছে তিনি ওষুধ খাচ্ছেন, এটাকে নিশ্চিত করা। অনেক সময় আত্মহত্যার প্রবণতা থাকলে ব্যক্তির মধ্যে ওষুধ ওভারডোজ খাওয়ার প্রবণতা হয়। অনেকের হয়তো দেওয়া হয়েছে দিনে দুটো ওষুধ খাবেন, উনি হয়তো ৫০টা বা ৬০টা খেয়ে ফেললেন। তাই সেটা নিশ্চিত করার জন্য বলা হয়, ওষুধ যেন অভিভাবকের তত্ত্বাবধায়নে খায়। এ ছাড়া রোগীর আচার-আচরণকে পর্যবেক্ষণে রাখা। সব সময় তাঁকে একটি পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে।