সিজোফ্রেনিয়া কেন হয়?
সিজোফ্রেনিয়া একটি জটিল ও কঠিন মানসিক রোগ। বিভিন্ন কারণে এই সমস্যা হতে পারে। সিজোফ্রেনিয়া কেন হয়, এ বিষয়ে কথা বলেছেন অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আজিজুল ইসলাম।
বর্তমানে মো. আজিজুল ইসলাম আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মনোরোগ বিদ্যা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত।
এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ৩৪২২তম পর্বে সাক্ষাৎকারটি প্রচারিত হয়।
প্রশ্ন : সিজোফ্রেনিয়া কেন হয়? কারা এই রোগের জন্য বেশি ঝুঁকিপ্রবণ? ছেলেমেয়ে ভেদে কোনো তারতম্য রয়েছে কি না?
উত্তর : আমরা যদি প্রথমে কারণটা খুঁজি, আমরা তিনটি ভাগে একে ভাগ করতে পারি। একটি বায়োলজিক্যাল কারণ, একটি সাইকোলজিক্যাল কারণ, আরেকটি সামাজিক কারণ। বায়োলজিক্যাল কারণটিকেই আমরা বেশি করে গুরুত্ব দেই। এখানেও কিন্তু অনেক বিষয় একসঙ্গে কাজ করছে। প্রথমেই যদি আমরা জিনগত কারণে বিষয় বলি, আসলে এটি বংশ পরম্পরায় হয়। সাধারণত দেখা গেছে, ১০০ জন মানুষের মধ্যে একজন মানুষের সিজোফ্রেনিয়া হতে পারে। যে পরিবারে ভাইয়ের সিজোফ্রেনিয়া রয়েছে, সেই পরিবারের বোনের অথবা ভাইয়ের সিজোফ্রেনিয়া হওয়ার আশঙ্কা ১০ ভাগ। যে পরিবারে মা বা বাবার মধ্যে একজনের সিজোফ্রেনিয়া রয়েছে, সেই পরিবারে সিজোফ্রেনিয়া হওয়ার আশঙ্কা ১২ থেকে ১৪ ভাগ। যে পরিবারে মা বা বাবা দুজনেই সিজোফ্রেনিয়াতে ভোগে, সেই সন্তানের সিজোফ্রেনিয়া হওয়ার আশঙ্কা শতকরা ৫০ ভাগ। এগুলো হলো একটি গবেষণা।
আবার দেখা গেছে যে মনোজাইগোটিক টুইন, অর্থাৎ একই ডিম থেকে যদি জমজ সন্তান হয়, তাদের মধ্যে একজনের যদি সিজোফ্রেনিয়া থাকে, তাহলে আরেকজনের হওয়ার আশঙ্কা শতকরা ৫০ ভাগ। সুতরাং দেখা যায়, জিনগতভাবে বা বংশ পরম্পরায় ক্রমোজম বা জিনের একটি প্রভাব থাকছে। এগুলো গেল একটি দিক।
আবার বায়োক্যামিক্যাল বা বায়োনিউরোক্যামিক্যাল একটি বিষয় রয়েছে। আমরা জানি, আমাদের মস্তিষ্ক, আমাদের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সবকিছুর চলন শক্তি হয় মস্তিষ্ক দিয়ে। মস্তিষ্কে কিছু ক্যামিক্যাল তৈরি হয়, আমরা একে বলি নিউরোট্রান্সমিটার বা নিউরোক্যামিক্যাল।
সিজোফ্রেনিয়ার ক্ষেত্রে দেখা যায় ডোপামিন নামের একটি ক্যামিক্যাল বেশি করে কাজ করে। ডোপামিন বেশি বের হওয়া সিজোফ্রেনিয়ার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ।
আমাদের একটি জিনিস বুঝতে হবে, মনোরোগের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ রয়েছে, বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা রয়েছে। ডায়াবেটিস নামক রোগটা যেমন ইনসুলিনের ঘাটতির জন্য হয়, ঠিক একইভাবে ডোপামিন বেশি হলে সিজোফ্রেনিয়া হয়। আপনি যেমন ডায়াবেটিসের চিকিৎসা করছেন ইনসুলনির বাড়ার জন্য, তেমনিভাবে ডোপামিন কমিয়ে সিজোফ্রেনিয়ার চিকিৎসা করা যাবে। এটি হলো আরেকটি দিক। এটি বায়োক্যামিক্যাল কারণ।
কিছু কিছু সিজোফ্রেনিয়াতে মস্তিষ্কের গঠনের মধ্যেও কিছু পরিবর্তন হয়। এটিও দেখা গেছে। এসব সিজোফ্রেনিয়াকে আমরা বলি, নেগেটিভ সিম্পটম সিজোফ্রেনিয়া। টাইপ টু সিজোফ্রেনিয়া। এই সিজোফ্রেনিয়াতে রোগী অন্যদের সঙ্গে মিশতে পারে না, কথা বলে না বেশি, কোনো লক্ষ্য নেই- এরকম ভাবে থাকে। এগুলো আমরা বায়োলজিক্যাল কারণের মধ্যে বলতে পারি।
সাইকোলজিক্যাল কারণের মধ্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ হলো, পরিবার। পরিবার নিজেই একটি কারণ হতে পারে। একটি উদাহরণ দেই। মা ও বাবা দুজনে দুরকম বক্তব্য বলে। দুজনে দুরকম কথা বলে। বাচ্চার মন কিন্তু বিভাজিত হয়ে যায়। সে কোনটি করবে এ বিষয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়।
সিজোফ্রেনিয়া শাব্দিক অর্থ বলতে গেলেও কিন্তু দেখা যাবে স্কিজ অর্থ মন, ফ্রেনিয়া মানে ভাঙা। মনটা ভেঙে যায়। তাই মা-বাবা কিন্তু একটি কারণ হয়ে গেল।
আরেকটি উদাহরণ বলি, বাড়িতে অতিথি এসেছে, মিষ্টি দেওয়া হলো, বাড়ির ছোট বাচ্চাটি বারে বারে মিষ্টি ধরতে যায়। মা তখন বলে, ‘নাও মিষ্টি নাও’। কিন্তু মা যে তাকালো, মনে হলো, মিষ্টি নিলে কিন্তু খবর রয়েছে। এই যে দুই রকম আচরণ বা দ্বৈত আচরণ, এটি কিন্তু সিজোফ্রেনিয়ার একটি কারণ হতে পারে। সুতরাং পারিবারিকভাবেও কিন্তু আপনি সিজোফ্রেনিয়ার একটি কারণ তৈরি করে দিতে পারেন।
আবার দেখা গেছে, যারা অস্থিতিশীল থাকে, তাদের কোনো সামাজিক চাপের মধ্যে পড়লে সিজোফ্রেনিয়া ঘটতে পারে। সম্পর্ক ভেঙে গেলে, মাদক নিলে, অনেক সময় সিজোফ্রেনিয়া হতে পারে।