শিশুর ওজনাধিক্যে কী করণীয়
বর্তমান প্রতিযোগিতার যুগে বেশির ভাগ স্কুলগুলোতে অতিরিক্ত পড়ার চাপ দেখা যায়। তারপর প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে পড়া এবং বাকি যেটুকু সময় শিশুরা পায়, তার সবটুকুই স্কুলের পড়া তৈরি করতে ব্যয় হয়ে যায়।
আর আমাদের দেশে বেশির ভাগ স্কুলে মাঠের অভাব এবং নগরায়ণের ফলে বাড়ির আশপাশে খেলার মাঠেরও অভাব রয়েছে। এ ছাড়া শহরে মাঠ থাকলেও নিরাপত্তার অভাবে বাবা-মা তাঁদের সন্তানদের মাঠে খেলতে দিতে চান না।
ফলে শিশুদের বিনোদনের মাধ্যম হয়ে ওঠে টিভি দেখা, মোবাইল বা কম্পিউটারে খেলা ইত্যাদি। শিশুদের শারীরিক কোনো পরিশ্রম করা হয় না। নগরায়ণের ফলে মানুষের মধ্যে যেমনি ব্যস্ততা বেড়েছে, তেমনি খাদ্যাভ্যাসেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। সুষম খাদ্যের পরিবর্তে খাওয়া হয় ফাস্টফুড।
শিশুদের শারীরিক পরিশ্রম কমে যাওয়া ও খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনের ফলে ওজন বৃদ্ধির প্রবণতা বাড়ছে। প্রতিটি শিশুর বয়স অনুযায়ী তার উচ্চতা এবং ওজনের একটি নির্দিষ্ট হিসাব আছে।
যদি শিশু তার বয়স অনুযায়ী উচ্চতার চেয়ে বেশি ওজনের হয়, তখন তাকে শিশুর ওজনাধিক্য (চাইল্ড অবিসিটি) বলা হয়। বড়দের ওজনাধিক্যের চেয়ে ছোটদের ওজনাধিক্যের ভয়াবহতা বেশি। এতে শিশুরা অল্প বয়সে অনেক রোগে আক্রান্ত হতে পারে। অনেক সময় ওজনাধিক্যের কারণে পারিবারিক বা বংশ থেকে পাওয়া রোগের লক্ষণ ছোটবেলাতেই দেখা দেয়।
ওজনাধিক্যের ফলে শিশুর যে সমস্যা হয়
- অল্প বয়সে উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে।
- ছোট বয়সে টাইপ-ওয়ান ডায়াবেটিস হতে পারে।
- একিউট কিডনি ফেইলিউর হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
- শরীরে ইউরিক এসিড বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
- ছোটবেলায় ওজন বেশি থাকার ফলে শারীরিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। শরীরে চর্বিকোষের পরিমাণ বেশি থাকে। ফলে ওজন কমলেও চর্বিকোষ আকারে ছোট হয়। তবে সংখ্যায় কমে না। পরবর্তী সময়ে খাবারের ফলে ওজন বাড়ার আশঙ্কা থাকে।
- ওজন বেশি থাকার কারণে শিশুরা সব কাজে অমনোযোগী হয়ে পড়ে এবং কাজে অনীহা দেখা দেয়। খাবারের দিকে আকর্ষণ বেড়ে যায়। স্বাভাবিকভাবে একজন মানুষ কতটুকু খাবে তা মস্তিষ্কের সেন্ট্রাল নার্ভ নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু মোটা হওয়ার কারণে সেই পদ্ধতি কাজ করে না।
যেসব কারণে ওজনাধিক্য ঘটে
- সুষম খাদ্য গ্রহণ না করা। অর্থাৎ খাবারে আমিষ, শর্করা, চর্বি, ভিটামিন খনিজ পদার্থ সঠিক পরিমাণে না খাওয়া। মাংসজাতীয় খাবার বেশি খাওয়া এবং শাকসবজি, ফল ইত্যাদি একেবারেই না খাওয়া।
- ফাস্ট ফুড, রিচ ফুড, চকোলেট, মিষ্টি খাবার, চিপস ইত্যাদি বেশি খাওয়ার প্রবণতা।
- পানির পরিবর্তে কোমল পানীয় বেশি পান করা।
- শারীরিক পরিশ্রম না করা।
- সময়মতো খাবার না খাওয়া। যেমন : অনেক শিশুই সকালে খাবার খায় না। অনেকে রাতের খাবার দেরি করে খায়।
- কিছু কিছু অসুখে ওজন বেড়ে যায়। হাইপোথাইরয়েডিজম, অ্যাজমা ইত্যাদি।
- অনেকের বংশগত কারণেও ওজনাধিক্য হয়।
ওজনাধিক্য শিশুর ওজন কমানোর উপায়
- খাদ্যতালিকা থেকে অধিক ক্যালরিযুক্ত খাবার বাদ দিতে হবে। যেমন : মিষ্টিজাতীয় খাবার, চকলেট আইসক্রিম, কোমল পানীয়, শক্তিবর্ধক পানীয় এসব খাওয়া যাবে না।
- প্রতিদিন খাবারে এক শর্করাজাতীয় খাবারের পরিবর্তে বহু শর্করাজাতীয় খাবার খেতে হবে। যেমন : লাল আটার রুটি, মোটা চালের ভাত, গমের ছাতু ইত্যাদি।
- তৈলাক্ত খাবার খাওয়া বাদ দিতে হবে।
- প্রতিবেলা মাংসের পরিবর্তে একবেলা মাছ খাওয়া, অন্যবেলা চর্বিহীন মাংস খাওয়া অথবা দুবেলা মাছ খেতে হবে।
- প্রতিদিন প্রতিবেলায় সবজি খেতে হবে। তবে মূল-জাতীয় সবজি এড়িয়ে চলতে হবে। যেমন: আলু, মিষ্টি আলু, বিট ইত্যাদি।
- প্রতিদিন অন্তত একবার শাক খেতে হবে বা সপ্তাহে চার থেকে পাঁচদিন শাক খেতে হবে। শাকসবজি আঁশ জাতীয় খাবারের প্রধান উৎস। এটি ওজন কমাতে সাহায্য করে।
- প্রতিদিন অন্তত এক থেকে দুটি ফল খাওয়া। অধিক মিষ্টি ফল এড়িয়ে চলা। যেমন : খেজুর, কলা, আম ইত্যাদি। ফল জুস করে না খেয়ে চিবিয়ে খেতে হবে। কোমল পানির পরিবর্তে যথেষ্ট পরিমাণ বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে।
- রান্নার সময় অধিক তেল ব্যবহার করা যাবে না।
- প্রতিদিন খাবারে চর্বিমুক্ত (ফ্যাট ফ্রি) দুধ বা দই খাওয়া। এতে শরীরে ক্যালসিয়ামের চাহিদা পূরণ হয়।
- নিয়মমাফিক খাবার খেতে হবে। সকালের নাশতা থেকে রাতের খাবার পর্যন্ত। সকালের নাশতা ৭ থেকে সাড়ে ৭টার মধ্যে শুরু করা। রাতের খাবার যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি খেয়ে ফেলা। রাত সাড়ে ৯টার পর হালকা কিছু খাওয়া। যেমন : ননিমুক্ত দুধ বা দই খাওয়া।
- প্রতিদিন কমপক্ষে এক ঘণ্টা হাঁটা বা বাইরে খেলাধুলা করা।
- প্রতিদিন কমপক্ষে আট ঘণ্টা ঘুমাতে হবে। এতে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকে।
- সারা দিনে পাঁচ থেকে ছয়বার সুষম খাবার খেতে হবে। এর মধ্যে তিনটি বড় খাবার এবং তিনটি ছোট খাবার খেতে হবে।
সর্বোপরি বাবা-মাকে তাঁর সন্তানের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। সন্তানের ভালো অভ্যাস গড়তে হলে খুব ছোটবেলা থেকেই শেখাতে হবে। কেননা বাবা-মা সন্তানের প্রথম শিক্ষক। তাই সন্তানের লেখাপড়ার পাশাপাশি তার শারীরিক ও মানসিক খাদ্যাভ্যাসের প্রতিও খেয়াল রাখতে হবে।
সামসুন নাহার : জ্যেষ্ঠ পুষ্টিবিদ, অ্যাপোলো হাসপাতাল।