শিশু অতিরিক্ত চঞ্চল হলে কী করবেন
শিশুর অতিরিক্ত চঞ্চলতা, অমনোযোগিতা বা অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপার অ্যাকটিভিটি ডিসঅর্ডার (এডিএইচডি ) এখন বেশ প্রচলিত সমস্যা। এর ফলে শিশুটি হয়তো বেশি অস্থির হয়ে পড়ে। শিশুটি হয়তো ক্লাসে এক জায়গায় বসে থাকতে পারে না, লেখাপড়ায় মনোযোগী হতে পারে না। ফলে তার পড়াশোনায় ক্ষতি হয়। পরবর্তী সময়ে পারিবারিক জীবনেও এর প্রভাব পড়ে। আজ শনিবার (২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ তারিখ) এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ১৯৫৩তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালের শিশু বিকাশ ও শিশু নিউরো বিশেষজ্ঞ ডা. আনিসা জাহান।
প্রশ্ন : শিশুরা চঞ্চল হয় অনেক সময়। কিন্তু এই চঞ্চলতাকে কখন আমরা সমস্যা বলব?
উত্তর : শিশুদের চঞ্চলতা স্বাভাবিক। কে কত চঞ্চল হবে, এই বিষয়টি বিভিন্ন শিশুর ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম হয়। দেখা গেছে, অতিরিক্ত চঞ্চলতা এবং অমনোযোগিতা দুটো বিষয় একসঙ্গে থাকতে পারে। আবার আলাদাও থাকতে পারে। সাধারণত ১৫ থেকে ২০ ভাগ শিশুর মধ্যে এই সমস্যা থাকে। এদের মধ্যে একটি দল ভালো হয়ে যায়। যখন বড় হয় তখন ২০ থেকে ৫০ ভাগ শিশু স্বাভাবিক হয়ে যায়। আবার এই ২০ থেকে ৫০ ভাগ শিশুর সমস্যাটা অন্য রকমভাবেও থাকতে পারে। এমনি যদি শিশু চঞ্চল হয় এর ফলে কোনো সমস্যা হয় না। এর সঙ্গে আরো কিছু বিষয় যোগ থাকতে পারে। তখনই এটিকে সমস্যা হিসেবে বলা হয়। উদাহরণ স্বরূপ, একটি শিশু হয়তো লিখছে, তার হাতের লেখাটা খারাপ হতে পারে। এটা হয়তো তেমন বড় কিছু না। কিন্তু সে প্রায়ই বানান ভুল করছে। সে হয়তো সব বানান জানে এরপরও ভুল করে, খুব সহজ জিনিস ভুল করে।
পেনসিল, ইরেজার এসব জিনিস হয়তো প্রায়ই হারিয়ে ফেলে। অন্যের জিনিস খেয়ে ফেলে। বাড়ির মধ্যেও সে এটি করতে পারে। কোনো একটা কাজে সে বেশিক্ষণ মনোযোগ দেবে না। জিনিসপত্র ভাঙচুর করতে পারে, ফেলে দিতে পারে। পড়ার ক্ষেত্রে সময় দেয় না বা মনোযোগই দেয় না। এর কারণে স্কুলে লেখাপড়ায় ভালো করতে পারে না।
শিশুটি যদি বেশি চঞ্চল হয়, এটা নিয়ে বাড়ির লোকজন কথা বলে। কিন্তু বিশেষজ্ঞের কাছে যে নিয়ে যেতে হবে সেই বিষয়টি তারা বোঝেন না। আবার অনেক মা-বাবা আছেন সাধারণ চঞ্চলতাটাকে বেশি হিসেবে ধরে নেন। দেখতে হবে এই চঞ্চলতার ফলে শিশুটির আনুষঙ্গিক কাজ ব্যাহত হচ্ছে কি না।
প্রশ্ন : এই অমনোযোগিতা এবং চঞ্চলতাটা সমস্যা কি না সেটি বোঝার আসলে কী উপায়?
উত্তর : এর আসলে নির্দিষ্ট সীমারেখা নেই। বিভিন্ন শিশুর ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম। আবার বাবা-মায়ের অভিযোগের ওপরও নির্ভর করে। এর ফলে শিশুটির হয়তো ঘুমের সমস্যা হচ্ছে, পড়ালেখা ঠিকমতো করছে না। অন্য শিশুর সাথে হয়তো খেলতে দিলে ঝগড়া করে। হয়তো অপর শিশুটিকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। বাসায় এসে অভিযোগ করে। এ ছাড়া দীর্ঘ সময় কোনো কিছুর জন্য অপেক্ষা করতে পারে না। এসব শিশু সব সময় দৌড়াবে, সেটি নয়। বসে থেকেও নড়াচড়া করতে পারে।
প্রশ্ন : আপনি বলছেন, ছয় থেকে ১২ বছরের মধ্যে সমস্যাটি প্রকাশ পায়। সেই সময় বাবা-মা যদি বিষয়টি না বুঝতে পারেন, সে ক্ষেত্রে ১২ বছরের পরে সাধারণত কী হয়?
উত্তর : বয়স বাড়তে থাকলে, মানসিক বৃদ্ধি হতে থাকলে কিছু শিশু এমনিতেই ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু আমরা যদি এটিকে সমস্যা হিসেবে ধরি এবং বাবা-মা যদি এটা না বোঝেন তখন পরিবারের মধ্যে অশান্তি হতে পারে। শিশুদের যদি বড়রা সাহায্য না করেন তাহলে শিশুটি যখন বড় হয়, যখন চাকরিতে প্রবেশ করে, তখন অন্যের সঙ্গে হয়তো মিশতে সমস্যা হয়। বিভিন্ন জায়গায় সমস্যায় পড়ে। অনেক সময় তো মাদকও গ্রহণ করতে পারে বিষণ্ণতা থেকে। এসবের ফলে নিজের পরিবারের সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো হয় না।
যদি আমরা বলি কেন এডিএইচডি হচ্ছে। তার নির্দিষ্ট কারণ কেউ জানে না। অনেক ক্ষেত্রে ধারণা করা হয়, এ সমস্যার জন্য হয়তো বংশগত কারণ আছে। শিশুটি কোন পরিবেশে বড় হচ্ছে সেটিও গুরুত্বপূর্ণ।
যদিও আমাদের দেশে এখনো কোনো পরিসংখ্যান নেই এই রোগীর সংখ্যা নিয়ে। কিন্তু আমি মনে করি, এই সমস্যাটি অনেক বেড়েছে। যদি পারিপার্শ্বিক অবস্থার কথা বলি, তখন দেখি আগে হয়তো শিশুরা রবীন্দ্রনাথের গান শুনত এখন হয়তো তারা ধুমধাড়াক্কা কোনো গান শুনছে। সারাক্ষণ টেলিভিশন দেখলে বা কম্পিউটারে গেম খেললে এগুলো শিশুটিকে একটি বিশেষ দিকে আবদ্ধ করে রাখে। এর ফলেও এডিএইচডি হতে পারে। মস্তিষ্কেও এর থেকে সমস্যা হতে পারে।
প্রশ্ন : এই জাতীয় শিশু যখন আপনাদের কাছে আসে তখন কী করে থাকেন?
উত্তর : প্রথমে শিশুটিকে দেখি । বাবা-মা বললেই আমরা মেনে নেই না। চিকিৎসকরা শিশুটির সঙ্গে পরপর কয়েকদিন কথা বললেই বুঝতে পারেন সমস্যা আছে কি না। আর চঞ্চলতা যদি ছয় মাসের বেশি হয়, তখন এটাকে সমস্যা বলা যাবে। যদি এক মাস হয় বা কয়েক দিনের হয় তবে সেটিকে এডিএইচডি বলা যাবে না। জানতে হবে শিশুটির কেন এই অস্থিরতা হচ্ছে। এমন হতে পারে শিশুটির হয়তো খুব কাছের একজন কেউ মারা গেল, সে সময় সে খুব অস্থির হয়ে পড়েছে। তখন আমরা অভিভাবকদের বলি এটি সাময়িক। ঠিক হয়ে যাবে।
শিশুর মা যদি খুব দুশ্চিন্তা এবং উদ্বেগে ভোগেন, অথবা বাবা-মায়ের মধ্যে বোঝাপড়া ভালো নয়, তখন এই সমস্যাগুলো আপনাআপনি শিশুটির মধ্যে বৃদ্ধি পেতে থাকে। যখন এই ধরনের শিশুর চিকিৎসা করা হয়, তখন প্রথমে পরিবেশটি দেখতে হয়। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই পরামর্শ (কাউন্সিলিং) নিতে হবে। শিশুদের এ ধরনের সমস্যা হলে তাদের বাইরের ফাস্ট ফুড না খাওয়ানোই ভালো।
শিশুটিকে ঘুমানোর আগে যদি ছড়া শোনানো যায়, গল্প বলা যায় , শারীরিক স্পর্শ দেওয়া যায় তখন এটি বেশ কাজে আসে। শিশুটির ভালো লাগে এমন মজার কাজ তাদের করতে দিতে হবে। তাহলে সে অনেকক্ষণ হয়তো সেটি করবে।
প্রশ্ন : আপনাদের পরামর্শ মেনে চললে কি শিশুটি পুরোপরি সুস্থ এবং স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারে?
উত্তর : অনেক শিশুর ক্ষেত্রে ওষুধ ব্যবহার করি। সাধারণ ভিটামিন ব্যবহার করি। কিছু ভিটামিন আছে খুব ভালো কাজ করে। ওষুধ সেবনের পাশাপাশি বাবা-মাকে পরামর্শ দেওয়া হয় শিশুটির সাথে তাঁরা কী ধরনের আচরণ করবেন। এগুলো মিলিতভাবে শিশুটিকে ভালো করে তোলে।